মজিদ মাহমুদ-এর কবিতায় বঙ্গবন্ধু
বঙ্গ রাখাল
🕐 ১২:৪৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৬, ২০২১
স্মৃতির জগত হাতড়ে আমার শৈশবে যে নাম,
বজ্রকণ্ঠে জানান দিলেন কোথায় আমার ধাম।
সেদিন থেকে খুঁজে নিলাম নিজের বাড়ির পথ,
তিনিই আছেন সবার আগে যতই থাকুক মত।
হয়তো আমি ঘুরছি অনেক হয়নি দিকের ভুল,
কারণ আমার লক্ষ্যে আছে দোয়েল-শাপলা ফুল।
সবাই আছে সবার সাথে একটি রঙিন খাম,
তার উপরে লেখা আছে শেখ মুজিবুর নাম।
(ঠিকানা : মজিদ মাহমুদ)
মজিদ মাহমুদ (জন্ম ১৯৬৬) সর্বাধিক আলোচিত কবি। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘মাহফুজামঙ্গল’ তিন যুগের বেশি সময় ধরে পাঠকের হৃদয় জয় করে চলেছে। তার চিন্তা-চেতনা মানেই যেন পাঠকদের নতুন নতুন ভাবনাকে উসকে দেওয়া এবং ভাবতে শেখানো। যা একজন মজিদ মাহমুদের পক্ষেই সম্ভব। সম্প্রতি পড়েছি এই কবির কিছু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা। যা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কবিতায় স্তুতি প্রকাশ না করেই তিনি সত্যকেই উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। যা একজন বীরের মধ্যে কবি দেখেছেন এবং হৃদয়ে অনুভব করেছেন। প্রকৃত নেতা কোনোদিন অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন না। প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন এবং জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ে সর্বদা সোচ্চার থাকেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনি একজন কাদা-মাটির ঘ্রাণ হৃদয়ে মেখে বড় হওয়া মানুষ। তিনি জানেন বাঙালি জাতির অবহেলা ও বঞ্চনার ইতিহাস। এ ইতিহাস হাজার বছরের-
ছাপান্ন হাজার মাইলের লম্বা সেই তর্জনি তুলে
বলেছিলেন একজন- ‘কী অন্যায় করেছিলাম?’
সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস
হাজার বছরের মুমূর্ষু নরনারীর ইতিহাস
তারপর তিনি বললেন- ‘আপনারা আসুন, বসুন’
‘তখনই তারা আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে’ পড়ল।
শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন- এই জাতি এক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। এই জাতিকে সহজে বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না। কিন্তু যাদের মাথায় মসনদের চিন্তা তারা কী করে নিজের স্বার্থ বাদ দিয়ে জনগণের মঙ্গলের কথা ভাববে? তাই তারা এই জাতিকে তাদের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ধর্মকে বেছে নেয় এবং ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করে অথচ ধর্ম কোনো দেশভাগের ভিত্তি হতে পারে না। তবুও... নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার এদেশের সহজ-সরল মানুষকে কতদিন আর দাবায়ে রাখা যায়! পেছনে পিঠ ঠেকে গেছে- প্রতিবাদ বড় প্রয়োজন। নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে। তাই তো স্বাধিকারের প্রশ্নে এদেশের মানুষ আজ প্রতিবাদী। একজন নেতা সুদূরপ্রসারী ধীশক্তির অধিকারী। শেখ মুজিব সেই বীর যিনি সুদূরের ঘটমান বাস্তবতা নিজের চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতেন। সেজন্যই শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের মঙ্গলার্থে সাবধান করে দেন-
তিনি বললেন- ‘মনে রাখবেন,
শত্রুবাহিনি ঢুকেছে,
নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে
লুটতরাজ করবে
এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান
বাঙালি নন-বাঙালি যারা আছে
তারাও আমাদের ভাই।’
চিন্তা-চেতনার দিক থেকে ছিলেন একজন গণমানুষের নেতা। তিনি কোনো একক বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর দলের ছিলেন না। তার প্রমাণ মেলে ৭ মার্চের ভাষণে। যা আমাদের সত্যি সত্যিই অবাক করে দেয়। একজন রাজনীতিবিদ কী করে এতটা নির্মোহ হতে পারেন। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এই নেতাকেই আমরা হত্যা করেছি। কবি সেই সব স্বার্থান্বেষী মনুষ্যত্বহীন পাতি নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-
যারা ধর্ষক ক্ষমতালোভী বিচারহীন এক রাজ্য চায়
তারাই তোমার হত্যাকারী তারাই তোমার ভাঙিয়ে খায়...
