ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিষাদময় জন্মদিন

ভালোবাসার নাম শেখ রাসেল

আর কে চৌধুরী
🕐 ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০২১

ভালোবাসার নাম শেখ রাসেল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ড থেকে সেদিনের অবুঝ শিশু রাসেলও রেহাই পায়নি।

বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণিত, বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। তবে এটি শুধু হত্যাকাণ্ড ছিল না। একটি সদ্য স্বাধীন ও জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও ছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি দল হানা দেয়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুসহ বাড়িতে থাকা পরিবারের সবাইকে একে একে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডে আরও শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুলাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু ও বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসা প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ।

পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কিন্তু শেখ রাসেলকে যে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে এরকম হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। হত্যাকাণ্ডের সময় আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল শেখ রাসেলকে। শিশু রাসেলকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ করেছে।

এ ধরনের নিষ্ঠুর ‘মার্সি কিলিং’ শুধু রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, সেই সঙ্গে ধ্বংস করেছে তার সব অবিকশিত সম্ভাবনাও। বাবার বুকের গভীরে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের উষ্ণতা নেওয়ার যখনই ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, ঠিক তখনই নরঘাতকদের দল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ছেলে হয়েও শেখ রাসেলের চলাফেরা ছিল খুব সহজ সরল এবং সাধারণ। তার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ ও আন্তরিকতা সবাইকে মুগ্ধ করত। শেখ রাসেলের বিভিন্ন শিক্ষকও বলেছেন, তাদের শিক্ষক জীবনে শেখ রাসেলের মতো শিক্ষার্থী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মেধা ও মননের অপূর্ব সমাহার ছিল শিশু রাসেলের কচিমনে। তার শিশু মন ছিল মানবিকতায় ভরা। তার মনে হাজারো প্রশ্ন থাকত, সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইত। শিশু রাসেলের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। তাই তো মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করত রাসেল।

এসব নিয়ে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর মনেও চাপা কষ্ট অনুভূত হতো। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির প্রতিটি মানুষ মানবিক বোধে গুণান্বিত। শেখ রাসেল মাত্র ১০ বছরের শিশু হয়েও সেই মূল্যবোধে তাদের একজন হয়ে উঠেছিল। তবে ঘাতকরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করলেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না। সেই প্রত্যাশায় তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ছোট্ট শিশুটিকেও ছাড় দেয়নি। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। শেখ রাসেল সম্ভাবনাময় একটি শিশু। সে বেড়ে উঠতে পারত বাংলাদেশের হয়ে। আমরা তাকে হারিয়েছি অঙ্কুরে। তবে আমরা চাই বাংলাদেশের সকল শিশু যেন সাংস্কৃতিক মনোভাবে বেড়ে ওঠে।

শেখ হাসিনার সরকারকে ধন্যবাদ জানাই শেখ রাসেলের স্মৃতি রক্ষার্থে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় শহীদ শেখ রাসেল পার্ক করায়। পার্কটি অত্র অঞ্চলের মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়ার একটি জায়গাতে পরিণত হয়েছে। শেখ রাসেল পার্কের সামনে অবস্থিত আমার নামে নামকরণ করা আর কে চৌধুরী সড়ক। আর কে চৌধুরী সড়কটি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। সড়কটি যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে উত্তর দিক দিয়ে ধলপুর হয়ে গোলাপবাগে গিয়ে শেষ হয়েছে। সড়কটিতে রয়েছে একাধিক হাইস্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একাত্তরের পরাজিত শক্তির সুগভীর ষড়যন্ত্রে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রাণ হারাতে হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে খুনিচক্র বাঙালি জাতির আত্মাকে হত্যা করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারের চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। আর তাদের ওই ঘৃণ্য অপচেষ্টা যে শতভাগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এটি আজ প্রমাণিত। শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম।

শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে আজ একজন সুনাগরিক হিসেবে দেশের উন্নতি করতে পারতেন। কিন্তু সেই সুযোগ আমরা হারিয়েছি। তবে সেই ছোট্ট শিশুর আদর্শে আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠবে এবং দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। শেখ রাসেলের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ

 
Electronic Paper