বাঙালির পাকিস্তান প্রেম
মীর রবি
🕐 ১২:৫৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৩, ২০২১
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরুতে যাচ্ছে। এমন সময়ে বাঙালির পাকিস্তানমনস্কতা মুক্তিযুদ্ধপন্থী সকল মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। বিশেষত বিজয়ের এত বছর পর তরুণ প্রজন্ম পাকিস্তান সমর্থন করবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ কেউ একে ভারতবিরোধিতা বলছেন। তথাকথিত ভারতবিরোধিতার নামে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন একাত্তরের ‘ভারতের দালাল’ স্লোগানের মতোই হয়ে যায়। আপনি যদি মনে করেন বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসন বা আধিপত্য বিস্তার ঘটেছে, তবে সেটার বিরোধিতা করতেই পারেন। কিন্তু এর নাম করে পাকিস্তান সমর্থন করবেন কোন যুক্তিতে? এর কোনো সদুত্তর তাদের জানা নেই।
আমরা অবাক হয়ে দেখছি, নতুন প্রজন্মের একাংশ তার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস ভুলে নানা ছুঁতোয় পাকিস্তান সমর্থন করছে। এই পাকিস্তানমনস্কতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এদেশীয় রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটি সেই বীজ মুক্তিযুদ্ধের সময়েই বপন করেছিল। ধর্মের মেলবন্ধনের নাম করে এর গোড়ায় জলসেচ দেওয়া হয়েছে। যা এখন ডালপালা বিস্তৃত করে দৃশ্যমান রূপ নিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরেন। ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেসময়ই শুরু হয় বাংলাদেশ বিরোধীদের বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশবিরোধিতা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে আন্তর্জাতিক অপতৎপরতা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ সুপ্রশস্ত হয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার রোধের সঙ্গে সঙ্গে ঘাতক মোশতাক-জিয়া সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে ‘ইনডিমিনিটি’ আইন পাস করেন। লক্ষ শহীদের বুকে পা তুলে পাকিস্তানি দোসরদের হাতে স্বাধীন দেশের পতাকা তুলে দেওয়া হয়। নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধপন্থী মানুষ হত্যা। সেই সঙ্গে ইতিহাস বদলের হাওয়া লাগে পালে। এতে জোর বাতাস চালান ওয়াজী বক্তা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। প্রজন্মকে ইতিহাসবিবর্জিত করে তুলতে গ্রহণ করা হয় নানা পন্থা। সেই পন্থায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মই আজকের বাংলাদেশের নানা পদে আসীন নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিত্ব। এইসব ব্যক্তিদের মুখেই আমরা নানা সময়ে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য শুনতে পাই। তাদের দ্বারাই প্রভাবিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে ফেসবুক, ইউটিউব ও বিভিন্ন ওয়েব, নামে-বেনামে চলা নিউজ পোর্টাল, ওয়েব টিভি ও ম্যাগাজিনে বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে বহুমুখী মিথ্যাচার চলছে। চলছে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা। ধর্মের ধ্বজা তুলে উগরে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষ ও ঘৃণা। বিশেষত ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে খুব সহজেই নতুন প্রজন্মের মগজ ধোলাই করছে তারা। এই চেষ্টা সাঈদী থেকে শুরু হয়েছিল, তা আজও থেমে নেই। বরং নানা রকম পৃষ্ঠপোষকতায় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মিজানুর রহমান আজহারি নামক এক বক্তা তার বক্তব্যে বলেছেন- ‘ইসলামের জন্য কাজ করা মানুষদের আগে পাগল বলা হতো, এখন বলা হয় রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী’। তার এই বক্তব্য দিয়ে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চান, তা সুস্পষ্ট। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ওয়াজি রাজাকারদের অপরাধকে ধর্মের সঙ্গে লেজুড় লাগিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা। সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে এই বলে বার্তা দেওয়া যে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ মানেই ইসলামবিরোধিতা। যে চেষ্টা খোদ পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী করেও সফল হতে পারেনি, সেই চেষ্টায় আজ এদেশীয় দোসররা অনেকাংশেই সফল। গ্রাম-গঞ্জে শহরে, স্কুল কলেজ মাদ্রাসা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই চিন্তা সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘ইসলামবিরোধী’ তকমায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাঙালি সংস্কৃতি, শহীদ দিবস ও বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ফুলেল শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং নববর্ষবিরোধী কিশোর-তরুণ-যুবকের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ঘৃণা ও অবমাননা বৃদ্ধি করেছে এদেশীয় জ্ঞানপাপীরা। যা আজ নতুন প্রজেন্মের একটা অংশ ধারণ ও লালন করছে গর্বের সঙ্গে! তাদের বোঝানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু মানেই ইসলামবিরোধী কিছু! যে কারণে এখনো শুনতে পাই- পাকিস্তানি ও আমরা মুসলিম ভাই ভাই। তাদের যদি প্রশ্ন করেন বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তানিরা একাত্তরে হত্যা করল কেন, বাঙালিরা তখন কি মুসলিম ছিল না, কিছু সংখ্যক অন্য ধর্মাবলম্বী ছাড়া বাকিসব তো মুসলিমই ছিল, তবুও তারা বৈষম্য ও শোষণ করত কেন? এর সদুত্তর তারা দিতে পারে না। উল্টোপথের কথা শুরু করে এবং বলে ভারতের ষড়যন্ত্রে এসব হয়েছে, পাকিস্তান থাকলেই ভালো হতো!
