ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কিডনি রোগের লক্ষণ, সুরক্ষা ও প্রতিকার

ডা. রতন কান্তি সাহা
🕐 ১:১৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০১, ২০২১

কিডনি রোগের লক্ষণ, সুরক্ষা ও প্রতিকার

মানবদেহে সাধারণত এক জোড়া কিডনি থাকে। বড় কলাই আকৃতির কিডনি দুটি দৈর্ঘ্যে ৯-১২ সেন্টিমিটার; প্রস্থে ৫-৬ সেন্টিমিটার ও ৩-৪ সেন্টিমিটার মোটা হয়। মেরুদ-ের দুই পাশে কোমরের একটু উপরে এদের অবস্থান। প্রাথমিক অবস্থায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। লক্ষণ যখন দেখা যায়, তখন কিডনি শতকরা ৭০ ভাগ কর্মক্ষমুা হারিয়ে ফেলে।

কিডনি রোগ প্রতিরোধে করণীয়
কিডনি রোগ একটি নীরব ঘাতক। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি বিকল হয়ে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচজনের মৃত্যু হচ্ছে। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এণ ব্যয়বহুল যে, এদেশে শতকরা পাঁচভাগ লোকেরও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। সাধারণত ৭০ ভাগ কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে রোগীরা বুঝতেই পারে না যে সে এই ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই ঘাতক ব্যাধি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় অঙ্কুরেই কিডনি রোগ নির্ণয় ও কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা।

কিডনি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
আমরা প্রতিদিন যা খাই যেমন প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেটস, মিনারেল অথবা যে ওষুধ খাই, তার প্রত্যেকটি প্রথমে লিভারে মেটাবলিজম হবে, কিডনি দিয়ে বের হয়ে যাবে। এখন যদি কিডনি কাজ না করে, তাহলে এই জিনিসগুলো আমাদের শরীরে থেকে যাবে। আর এটা তো প্রতিদিনের কাজ, ২৪ ঘণ্টাই এটা কাজ করে। কাজটা যদি ব্যাহত হয়, তাহলে সেগুলো দেহে জমা হয়ে থাকবে। ফলে কিডনি কাজ করবে না।
আর কিডনি কাজ না করার কারণ হলো, যেটা ধীরে ধীরে কিডনি ধ্বংস করে যেমন, আপনার ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস আছে কিনা, আপনার দুটো কিডনিতে ন্যাফ্রাইটিস (প্রদাহ) এ প্রোটিন লিক করছে, ব্লাড অ্যালবুম কমে যাচ্ছে, কোলেস্টরেল বেড়ে যাচ্ছে এবং আপনার শরীরে পানি আসছে।

