ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জোটরঙ্গ : ডিজিটাল প্যানিকে সরকার

মোস্তফা কামাল
🕐 ৯:৫২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২০, ২০১৮

চার দিনে তিনটি দল ভেঙে ছয় টুকরা। সেই সঙ্গে তাদের জোটরঙ্গ। সকাল-সন্ধ্যা অ্যাকশন-পাল্টা অ্যাকশন। অনেকের কাছে এগুলো প্রাক-নির্বাচনী বিনোদনের খোরাক। এন্টারটেইন আইটেম। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী মতের জোটগত রাজনীতির এ আলামত আরও পর্যবেক্ষণের কৌশল নিয়েছে সরকার। দেখতে চায় বিরোধী জোটের গতিবিধি।

বর্তমান ও সাবেক মিত্রদের ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্তে আসা একটু কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন, রব-মান্নাদের নোংরা ভাষায় সমালোচনা-তাচ্ছিল্য করলেও পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টে যাওয়া সরকারের জন্য উদ্বেগের। আবার অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নাম ব্যঙ্গ করাসহ সমালোচনার আড়ালে তার সঙ্গে নেপথ্য আঁতাতের বিষয়টি শেষতক গোপন রাখা যায়নি। রাজনীতির বাইরের মানুষের কাছেও এটি ওপেন সিক্রেট।
ক্ষমতার লড়াই, ভোট শিকারের রাজনীতিতে জোট বা জটলা পাকানোতে এখন গোপনীয়তার কিছু থাকেও না। আদর্শ-উদ্দেশ্য, নীতি-নৈতিকতা, সত্য-মিথ্যা, ডান-বাম এ ক্ষেত্রে মোটেই মুখ্য নয়। রাজাকার-স্বৈরাচার, জামায়াত আর হেফাজতও ফ্যাক্টর নয়। মানুষও এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন মহল এ বাস্তবতা বুঝেছে তুলনামূলক আগে। সেই আলোকে তারা ডান-বামের দাওয়াই কার্যকর করেছে আগেভাগেই। সামনে আরও কিছু অপেক্ষমাণ। তফসিল ঘোষণার আগে-পরে জোটবাজিতে চমক দেখানোর যাবতীয় প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের। মিত্রতার জন্য বিদ্যমান ১৪ দল, এরশাদ-মঞ্জুর জাতীয় পার্টি, কয়েকটি ইসলামি দল ছাড়াও ডজন খানেক দল আওয়ামী লীগের পিছু নিয়েছে।
এ বাস্তবতায় সরকার এখনই এ নিয়ে হুলস্থুলে যেতে যায় না। বরং বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্টকে পর্যবেক্ষণ করাকে জরুরি মনে করছে। এর চেয়ে সরকার বেশি উদ্বিগ্ন সম্ভাব্য গুজব নিয়ে। বিরোধী দল ও জোট রাজ্যে ভাঙা-গড়া সরকারের জন্য এখনো সে মাত্রায় উদ্বেগের নয়। ক্ষেত্রবিশেষে উপভোগের। গত চার দিনে বিরোধী মতের তিনটি দল ভেঙে ছয় টুকরা হয়েছে। বাপ-বেটা বি. চৌধুরী-মাহী ও তাদের মহাসচিব মেজর মান্নানকে বহিষ্কার করে নয়া বিকল্পধারা গঠনের পেছনে বিএনপির ষড়যন্ত্র দেখছেন তারা। এত দিন ঠিক যেমন তাদের পেছনে সরকারি মদদ-আশকারা দেখছিল বিএনপিসহ ড. কামালের ঐক্যফ্রন্ট।
শুক্রবার সকালে বিকল্পধারার নেতা নুরুল আমিন ব্যাপারী ও বহিষ্কৃত নেতা শাহ আহম্মেদ বাদল সংবাদ সম্মেলন করে বি. চৌধুরী, মহাসচিব আবদুল মান্নান ও মাহীকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন কমিটি করেন। এতে নুরুল আমিনকে প্রেসিডেন্ট ও বাদলকে মহাসচিব করা হয়। এই অংশটি ড. কামালের ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে থাকবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। পরে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন মাহী বি. চৌধুরী। বলেন, বিকল্পধারার নামে দল গঠন ঘৃণিত ও হাস্যকর। তিনি বলেন, ‘বিকল্পধারার বহিষ্কৃত নেতা শাহ আহম্মেদ বাদল বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর একজন কর্মচারী। সেখান থেকেই এটি হয়ে থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত তার।
এদিকে, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আরও কয়েকটি দল যোগ দিতে পারে। কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের ওঠাবসা চলছে। আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও ১৪ দলের সঙ্গে ভেড়ার আশেকও কম নয়। সরকার এ মুহূর্তেই সেই আসরটা জমাতে চায় না। এর আগে, জোটের ভাঙা-গড়া এবং ছোট দলগুলো ভাঙতে ভাঙতে আরও ছোট হলে মন্দ কী!
ছোট দলগুলোর ভোট কম থাকলেও অনেকগুলো দল একমঞ্চে জড়ো হলে মানুষের মধ্যে ঐক্যের বার্তা যায়। দলের চেয়ে জোটের ওপর আস্থা জোরালো হয়। এই ইক্যুয়েশনে ছোট দলগুলোকে পাশে জায়গা দেয় বড় দুটি দল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জাতীয় পার্টির বাইরে বাকি দলগুলোকে আঙ্গুলে টিপে গুনে কুলানো যায় না। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলেও জামায়াতকে গুনতে হয় তাদের ভোটারের অঙ্কের কারণে। বাদবাকিদের নামই অনেকের জানার বাইরে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য হচ্ছে, বর্তমানে দেশে মোটমাট রাজনৈতিক দল ১৯৩টি। এগুলোর মধ্যে নিবন্ধিত দল ৩৯টি। আর জোট কমছে কম ১৪টি। কিন্তু হালনাগাদ হিসাবে ইসির এ হিসাব এখন মেলার কথা নয়। সরকারের দিক থেকেও এখন দল বা জোট গোনার সময় নেই। তাদের হিসাব, ভয়, সমীকরণ অন্যদিকে।