যে প্রজন্ম পাকিস্তান শাসন দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা দেখেনি, সেই প্রজন্মকে ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে রেখে পাকিস্তানপন্থী করে তোলা খুব কঠিন কাজ নয়। একটু ধর্মের মাসালা মিশিয়ে পরিবেশন করলেই তারা গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করছে ও স্বজাতির ওপর উগড়ে দিচ্ছে বিষ। যে জন্য এদেশের মাদ্রাসাগুলোতে এখনো জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না, বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় না জাতির পিতা। তারা কায়দে আজমেই মশগুল হয়ে আছে ওহাবী, মওদুদীসহ নানা ফিকিরে। মজে আছে পাকিস্তান প্রেমে। বাঙালির পাকিস্তান প্রেমের নজির পাবেন সোশ্যাল মিডিয়ায়, পাকিস্তান-বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচে, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে ও পাকিস্তান হাই কমিশন বাংলাদেশের ফেসবুক পেজের কমেন্টে। যেভাবে তারা পাকিস্তান পাকিস্তান জিকির তোলে, তার একটুও যদি বাংলাদেশের জন্য হতো, তবে আজ বাংলাদেশে অন্যরকম চেতনার বিকাশ ঘটত। বড় বিস্ময়, স্বজাতি হত্যাকারীদের প্রেমে তারা এত অন্ধ হয় কীভাবে? তারা যখন পাকিস্তান-বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তানের পতাকা উড়ায়, স্লোগান দেয় তাদের একটুও মনে হয় না- এই ক্রিকেটেই লেগে আছে শহীদ জুয়েল, মুশতাক, রকিবুলদের রক্ত ও ত্যাগ! তারা যখন নানা ইস্যুতে পাকিস্তান সমর্থন করে তাদের মনে হয় না- ওরা একাত্তরে আমাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে! মনে হয় না কি ওরা আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে শিশুদের! হয়তোবা তাদের কিছুই মনে হয় না। এই মনে না হওয়াটাকেই মনে করিয়ে দিতে হবে।
ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে বাঙালি প্রজন্মের উচ্ছ্বাস বড় বেমানান ও লজ্জাজনক। সেই সঙ্গে আমাদের জাতীয় চেতনার বিরুদ্ধে তা বড় আঘাত। যে আঘাত কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। তাদের এই উচ্ছ্বাস, পাকিস্তান নিয়ে তাদের প্রেমালাপ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা ভুল করেছিলাম! ‘আমরা ভুল করেছি’ এই কথাই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বাস্তবায়ন করতে চায়। তা বাস্তবায়নে রয়েছে নীলনকশা। তারই ধারবাহিকতায় ষড়যন্ত্রের জালে জর্জরিত আমাদের নতুন প্রজন্ম। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের পথ থেকে সরিয়ে বিরাজনীতিকরণ করলে তারা সহজেই সফল হবে বলে ধরে নিয়েছি। আদতে কি তাই? যদি তাই হয় তবে তা আমাদের রুখে দিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে পরম যত্নে।
শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী, জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম তার আত্মজীবনী জীবনে যা দেখলাম-এ লিখেছেন, ‘ঢাকা স্টেডিয়ামে যতবার ভারত ও পাকিস্তান দলের খেলা হয়েছে প্রতিবারই বাংলাদেশি দর্শকের শতকরা প্রায় ৯৯ জনই পাকিস্তান দলের প্রতিই আবেগপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যানার প্রদর্শন করলেও তা দর্শকদের মনে সামান্য প্রভাবও বিস্তার করতে পারেনি। দর্শকরা ওই ব্যানার দেখে মন্তব্য করেছে ‘রাখ মিয়া মুক্তিযুদ্ধের কথা, এখানে মুসলমানদের বিজয় চাই...। ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও ভারতপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের মন্তব্যের কথা শুনেছি।
তারা নাকি বলেন, আমরা বছরের পর বছর চেষ্টা করে যুবসমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারের জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করি তা স্টেডিয়ামে পাক-ভারত খেলায়ই নস্যাৎ হয়ে যায়...।’ তার বক্তব্যকেই যেন আজ ‘পাকিস্তান-বাংলাদেশ’ ম্যাচে বাস্তবায়ন করার জন্য তৎপর পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠী। আমরা কোনোভাবেই চাই না, অতীত ইতিহাস ভুলে বাংলাদেশের কোনো সন্তান পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিক। এজন্য নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই গড়ে তুলতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। ইবতেদিয়া, আলিয়া, আলিম, ফাজিল ও ক্বওমী মাদ্রাসাগুলোকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বিত করা দরকার। ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তককে ঐচ্ছিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশর ইতিহাস, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালির চিরায়ত উৎসবসহ জাতীয় সকল উৎসব পালনে তৎপর হতে হবে। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক আয়োজনের ভিতর দিয়ে স্বদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। দরকার স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী পাঠ ও চর্চা করা হয় তা মনিটরিং করা। দেশে যেন কোনো বাঙালি পাকিস্তানপ্রেমী না হয়ে ওঠে সেজন্য প্রজন্মকে আগেই ইতিহাসের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক, ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন প্রজন্ম ব্যতীত দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থাৎ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
মীর রবি : কবি ও প্রাবন্ধিক