ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নিরাপদ সড়ক কি স্বপ্নই থাকবে!

জিল্লুর রহমান 
🕐 ৫:৩৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০২১

নিরাপদ সড়ক কি স্বপ্নই থাকবে!

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলন, সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করছে। এর সূত্রপাত রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাঈম হাসান নামে নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়া।

 

২৪ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তা হেঁটে পার হওয়ার সময় গুলিস্তান জিরো পয়েন্টগামী ময়লা পরিবহনের একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। এতে গুরুতর আঘাত পায় নাঈম। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর রেশ কাটতে না কাটতেই মাত্র একদিনের ব্যবধানে রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় আবারও প্রাণ হারান এক মোটরসাইকেল যাত্রী। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের উল্টোদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় প্রাণ হারালেন আহসান কবির খান এবং তিনি দৈনিক সংবাদের কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য মতে, অন্য সব যানবাহনের সঙ্গে উত্তর সিটির ময়লার গাড়িটি আটকে ছিল। সিগন্যাল ছাড়া মাত্রই সিগন্যালে থাকা একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেলে থাকা আহসান কবির খান ছিটকে পড়েন। তিনি বাইকের পেছনে ছিলেন। তার মাথার ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা চলে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। এরপর পেছন থেকে লোকজন ধাওয়া দেয় গাড়িটিকে। গ্রিনরোড সিগন্যাল পর্যন্ত গিয়ে চালক এবং তার সহযোগী গাড়ি সেখানে রেখে পালিয়ে যায়।

নটরডেম কলেজের মেধাবী ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর ঘটনার জের ধরে নগরজুড়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তা অবরোধ ও বিক্ষোভ করছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হবে। যেন এভাবে আর কারও প্রাণ সড়কে না ঝরে। কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়।

এভাবে যেন মেধাবী কোনো শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু না হয়। সড়কে পিষে নাঈমকে হত্যা করা হয়েছে, আগামীকাল আমাকে ও আপনাকে হত্যা করা হবে। সুতরাং, সড়কে শৃঙ্খলা দরকার। এভাবে চলতে পারে না। হত্যাকারীকে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ, আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। দুর্ঘটনা রোধে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শুনেছি। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনা কমেনি। বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ হয়নি।

এতে বোঝা যায়, দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপগুলোয় অথবা সেসব কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা গলদ রয়ে গেছে। সেসব দূর করা খুবই জরুরি। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক উঁচু। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে।

একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

২০১৬ সালে সেপ্টেম্বরে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একজন বাসচালক বাংলাদেশে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে চালকদের অতিরিক্ত পরিশ্রমজনিত ঘুমকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেছিলেন, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করার কারণে ড্রাইভাররা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সর্বক্ষণ চালকের কাছে থাকা ইঞ্জিনের গরম হাওয়া এবং বাইরের ও আশপাশের শব্দের কারণেও চালকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

তাছাড়া, সারা রাত ডিউটি করার পর পরদিন সকালে আবার গাড়ি চালাতে হয়। একটা লোক কীভাবে ২৪ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারে? এক সেকেন্ডের জন্যে চোখ বন্ধ হলেও তো অবস্থা খুব খারাপ! মুহূর্তের মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এর জন্য ট্রিপ প্রথা দায়ী। যতদূরের যাত্রাই হোক আসা যাওয়া একজন ড্রাইভারকেই সামলাতে হয়। এরকম অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে ঘুমে ঢলে গিয়ে তিনি নিজেও একবার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তার মতে চালকের ডিউটি যদি সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা বা তারও কম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তাহলে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে যাবে।

সড়ক নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোসহ ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছে।

সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো। সংগঠনটি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতেও ১২টি সুপারিশও করেছে।

সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- অতিরিক্ত ভাড়া-নৈরাজ্য বন্ধ করা, চালকের প্রশিক্ষণ, ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা, ঈদের পরে মনিটরিং কার্যক্রম বহাল রাখা, চালক-শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা।

জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহন আইন করার। আইন হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল, যেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুনে। নির্দেশনাগুলো হলো- দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা।

এসব নির্দেশ যাতে বাস্তবায়িত হয়, তা দেখতে তিনজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক নির্দেশনাগুলোরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। মনে হয় যেন গোয়ালের গরু কিতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই।

সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্বই পাচ্ছে না, যে কারণে দুর্ঘটনা কমছে না।

ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর ছয় দফা নির্দেশনা, সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটির ১১১ সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না করা হলে প্রতিবছর ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালনের কোনো মাহাত্ম্য থাকবে না। সড়কে নিত্যদিন কারও না কারও প্রাণ কেড়ে নেবে, মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে এবং সময় সময়ে নিরাপদ সড়ক দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংগ্রাম চলতেই থাকবে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
[email protected]

 
Electronic Paper