নির্বাচন সামনে রেখে অস্থিরতার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কায় ভুগছে সরকার। একাধিক সংস্থা থেকে সরকারকে এ সংক্রান্ত সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়েছে। বাঘা বাঘা মন্ত্রী-এমপিসহ ক্ষমতাসীন শীর্ষ পর্যায়ের কারও কারও বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট আসতে পারে-এমন কিছু সতর্কবার্তাও রয়েছে। যা সরকারকে ঘাবড়ানোর সময়ের আগেই ঘাবড়ে দিয়েছে। এ কারণে গণমাধ্যম ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নজরদারি তীব্রতর করা ছাড়া সরকারের বিকল্পও নেই।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউয়ের বিবৃতিতেও রয়েছে এমনই ইঙ্গিত। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নতুন কঠোর আইন ও নীতি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক, ইন্টারনেটে মন্তব্যকারী ও সম্প্রচারকারীদের লক্ষ্যবস্তু করে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের ওপর সরকারের কঠোরতা বিরোধী দলগুলোকে ভীতিতে ফেলেছে। একই অবস্থা স্বাধীন পর্যবেক্ষকদেরও। সংস্থাটির এশিয়ার পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের থামিয়ে দিতে জনসাধারণের নিরাপত্তা ইস্যুকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ।
এনালগ থেকে ডিজিটালে উত্তরণের গর্বভরা সাফল্যের পথে সরকারের এমন উল্টোযাত্রার ফল শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে-এ প্রশ্নের জবাব সময়সাপেক্ষ। তবে হালপরিস্থিতি বলছে, এ ধরনের পদক্ষেপ হিতে বিপরীতই হয়। তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা বুমেরাং হওয়ার উদাহরণই বিশ্বে বেশি। তথ্য তখন বরং বিকৃত হয়। তিল তাল হয়ে যেতে সময় লাগে না। গুজবও জোরদার হয়। ডালপালা ছড়ায়। সংবাদপত্র বা টেলিভিশনগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও দায়বদ্ধতায় থাকলেও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারী ২ কোটি ২৮ লাখ। আর ফেক বা ফলস তো রয়েছেই। তাদের মধ্যে সরকারের বিপক্ষ শক্তিও কম নয়।
সরকারের পক্ষ-বিপক্ষ যা-ই হোক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন প্রভাবশালী। দায়মুক্ত প্রভাবশালীরা ভয়ঙ্করই হয়। সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সরকারের তড়িঘড়ি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারির পেছনে এ বাস্তবতা কাজ করে থাকতে পারে। তা কার্যকর করতে সরকার এখন বিভিন্ন ইন্টারনেটভিত্তিক সম্প্রদায় ও প্ল্যাটফর্মের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। তা-ও কতটা কাজে দেবে-আল্লাহ মালুম। তবে এ উছিলায় ধরাবাঁধা ব্যবসা জমবে, তা নিশ্চিত। এরই মধ্যে এ ব্যবসা কিছুটা জমে উঠেছেও। এর শেষ ফলও কোথায় গিয়ে ঠেকবে-মোটা প্রশ্ন হয়েই থাকছে।
এ ক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের ভবিষ্যদ্বাণী বেশ প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, দীর্ঘমেয়াদে আইনটিও বুমেরাং ও আত্মঘাতী হতে বাধ্য। দীর্ঘমেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। সরকারি ঘরানার গণমাধ্যমকর্মী এবং সরকারের সহায়ক গবেষণাকর্মীরাও প্রতিবন্ধকতায় পড়ে প্রকারান্তরে সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি আবিষ্কারেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার সময় এর নেতিবাচক দিকটির কথা সেভাবে না ভেবে গর্ব জাহির করা হয়েছে। প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আগেই মানুষের হাতে তা তুলে দিয়ে বাহবা নেওয়ার একতরফা চেষ্টা চলেছে। যার অনিবার্য পরিণতিতে ডিজিটাল ব্যবস্থা এখন এর গর্বকারীদের জন্যও বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে।
ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই মিথ্যা, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজব ছড়াচ্ছে। জনমনে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। বিরোধীপক্ষ যখন এই কষ্টে ভুগেছে বা তাদের ভোগানো হয়েছে তখন সরকার উল্লাস করেছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর শিকার বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারই। সরকারের কিছুদিনের মধ্যে তা আরও ভয়ঙ্কর মাত্রায় গিয়ে ঠেকার আতঙ্কে ভোগার মূল কারণ এখানেই। কিন্তু মামলা-হামলা, ধরাবাঁধায় তা রোখাও সহজসাধ্য নয়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

 
Electronic Paper