ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শিষ্টাচার বা আদব-কায়দা

গোপেশচন্দ্র সূত্রধর
🕐 ৩:৩২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২১

শিষ্টাচার বা আদব-কায়দা

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বাস করতে হলে সমাজবদ্ধ হয়েই বাস করতে হয়। শুধু মানুষ কেন, কীট-পতঙ্গ থেকে আরম্ভ করে সকলেই সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে।

রাস্তায় চলতে গিয়েও দেখা যায়- পিপিলিকা সারি বেঁধে চলে, আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায়- আকাশের পাখিরাও ঝাঁক বেঁধে ওড়ে, মাঠের ছাগল ভেড়াও দল বেঁধে চলে। অন্যসব প্রাণীদেরও একসঙ্গে চলতে দেখা যায়। সবাইকে সমাজবদ্ধ হয়ে চলতে দেখা যায়। আর আমাদের সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতেই হয়।

তাই তো জেফারসন বলেছিলেন- ‘সমাজ ব্যতীত এবং নিজেদের পছন্দসই সমাজ ব্যতীত মানুষ কখনো পরিতৃপ্ত হয় না।’ মানুষ সমাজবদ্ধ জীব বিধায় সমাজের অপরাপর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। সংসারে জীবনযাপন করতে হলে বহু মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়, পারিবারিক জীবনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে হয়। অফিস-আদালতে বা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অথবা বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত প্রত্যেক মানুষের সংস্পর্শে আসতেই হয়। এর ফলে মানুষের আচার আচরণে, কথা-বার্তায়, ভাব বিনিময়ে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা হয়ে যায়। এই পর্যায়ে মানুষের যে আচার-আচরণ ও ব্যবহার প্রকাশ পায় তাতে শিষ্টতা প্রকাশ পায়। যখন একের সঙ্গে অন্যের ভাবের আদান-প্রদান হয় তখন উভয়ের মধ্যে একটি সুন্দর যোগসূত্র স্থাপিত হয়, আর হয় একের সঙ্গে অন্যের একটি মেলবন্ধন।

এই মেলবন্ধন স্থাপিত হয় পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকে। তাই সমাজে দেখা যাচ্ছে যে, বড়রা ছোটদের ভালোবাসে, স্নেহ করে, আদর করে, আর ছোটরাও বড়দের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। আর সমবয়সীরা পরস্পরের সঙ্গে প্রীতির ভাব বিনিময় করে। এটিই সমাজের রীতি-নীতি। সমাজের এই রীতি-নীতিকেই ইংরেজিতে বলে কাস্টম বা প্রথা। অন্য কথায় ইহাকে বলা হয় শিষ্টাচার বা আদব-কায়দা। সভ্য ও ভদ্র ব্যক্তি লোকসমাজে যে সৌজন্যমূলক আচরণ ও শালীনতার পরিচয় দেন, এটাই হলো শিষ্টাচার।

শিষ্টাচার শব্দটির মধ্যেই এর আসল ভাবটি অন্তর্নিহিত রয়েছে। শিষ্টাচার কথাটিকে যদি ভেঙে বলা হয় তাহলে দাঁড়ায়- শিষ্ট+আচার=শিষ্টাচার। শিষ্ট কথার মানে হলো- নম্রতা ও ভদ্রতা। আর আচার মানে হলো- সুব্যবহার বা নম্র আচরণ। ইহাকেই আমরা শিষ্টাচার বা আদব-কায়দা বলি।

আদব এর কথা বলতে গিয়ে দার্শনিক ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন- ‘তোমার সন্তানকে প্রথমে বড়দের মান্য করতে এবং পরে মিষ্ট আচরণ করতে শেখাও।’ এর মূল কথা হলো তোমার সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই বড়দের শ্রদ্ধা করতে শেখাও। এই শ্রদ্ধাবোধ থেকেই মানুষের মনুষ্যত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মনুষ্যত্ব না থাকলে কখনো শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয় না। এই শ্রদ্ধাবোধ আমাদের ছোটবেলা থেকেই শিখতে হয়। শ্রদ্ধার কথা বলতে গিয়ে জন ব্রাইটও বলেছিলেন-‘প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকার অর্থ নিজের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা।’

