বই নিয়ে
কবিতার বাগানে দলছুট শব্দেরা
এনাম রাজু
🕐 ৫:০০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০২১
লেখক! সে তো যাবতীয় কোলাহল, নীরবতা, অশুভ, শুভকে এক প্লেটে মশলা মেখে মগজে রাখা এক অসাধারণ শব্দের জনক। আর লেখক শব্দটি এমন একটি শব্দ যার সঙ্গে জুড়ে থাকে বিবেক, বুদ্ধিমত্তা, সহনশীলতা, সময়কে অনুধাবন করার অলৌকিক ক্ষমতা।
এ ছাড়াও না বলা অনেক জ্ঞান। বিশেষ করে জ্ঞানপিপাসু হওয়াটাই একটা প্রকৃত গুণ। একজন লেখক তখনই প্রকৃত লেখক হয়ে মানুষের মনে জায়গা পায়। যখন তিনি মানুষের কথা বলেন। কথা বলেন সমাজের বাস্তবতা নিয়ে, আশা-ভরসা, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মানুষের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব দেখে। সেই দীর্ঘ যাত্রার পথে হেঁটে অনেকেই পা পিছলে পড়ে থাকেন মধ্যপথে। কেউ আবার পথের শেষ ছুঁইয়ে ফেলে নিজেকে চেনার আগেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাঁটি হাঁটি পা পা করেই লেখক নিজেকে দাঁড় করাতে পারেন লেখক শব্দটির বিবেচনায়। সেই ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল শব্দশ্রমিক সালেহা চৌধুরী। তার অনেক গল্প পড়েছি।
আর জেনেছি কীভাবে গল্প এগিয়ে যায় জীবনের পথে। কিন্তু কবিতা পড়া হয়নি। জানা হয়নি আগে তিনি কবিতায়ও গল্পের চিত্র, কারুকার্য ফুটিয়ে তুলতে কতটা পারদর্শী। এবার সেই অজানাটাও জানা হয়ে গেল ‘দলছুট শব্দেরা’ বইটি পাঠ করে। ‘দলছুট শব্দেরা’ বইটি মোট ৭৮টি কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে। কবিতাক্রম দেখলেই সহজে অনুমান করা যায় কবিতাগুলোকে তিনি চারটি বিভাগে ভাগ করেছেন।
‘জনান্তিকে বলে রাখি জাতির পিতা
তোমাকে নিয়ে চিৎকার ও খিস্তি খেউড় করবার সেইসব মানুষ হৃদয়হীন।
তোমার মৃত্যু ওদের পরাজয়ের শেষ কথা।
কিন্তু তুমি? তোমার হৃদয়টাতে এত আলো আর এত ভালোবাসা
সতের কোটি মানুষ জ্বালাতে পারে- একটি করে প্রদীপ
এবং আজকের দিনেও ভালোবেসে বাঁচতে পারে।’
(কবিতা : তোমার কথা ভেবে হে জাতির পিতা)
তোমার কথা ভেবে হে জাতির পিতা দীর্ঘ কবিতাটির প্রতিটি পঙ্ক্তি যেমন বাস্তবতার রসে সিক্ত তেমনি অনেক বিষয়কে একত্রিত করে একটা বিশালতার আকাশে অনেক প্রশ্ন ছুড়েছেন। এবং সেই সব প্রশ্নের উত্তরও কৌশলে দিয়েছেন গল্পের ঢংয়ে। যখন তিনি বলেন-
‘তোমার কারণেই আমরা সেদিন দুর্গ বানিয়েছি
আমরা একজন আর একজনকে ভালোবেসেছি
আমরা দীর্ঘ রাত নির্ঘুম ও কষ্টে কাটিয়ে দিয়ে হেসেছি
তুমি আছ এবং আবার আসবে এই ভরসায়।’
আবার খুব যতনে বলেছেন-
‘তোমাকে ঈশ্বর বানিয়ে পুজো করতে হবে
এই কি তুমি চাইতে?’
