সুখ-দুঃখের সম্মিলনে দাম্পত্যজীবন
লিটন দাশ গুপ্ত
🕐 ৩:২৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২১
যেখানে জায়া-পতি সেখানে ঝগড়াঝাটি। তাই সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তর্কবিতর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই তর্কবিতর্ক একটি সুনির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে সংসারে সমস্যা ঘনীভূত হয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। আর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেলে স্থিতিশীল কিংবা পূর্বাবস্থায় ফেরানো সম্ভব নাও হতে পারে।
গত তিন যুগেরও বেশি সময় আগে দেখেছি, সংসারে দুঃখ কষ্ট ছিল, সমস্যা ছিল, দরিদ্রতা ছিল, একান্নবর্তী পরিবারে থেকেও দাম্পত্যজীবনে বিশ্বাস, ভালোবাসা আর সুখ শান্তির অভাব ছিল না। এখন অর্থসম্পদের অভাব নেই, দরিদ্রতার দুঃখ-ক্লেশ নেই, একক পরিবারে থেকেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস আর ভালোবাসার অভাব। গত দুই দশক ধরে লক্ষ্য করছি, দিন দিন প্রায় প্রতি ঘরে দাম্পত্য কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এক-দেড় বছরে বিশ্বে বিবাহ বিচ্ছেদ সত্তর শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়া থেকে জানতে পারি।
কয়দিন আগে একটি বহুল প্রচারিত প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেখেছি, চট্টগ্রামে প্রতি ঘণ্টায় তিন জোড়া দম্পতির মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। যা কয়েক মাস আগে আমাকে আমার এক আইনজীবী বন্ধুও একথা বলেছিল। এত বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হচ্ছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দীর্ঘদিন একইসঙ্গে হোম কোয়ারান্টিনে থাকা। এই সময় ঘরবন্দি জীবনে বাধ্যতামূলক নৈকট্যের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঘরে স্ত্রীর কাজের পরিধি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল পাশাপাশি মানসিক চাপও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এখন যদিও করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কমে এসেছে, কিন্তু সৃষ্ট দাম্পত্যকলহ ধীরে ধীরে কমে আসেনি; বিপরীতে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলা যায়। এই অবস্থায় সহনশীলতার অভাবে সৃষ্ট ছোট ছোট সমস্যা বৃহৎ আকারে রূপান্তরিত হতে থাকে। এরপর ছোট একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে সৃষ্ট দাবানল যেভাবে মাইলের পর মাইল ছাইপাশে পরিণত করে, ঠিক একইভাবে সংসার জীবনে ছোটখাটো সমস্যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে থাকে।
দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিভোর্স হয় পরকীয়া, শারীরিক মানসিক নির্যাতন, মাদকগ্রহণ, যৌতুক, আদর্শিক সংঘাত, দরিদ্রতা, মতের অমিল ইত্যাদির কারণে। এখানে উল্লেখ্য, বিবিধ কারণে দাম্পত্যকলহ সৃষ্টি হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোটিপতি থেকে দরিদ্র পরিবারের দম্পতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, যৌতুকের জন্যে নির্যাতনের অভিযোগ এনে স্ত্রীর পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। আসলে পারস্পরিক মতদ্বৈততা শুরু হলে, আপন-পর সত্য-মিথ্যা হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়। তখন একদা স্বামী-স্ত্রী থাকার কথা ভুলে গিয়ে একে অপরকে পরাজিত করার প্রচেষ্টাই থাকে মূল লক্ষ্য।
ডিভোর্স বা বিচ্ছেদ মানে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে কেবল বিশেষ ছেদ নয়। এতে করে উভয়পক্ষের শারীরিক ও মানসিকভাবে ব্যাপক প্রভাব পড়ে; প্রভাব পড়ে ব্যক্তি থেকে পরিবার, এমনকি সমাজ পর্যন্ত। সন্তান থাকলে সেই পুষ্পতুল্য শিশু পরিস্ফুট হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে বৃক্ষ থেকে। অতঃপর অকালেই পরিসমাপ্তি ঘটে সম্ভাবনাময় শিশুর ভবিষ্যৎ। গভীরভাবে ভাবতে গেলে বিচ্ছেদ শব্দটি অতীব দুঃখ ও কষ্টের বিষয়। দুটি প্রাণ সুখী জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে অসংখ্য স্বপ্ন লালনপালন করে একটি সুনির্দিষ্ট বয়সে বিবাহ নামক প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়।
পরিচিত বা অপরিচিত এক নারী আর এক পুরুষ মিলে একই পথের পথিক হয় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। অগাধ আশা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে নতুন জীবনের একইসঙ্গে একই পথে চলার মাধ্যমে শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, বিবাহসূত্রে আগত নতুন সদস্য পরিবারে অভিযোজিত হতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। তখন ক্ষুদ্রতম বিষয়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যা বৃহত্তম পর্যায়ে রূপ নিতে থাকে। অতঃপর একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায় দাম্পত্যজীবন, শেষপর্যন্ত পরিসমাপ্তি ঘটা ব্যতীত বিকল্পপথ থাকে না।
দাম্পত্যজীবন মানে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সম্মিলন। তাই প্রায় সব পরিবারে সুমধুর দাম্পত্য সম্পর্কের পাশাপাশি মাঝে মধ্যে কিছু মনোমালিন্যের ঘটনা ঘটে থাকে। যা দাম্পত্য জীবনকে আরও মধুময় করে তোলে। তবে সেই মনোমালিন্য পরিমিত না হয়ে, নিয়মিত ও দীর্ঘস্থায়ী হলে সংসার তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। কারণ সবসময় ঝগড়া-বিবাদ চলতে থাকলে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক অবিশ্বাস আর সাংসারিক সংঘাত। এই সংঘাত একটি নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে গেলে, দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাই মনে রাখতে হবে, সংসারে নিত্যনৈমিত্তিক ছোট-বড় অনেক ঝামেলা উদ্ভব হবে।
সেই জোয়ারে হোক আর ভাটায় হোক, উত্তাল তরঙ্গের সংসার সাগর পাড়ি দিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে একসঙ্গে বৈঠা ধরতে হবে। সুখে-দুঃখে যে কোনো সময় যে কোনো সমস্যা, ইতিবাচক দৃষ্টিতে দুজনকে স্বপ্রণোদিতভাবে সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে। একে অপরের পাশে থেকে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিত্য সহচর হতে হবে। এখানে ধৈর্যচ্যুত না হয়ে উভয়কে নিজ থেকে দক্ষতার সঙ্গে সমস্যা মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করে নিতে হবে। আর তা যদি না হয়, জায়া-পতির মধ্যে একটি ছোট সমস্যা বহুমুখী রূপ নিয়ে বৃহৎ পর্যায়ে চলে যাবে। আর বৃহৎ পর্যায়ে চলে যাওয়া মানে একদিন আনন্দঘন উৎসবের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত পরিণয়ের শেষ পরিণতি বিবাহবিচ্ছেদ।
লেখক: শিক্ষক ও কলাম লেখক
[email protected]