আর ডা. লুৎফর রহমান বলেছেন- ‘মানুষকে যারা শ্রদ্ধা করতে শিখে নাই তাদের স্বাধীনতা পাওয়ার কোনো অধিকার নেই। মনুষ্যত্ব মানে জীবনের উচ্চাঙ্গের ভদ্রতা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ আর শেখ সাদী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন- ‘শৈশবে যে শিষ্টাচার শেখে না, পরিণত বয়সেও তার কাছে ভালো কিছু আশা করা যায় না।’ তাই দেখা যাচ্ছে, শিষ্টাচার মানব চরিত্রের একটি বড় গুণ। শিষ্টাচারের মধ্যেই মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা নিহিত থাকে। শুধু বিদ্যা কিংবা বুদ্ধির দ্বারা সাধিত হয় না। নৈতিকতার উৎকর্ষ।

বিদ্যা-বুদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতির একত্র সমাবেশে চিত্ত ও মনের যে প্রকৃত সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তা ব্যবহারের মাধ্যমেই শিষ্টাচার প্রকাশ পায়। আজকাল আমাদের সমাজে অধিকাংশ লোকের আচরণেই এই শ্রদ্ধাবোধ বা শিষ্টাচার দেখা যায় না। এই শ্রদ্ধাবোধের কথা বলতে গেলে আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতেই হয়। তার চিঠিপত্র থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

শ্রদ্ধাবোধের কথা বলতে গিয়ে কবিগুরু নাতিকে (নাতির কাছে দাদুর চিঠি) চিঠি লিখতে গিয়ে লিখেছেন- ‘তোমরা আমাদের প্রণাম কর আর না কর আমাদের তাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, কিন্তু তোমাদের আছে। ভক্তি করিতে যাদের লজ্জাবোধ হয় তাদের কোনোকালে মঙ্গল হয় না। বড়োর কাছে নিচু হইয়া আমরা বড়ো হইতে শিখি, মাথাটা তুলিয়া থাকিলেই যে বড়ো হই তাহা নয়।’
‘পৃথিবীতে আমার চেয়ে উঁচু আর কিছু নাই- আমি বাবার জেষ্ঠতাত- আমি দাদার দাদা’ এইটে যে মনে করে সে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তাহার হৃদয় এত ক্ষুদ্র যে, সে আপনার চেয়ে বড়ো কিছুই কল্পনা করিতে পারে না।

তুমি হয়তো আমাকে বলিবে, ‘তুমি আমার দাদামহাশয় বলিয়াই যে তুমি আমার চেয়ে বড়ো এমন কোনো কথা নাই।’ আমি তোমার চেয়ে বড়ো নই! তোমার পিতা আমার স্নেহে পালিত হইয়াছেন, আমি তোমার চেয়ে বড়ো নই তো কী? আমি তোমাকে স্নেহ করিতে পারি বলিয়া আমি তোমার চেয়ে বড়ো, হৃদয়ের সঙ্গে কল্যাণ কামনা করিতে পারি বলিয়াই আমি তোমার চেয়ে বড়ো। তুমি না হয় দু’পাঁচখানা ইংরাজি বই আমার চেয়ে বেশি পড়িয়াছ, তাহাতে বেশি আসে যায় না। আঠারো হাজার ওয়েবস্টার ডিকসনারির উপর যদি তুমি চড়িয়া বস তাহা হইলেও তোমাকে আমার হৃদয়ের নিচে দাঁড়াইতে হইবে। তবুও আমার হৃদয় হইতে আশীর্বাদ নামিয়া তোমার মাথায় বর্ষিত হইতে থাকিবে।

পুঁথির পর্বতের উপর চড়িয়া তুমি আমাকে নিচু নজরে দেখিতে পারো, তোমার চক্ষের অসম্পূর্ণতাবশত আমাকে ক্ষুদ্র দেখিতে পারো, কিন্তু আমাকে স্নেহের চক্ষে দেখিতে পারো না। যে ব্যক্তি মাথা পাতিয়া অসংকোচে স্নেহের আশীর্বাদ গ্রহণ করিতে পারে সে ধন্য, তাহার হৃদয় উর্বর হইয়া ফলে ফুলে শোভিত হইয়া উঠুক। আর যে ব্যক্তি বালুকাস্তূপের মতো মাথা উঁচু করিয়া স্নেহের আশীর্বাদ উপেক্ষা করে সে তাহার শূন্যতা, শুষ্কতা শ্রীহীনতা- তাহার মরুময় উন্নত মস্তক লইয়া মধ্যাহ্নতেজে দগ্ধ হইতে থাকুক। যাহাই হউক ভাই, আমি তোমাকে একশো বার লিখিব ‘পরমশুভাশীর্বাদরাশয়ঃ সন্তু’। তুমি আমার চিঠি পড় আর না পড়।’