দুটি সহজ পরীক্ষায় কিডনি রোগ নির্ণয় করা যায়। ১. মূত্র পরীক্ষায় প্রোটিনের উপস্থিতি দেখা ও ২. রক্ত পরীক্ষায় ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দেখা।
দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের কিছু লক্ষণ হলো, শরীর ফুলে যাওয়া, ক্লান্তিবোধ করা, মনোযোগহীনুা, ক্ষুধামন্দা ও ফেনাযুক্ত প্রস্রাব হওয়া।
যদি ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। স্থুলতা, ধূমপানের অভ্যাস এবং পরিবারে কারও কিডনি রোগ থাকলে সতর্ক হতে হবে।
কিছু লক্ষণ আছে যা দেখলে বোঝা যাবে কিডনিতে সমস্যা
শরীর যদি ফুলে যায়, আর সেই ফোলাটা যদি শুরু হয় মুখম-ল থেকে।
প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে।
প্রস্রাব যদি লাল হয় বা রক্ত যায়।
কোমরের দুই পাশে যদি ব্যথা হয়। এই ব্যথা তলপেটেও হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে।
কিডনি রোগের একটি বড় লক্ষণ হলো প্রস্রাবে পরিবর্তন হওয়া। কিডনির সমস্যা হলে প্রস্রাব বেশি হয় বা কম হয়। বিশেষত রাতে এই সমস্যা বাড়ে। প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়। অনেক সময় প্রস্রাবের বেগ অনুভব হলেও প্রস্রাব হয় না।
প্রস্রাবের সময় ব্যথা হওয়া কিডনির সমস্যার আরেকটি লক্ষণ। মূলত প্রস্রাবের সময় ব্যথা, জ্বালাপোড়া- এগুলো ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের লক্ষণ। যখন এটি কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ে তখন জ্বর হয় এবং পিঠের পেছনে ব্যথা করে।
প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেলে এটি খুবই ঝুঁকির বিষয়। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষণ।
কিডনি শরীর থেকে বর্জ্য এবং বাড়তি পানি বের করে দেয়। কিডনিতে রোগ হলে এই বাড়তি পানি বের হতে সমস্যা হয়। বাড়তি পানি শরীরে ফোলাভাব তৈরি করে।
লোহিত রক্তকণিকা কমে যাওয়ার কারণে মস্তিস্কে অক্সিজেন পরিবহন কমে যায়। এতে কাজে মনোযোগ দিতে অসুবিধা হয়।
কিডনি রোগ হলে গরম আবহাওয়ার মধ্যেও শীত শীত অনুভব হয়। আর কিডনিতে সংক্রমণ হলে জ্বরও আসতে পারে।
কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়লে রক্তে বর্জ্য পদার্থ বাড়তে থাকে। এটি ত্বকে চুলকানি এবং র‌্যাশ তৈরি করতে পারে।
রক্তে বর্জনীয় পদার্থ বেড়ে যাওয়ায় কিডনির রোগে বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়ার সমস্যা হতে পারে।
কিডনি রোগে ফুসফুসে তরল পদার্থ জমা হয়। এ ছাড়া কিডনি রোগে শরীরে রক্তশূন্যতাও দেখা দেয়। এসব কারণে শ্বাসের সমস্যা হয়, তাই অনেকে ছোট ছোট করে শ্বাস নেন।
কিছু কিছু কিডনি রোগে শরীরে ব্যথা হয়। পিঠের পাশে নিচের দিকে ব্যথা হয়। এটিও কিডনি রোগের একটি অন্যতম লক্ষণ।
কিডনি রোগীদের জন্য ডায়েট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডায়েটের মধ্যে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল ও ওয়াটার। এর মধ্যে প্রোটিনের ব্যাপারে আমরা জোর দেই। কেননা, প্রোটিন বেশি খেলে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাবে। আরেকটা, পানি। মনে রাখতে হবে শরীরে পানি আসে তখনি, যখন কিডনি কাজ করছে না। লিভার কিংবা হার্টের রোগ হোক, যদি পানি কিডনি বের করে দেয়, শরীরে পানি আসবে না। কাজেই শরীরে যখনই পানি আসবে, ধরে নিতে হবে কিডনি খারাপ হয়ে গেছে।
সুরক্ষায় যে সকল নিয়ম মানতে হবে
১. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন
২. রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করুন
৩. নিজেকে সবল ও কর্মব্যস্ত রাখুন, প্রতিদিন নিয়মিত ব্যয়াম করুন
৪. সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
৫. পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন
৬. ধূমপান পরিহার করুন
৭. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকুন (বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধ)।
কিডনি বিকল প্রতিরোধ
কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ যদি বলি তবে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কিডনি বিকল হওয়ার আগে কোনোভাবেই প্রকাশ পায় না। এ অবস্থায় দেখা যায় খাওয়ায় অরুচি, বমি বমি ভাব, মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠলে চোখ-মুখ ফোলা দেখানো অর্থাৎ চোখের নিচের অংশ বেশি ভারি ভারি হয়ে থাকে। এছাড়া আস্তে আস্তে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আসে। আরও যদি বেশি ঝুঁকিতে থাকে তবে বিনা কারণে শরীর চুলকাবে, গায়ের রঙ পরিবর্তন হয়ে যাবে। রাতে অনেকবার প্রস্রাব করতে হয়। কারও কারও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। মোটকথা দেহ তো একটাই। যখন এটি খুব বেশি আক্রান্ত হয় তখন সবগুলো অঙ্গই ধীরে ধীরে জড়িত হয়ে যায়। এজন্য এই রোগটিকে নীরব ঘাতক বা সাইলেন্ট কিলার বলা হয়।
১. ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও ন্যাফ্রাইটিস কিডনি বিকলের প্রধান কারণ।
২. ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ রাখা (ঐইঅওঈ ৭ (সাত) এর নিচে)
৩. উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে (১৩০/৮০এর নিচে)।
৪. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীদের কিডনির কার্যকারিতা ও প্রস্রাবে মাইক্রো অ্যালবুমিন প্রতি ছয়মাস অন্তর পরীক্ষা করা
৫. শিশুদের গলাব্যথা, জ্বর ও ত্বকে খোসপাঁচড়ার দ্রুত সঠিক চিকিৎসা করা উচিত
৬. ডায়রিয়া, বমি ও রক্ত আমাশয়ের কারণে রক্ত, পানি ও লবণশূন্য হয়ে কিডনি বিকল হতে পারে। তাই দ্রুত খাবার স্যালাইন খেতে হবে। প্রয়োজনে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে।
৭. ধূমপান বর্জন করুন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন ও নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
৮. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক ও তীব্র ব্যথার ওষুধ সেবন না করা।
৯. প্রস্রাবের ঘন ঘন ইনফেকশনের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে।
১০. চর্বি জাতীয় খাবার ও লবণ কম খাবেন ও পরিমিত পানি পান করবেন।
অযথা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কখনো শুধু শুধু কিডনি বিকল হবে না। অনেকগুলো রোগের শেষ পরিণতি এটি। সেই রোগগুলো প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা সম্ভব। যেমন ধরুন- প্রস্রাব যদি কখনো কমে যায়। অথবা কারও দেখা যাচ্ছে রাতে প্রস্রাব হতো না এখন হচ্ছে। প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়া হয়। প্রস্রাব করার পরেও কিছু প্রস্রাব থেকে যায়। এর সঙ্গে কোমরের দুই পাশে ব্যথা এবং কাঁপুনি থাকে। আবার দেখা যাচ্ছে প্রস্রাবে প্রচুর ফেনা থাকে এবং মুখ ফুলে যায়, তবে মনে করতে হবে কিডনির প্রদাহ বোঝায়।

ডা. রতন কান্তি সাহা : কনসালটেন্ট (ন্যাফ্রোলজি), চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক
জেনারেল হাসপাতাল

 
Electronic Paper