‘শ্রদ্ধাভাজনেষু প্রিয়জনেষু’ বিভাগে এরকম বেশ কয়েকটি কবিতায় তিনি অনেক চমকপ্রদ বিষয় উপস্থাপন করেছেন। কবির ধর্ম শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘সাহিত্য সাগরে সুযোগ্য নাবিক
হে কবি তুমি বিশ্বনাগরিক।’
‘শ্রদ্ধাভাজনেষু প্রিয়জনেষু’ অধ্যায়ে কবি বেশ কিছু কবিতা পাঠক হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করেছে। যেমন- কথা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, নাগরিক আকাশ, ছায়াবৃত্ত ইত্যাদি। প্রত্যেক কবির চোখ খুঁজে ফেরে সবুজের মাঠ, ধানখেতের আইল, আইভিলতার বেড়ে ওঠা, নদীর পাড় ভাঙা ঢেউ কিংবা রূপসী নদীর ঢেউয়ে সুরের কলতান, বকের ধ্যান, মাছের শরীরের মানচিত্র। সেই কবি যেখানে বসবাস করুক না কেন, যে করিডোরে নিজেকে আবদ্ধ রাখুক না তবুও তার চোখের সিঁড়ি বেয়ে অনন্ত আনন্দের গ্রামের সবুজ ঘেরা মায়াছায়াকে স্পর্শে স্পর্শে নিজেকেও মুগ্ধ মাতাল করে। আর কলমের তুলিতে তুলে আনে সেসব মাতালের শব্দ ঢেউ। বহুমাত্রিক লেখক সাহেলা চৌধুরী মূলত কথাকার, শব্দের কঠিন করাতে তিনি তরল করেন মানবিক সৃষ্টিকে। সেই কথাকার যখন কাব্য রচনা করবেন তখন তো সেখানেও তার ছাপ স্পষ্ট থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ‘প্রকৃতি ও প্রেম’ অধ্যায়ে কবি সেরকম ছায়ামাখা ভালোবাসার পরশ রেখেছেন শব্দের ঝংকানিতে। কয়েকটি কবিতার শিরোনামই যেন বলে দেয় কবিতার গভীরে প্রবেশের আমন্ত্রণ, যেমন- যৌবন ও বাঘের কবিতা, শরতের শেষ আর শীতের আরম্ভ, গাছের ভেতর দিয়ে পথ, অসমাপ্ত বাগানের কবিতা, আর একটি সকাল ইত্যাদি। কবি লিখেছেন-
‘ওরা কথা বলেন,
আর ভাবেন বাঘের মতো কোনো জন্তুর দাঁত খিঁচানো,
এখন আর দাঁত খিঁচানো নেই।
বাঁধানো দাঁত, সীমাবদ্ধ জীবন...।’
(কবিতা : যৌবন ও বাঘের কবিতা)
কবিতায় কথা বলার চেষ্টা করা বহুমাত্রিক লেখক সালেহা চৌধুরীর কবিতায় গল্পের ঘ্রাণ স্পষ্ট। তবে দৃশ্যমান কোনো গল্পকে কবিতায় রূপ দেওয়া সহজ ছিল না। কঠিন সেই কাজকে শব্দের দোলনায় তুলে দোল দিতে দিতে কাব্যের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন।
একদিকে যেমন তিনি লেখক তেমনই অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মানুষ। তাই হয়তো মানুষের যাবতীয় গুণ নিজের লেখায় স্থাপন করতে সাহিত্যের সকল স্তরে তার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের সাক্ষর রেখেছেন খুব যতনে। মানব মানবী, দেশ ও ভাষা অধ্যায় দুটিতে কবি মানুষের যাবতীয় বিষয় তুলে এনেছেন। একই সঙ্গে মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা, মানবিকতার নিখুঁত চাষাবাদ করেছেন। দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার নিপুণতা এঁকেছেন শিল্পীর তুলিতে। কবি ছন্দ ও অন্ত্যমিলের বেড়াজাল ভেদ করে কবিতায় নিজস্বতার সাক্ষর রাখতে চেষ্টা করেছেন। কঠিন শব্দের ব্যাধি থেকে কবিতাকে রেখেছেন কয়েক ক্রোশ দূরে। প্রতিটি কবিতার ভাষা যেমন সহজ তেমনই গল্পনির্ভর।
এই জায়গায় কবি সার্থক। ‘দলছুট শব্দেরা’ পাঠকের মন ও মননজুড়ে জায়গা করে নিক এই প্রত্যাশা রইল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বইটির প্রকাশক বেহুলাবাংলা। মূল্য ২৭৫ টাকা; প্রচ্ছদ করেছেন হাজ্জাজ তানিন।
লেখক : কবি ও গল্পকার; ছোটকাগজ সম্পাদক।
[email protected]