তাহলে এখানে কী দেখতে পেলাম? রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছিলেন, আগামী দিনগুলোতে এমন এক সময় আসবে, ছোটরা বড়দের যথোপযুক্ত সম্মান করবে না, ভক্তি করবে না, শ্রদ্ধা করবে না। বড়দের ভক্তি শ্রদ্ধা করতে লজ্জাবোধ করবে। তারা মনে করবে বড় হলেই কী তাকে শ্রদ্ধা আর ভক্তি করতে হবে এমন তো কোনো কথা নয়? দিন দিন যে বড়দের প্রতি ছোটদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা কমতে থাকবে তা রবীন্দ্রনাথ ভালো করে অনুধাবন করেছিলেন বলেই তা লিখে গেছেন। তিনি সামগ্রিক বিষয়টিই আমাদের বলে দিয়ে গেছেন। যখন সমাজের বিভিন্ন স্থানে যাওয়া যায় এবং সমাজের দিকে তাকানো যায় তখন সেই চিত্রটিই নজরে পড়ে। আজকের মানুষ যেন সহজে মস্তক অবনত করতে চায় না। তারা মনে করে মাথা নত করলেই সে ছোট হয়ে যাবে। এই হলো আজকের দিনের ছোটদের মনোভাব।

এধরনের মন-মানসিকতা অনেকের মাঝেই দেখা যায়। মান্য-মানবতার জ্ঞান আজ অনেকেরই উঠে গেছে। আগের দিনের বাল্যশিক্ষার সেই ন্যূনতম শিক্ষাও আজ অনেকের মধ্যে নেই বলে আমার ধারণা। সেই বাল্যশিক্ষার কিছু কিছু উপদেশমূলক বাক্যের উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে। সেই বইটির যে কতগুলি বাক্য শিশুদের শেখানো হতো যা মানুষের সারা জীবনই কাজে লাগত। যেমন ধরুন- গুরুজনে ভক্তি কর; বিপদে অধির হওয়া কাপুরুষের লক্ষণ; শঠের প্রলোভনে মুগ্ধ হইও না; নিয়ম লঙ্ঘন করিও না; দোষ করিলে লজ্জিত হইবে; জ্ঞানলাভ সকলের বাঞ্ছনীয়; প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করিবে; দম্ভ করা অনুচিত; কদাচ অসৎ কল্পনা করিও না; কুবিষয়ে লিপ্ত হইও না ইত্যাদি।

এসব শিক্ষা-দীক্ষা একজন মানুষের সারা জীবনই প্রয়োজন- তা কখনো অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেসব শিক্ষা আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। স্কুল বলেন, কলেজ বলেন এমনকি পরিবার বলেন। আজকাল বাল্যশিক্ষার এসব নীতিবাক্যের চর্চা কোথাও হয় কিনা জানা নেই। শিশুদের আদর্শ মানুষ করতে হলে তাকে আগে থেকেই এসব আদর্শগত শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। আদর্শগত শিক্ষা পেলেই তো তারা আদর্শ মানুষ হয়ে উঠবে। আর বড় হয়ে সেইভাবে আচরণ করবে। আজকাল আমরা অনেকেই সেই আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছি তা অস্বীকার করা যায় না। তাহলে আমার সন্তানকে কীভাবে আদর্শ মানুষ করে গড়ে তুলব?

ছোটদের কীভাবে আদর্শগত শিক্ষা দেওয়া যায় তা-ও কবিগুরু আমাদের বলে গেছেন। চিঠিতে নাতিকে লিখছেন- ‘তুমিও যখন আমার চিঠির উত্তর দেবে, প্রণামপূর্বক চিঠি আরম্ভ করিয়ো। তুমি হয়তো বলিয়া উঠিবে, ‘আমার যদি ভক্তি না হয় তো আমি কেন প্রণাম করিব? এসব অসভ্য আদব-কায়দার আমি কোনো ধার ধারি না।’ তাই যদি সত্য হয় তবে কেন ভাই, তুমি বিশ্বসুদ্ধ লোককে ‘মাই ডিয়ার’ লেখ। আমি বুড়ো তোমার ঠাকুরদাদা, আজ সাড়ে তিন মাস ধরিয়া কাশিয়া মরিতেছি, তুমি একবার খোঁজ লইতে আস না। আর, জগতের সমস্ত লোক তোমার এমনি প্রিয় হইয়া উঠিয়াছে যে তাহাদিগকে ‘মাই ডিয়ার’ না লিখিয়া থাকিতে পারো না। এও কি একটা দস্তুর মাত্র নয়? কোনোটাই বা ইংরাজি দস্তুর, কোনোটা বাংলা দস্তুর। কিন্তু সেই যদি দস্তুর-মতোই চলিতে হইল তবে বাঙালির পক্ষে বাংলা দস্তুরই ভালো। তুমি বলিতে পারো, বাংলাই কি ইংরাজিই কি, কোনো দস্তুর, কোনো আদব-কায়দা মানিতে চাহি না। আমি হৃদয়ের অনুসরণ করিয়া চলিব।’ তাই যদি তোমার মতো হয়, তুমি সুন্দরবনে গিয়া বাস করো, মনুষ্যসমাজে থাকা তোমার কর্ম নয়। সকল মানুষেরই কতগুলি কর্তব্য আছে, সেই কর্তব্যশৃঙ্খলে সমাজ জড়িত। আমার কর্তব্য আমি না করিলে, তোমার কর্তব্য তুমি ভালোরূপে করিতে পারো না। দাদামহাশয়ের কতকগুলি কর্তব্য আছে, নাতির কতকগুলি কর্তব্য আছে। তুমি যদি আমার বশ্যতা স্বীকার করিয়া আমার আদেশ পালন কর, তবেই তোমার প্রতি আমার যাহা কর্তব্য তাহা আমি ভালোরূপে সম্পন্ন করিতে পারি। আর, তুমি যদি বল, আমার মনে যখন ভক্তির উদয় হইতেছে না তখন আমি কেন দাদামহাশয়ের কথা শুনিব, তাহা হলে যে সকল তোমার কর্তব্যই অসস্পূর্ণ রহিল তাহা নহে, আমার কর্তব্যেরও ব্যাঘাত হয়।’

কবিগুরু কী চমৎকারভাবে আমাদের নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে বলে দিয়ে গেছেন। কিন্তু আজকাল নিজ নিজ কর্তব্য পালন করি না। আমাদের সমাজে শিষ্টাচার বিষয়টি যেন দিন দিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। যেমন ছোটরা বড়দের শ্রদ্ধা করতে অনীহা প্রকাশ করে, তেমনিভাবে বড়রাও ছোটদের ভালোবেসে কাছে টানতে পারছে না বলে আমার মনে হয়। আমার মনে হয় এই দুইয়ের মধ্যে যেন দিন দিন বড় রকমের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা যদি বড়দের শ্রদ্ধা না করি তাহলে ওই বয়স্ক ব্যক্তির কিছুই আসে যায় না। কিন্তু অন্যদের কাছে তা হবে শিষ্টাচার বহির্ভূত। এই শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ করলে এর ফলাফল কী হবে তা-ও রবীন্দ্রনাথ সুন্দর করে তার নাতিকে লিখিত চিঠিতে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।

চিঠিতে নাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- ‘সৈন্য যেমন অসংখ্য নিয়মে বদ্ধ হইয়া থাকিতে হয়, নহিলে তাহারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে পারে না, সকল মানুষকেই তেমনি সহস্র দস্তুরে বদ্ধ থাকিতে হয়, নতুবা তাহারা সমাজের কার্য পালনের জন্য প্রস্তুত হইতে পারে না। যে গুরুজনকে তুমি প্রণাম করিয়া থাক যাহাকে প্রত্যেক চিঠিপত্রে তুমি ভক্তির সম্ভাষণ কর, যাহাকে দেখিলে তুমি উঠিয়া দাঁড়াও, ইচ্ছা করিলেও সহসা তাহাকে তুমি অমান্য করিতে পারো না, সহস্র দস্তুর পালন করিয়া এমনি তোমার মনের শিক্ষা হইয়া যায় যে, গুরুজনকে মান্য করা তোমার পক্ষে অন্তত সহজ হইয়া উঠে, না করা তোমার পক্ষে সাধ্যাতীত হইয়া উঠে। আমাদের প্রাচীন দস্তুর সমস্ত ভাঙিয়া ফেলিয়া আমরা এই সকল শিক্ষা হইতে বঞ্চিত হইতেছি। ভক্তি-স্নেহের বন্ধন ছিঁড়িয়া যাইতেছে।

পারিবারিক সম্বন্ধ উল্টা-পাল্টা হইয়া যাইতেছে। সমাজে বিশৃঙ্খলা জন্মিতেছে। তুমি যে দাদামহাশয়কে প্রণাম করিয়া চিঠি আরম্ভ করা সেটা শুনিতে অত্যন্ত সামান্য বোধ হইতে পারে, কিন্তু নিতান্ত সামান্য নহে। অনেকগুলি দস্তুর আমাদের হৃদয়ের সহিত জড়িত, তাহা কতটুকু দস্তুর কতটুকু হৃদয়ের কার্য বলা যায় না। অকৃত্রিম ভক্তির উচ্ছ্বাসে আমরা প্রণাম করি কেন? প্রণাম করাও তো একটা দস্তুর। এমন দেশ আছে যেখানে ভক্তিভাবে প্রণাম না করিয়া আর-কিছু করে। আমরা প্রণাম না করিয়া হাঁ করি না কেন? প্রণামের প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, ভক্তির বাহ্যলক্ষণ স্বরূপ একপ্রকার অঙ্গভঙ্গি আমাদের দেশে চলিয়া আসিতেছে। যাহাকে আমরা ভক্তি করি তাহাকে স্বভাবতই আমাদের হৃদয়ের ভক্তি দেখাইতে ইচ্ছা হয়, প্রণাম করা সেই ভক্তি দেখাইবার উপায় মাত্র।’

এই যে প্রণাম ভক্তি ও শ্রদ্ধা ইত্যাদি মানুষের মানবিক গুণাবলি হতে সৃষ্টি হয়। মানবীয় গুণাবলিই মানুষকে সৎ চরিত্রের অধিকারী করে। মানবিক গুণে সমৃদ্ধ চরিত্রই নৈতিক মূল্যবোধের ফসল। সামাজিক জীবনে নৈতিকতার অভাব আজকের সমাজের এমন অবক্ষয় ঘটাচ্ছে তা বলাবাহুল্য। যার ফলে কেউ কাউকে মান্য করছে না, কেউ কাউকে সম্মান দেখাচ্ছে না, কেউ কাউকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করছে না। ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে অনীহা প্রকাশ করছে। অহংবোধের কারণেই আজকে সবাই নিজেকে অনেক বড় মনে করছে।

অনেককেই বলতে শুনি, আমি অমুকের চেয়ে কোন অংশে কম আছি, তাকে আবার মান্য করব, নমস্কার করব? আমাদের অনেকের মনেই এই অহংকার বিরাজ করছে। অনেকে সুশিক্ষার অভাবেই মনে করে বড়দের সম্মান বা মর্যাদা দিলে সে ছোট হয়ে যাবে। কিন্তু সে বুঝতে চেষ্টা করছে না অন্যকে মর্যাদা দিলে যে নিজেরও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অন্যকে সম্মান দেওয়ার মানে এই নয়, নিজে ছোট হয়ে যাওয়া। অন্যকে সম্মান দিলে নিজের মহত্ত্ব যে কত বেড়ে যায় সেই চিন্তা অনেকের মাঝে নেই। যার ফলে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। আর এই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সমাজে শ্রদ্ধাবোধেরও অবনতি হচ্ছে। প্রবীণদের প্রতি নবীনদের যেমন কর্তব্য আছে, তেমনিভাবে নবীনদের প্রতিও প্রবীণদেরও অনেক কর্তব্য রয়েছে। নিজেকে বড় মনে করে বসে থাকলেই চলবে না। নবীনদের মাঝে শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।

আমি প্রবীণ বলে আমাকে শ্রদ্ধা করছে না সেজন্য তাদের অপরাধী ভাবলে চলবে না। তাদের কাছে টেনে নিয়ে আসতে হবে। তাদের স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে নিজেকে শ্রদ্ধার যোগ্য করে তুলতে হবে। শ্রদ্ধার যোগ্যতায় নিজেকেও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একজন অন্যজনকে তো এমনি এমনিতেই শ্রদ্ধা করবে না। সেই দিক থেকে বিচার করলে আমাদের প্রবীণদেরও অনেক ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। নিজের মধ্যে সকল গুণের সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। নিজের মধ্যে কোনো আকর্ষণীয় গুণ থাকলে কেউ না কেউ তার মূল্যায়ন করবেই। এই প্রেক্ষিতে বলতে চাই- ফুলের সুবাস বইতে থাকলে ভ্রমর একবার না একবার আসবেই। তাই নিজেদের ফুলের সুবাসে সুশোভিত করে তুলতে হবে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সুবাস পৃথিবীর সর্বত্র প্রবাহিত হোক।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যানেজার, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিলেট।

[email protected]

 
Electronic Paper