প্রতিটি মানুষেরই মৃত্যু অনিবার্য। আমরা সবাই এই সত্যকে মেনে নিয়েছি। তবুও কিছু কিছু মৃত্যুকে মেনে নেওয়া স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে পড়ে না। তেমনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্মই হয়েছিল বাঙালির মুক্তির জন্য। যার জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছেন বিপ্লব-বিদ্রোহ আর সংগ্রাম করে। তিনি একজন সফল সংগ্রামী বিপ্লবী নেতা। যার জন্ম না হলে এই বাংলাদেশের জন্ম হত না। তিনি মিশে আছেন বাঙালির অস্তি-মজ্জায়। কিন্তু এই মহান নেতাকেও তো আমরা হত্যা করতে পিছপা হইনি। কেড়ে নিয়েছি তার প্রাণ, সঙ্গে পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে। এমনকি ছোট্ট সোনামণি, সবার আদরের ধন রাসেলের প্রাণও। ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটির সিঁড়ি সেদিন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সেদিনও বীরদর্পে নেতা আওয়াজ তুলেছিল- মনে বল হৃদয়ে সাহস আমার বাঙালি আমার বুকে গুলি চালাবে কার আছে হিম্মত। চারিদিকে নিথর দেহের আর্তনাদ সেদিন থরে থরে কেঁপেছিল পৃথিবী। এই পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর পরিবর্তন হয় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। পালাবদল ঘটে রাষ্ট্রক্ষমতার। বদলে যায় স্বাধীন দেশের সংবিধান। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে শুরু হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যা এখনো অব্যাহত। দেশদ্রোহীরা বসেছে ক্ষমতার মসনদে। ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট শুক্রবার। ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ির প্রতিটি প্রান্তে বঙ্গবন্ধুর নিঃশ্বাসের ঘ্রাণ মিশে আছে। এই বাড়িতে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে, সঙ্গে তার পরিবারের সকল সদস্যকে। দূরে থাকায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
তোমার বিদায়ের বিশাল আয়োজন
উঠেছিল দুলে দেশি বিদেশি খুনিদের মন
গর্জে উঠেছিল সহ¯্র্র কামান মেশিন গান
স্তব্ধ হয়েছিল বায়ু
হয়তো থেমেছিল কিছুক্ষণ তোমার পাইপের টান
ছড়িয়ে পড়েছিল ধূয়ার কুণ্ডলী
রয়েছিল পড়ে খুনিদের খুলি
উঠেছিল ছাপ্পান্ন হাজার মাইলের বান
তারপর ধাতস্ত হয়ে এল সব-
কোথায় খুঁজব বলো তোমার শব
তোমার তর্জনীর স্পর্শে
বাংলাদেশ হয়েছে পীঠস্থান
তুমি মর নাই, হয়তো মরেছ
তোমায় মেরেছে যারা- এক দুই তিনজন খুনি
অতি তুচ্ছ নগণ্য তারা
তাদের এক দুই তিন করে গুনি।
সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন দেশ গঠিত হলেও বারবার সেই সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে- জিয়া, এরশাদ দেশকে ইসলামি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নিজেদের ক্ষমতার মসনদে আসীন করে- নিজের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করেছেন। জনগণকে করেছেন বিপদগামী- রাষ্ট্রদ্রোহীদের নিজেদের জোটের সঙ্গী করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জায়গাকে করেছেন শক্ত।
স্বাধীন দেশের অর্থনীতি সমাজতন্ত্র লাল সালাম
ভাবতে ছিলে হয়তো তুমি কৃষক-শ্রমিক নয় গোলাম
কিন্তু যারা স্বার্থন্বেষী দেশ বিদেশে হারাম খোর
তোমায় নাশে জোট বাঁধত ভদ্রবেশি সকল চোর...
একজন জাদুকরী ভাষার মহান মানুষের আহ্বানে এক হয়েছিল দেশের সর্বস্তরের মানুষ। যাকে আমরা জনযুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয় চারটি মূল আদর্শের ভিত্তিতে। যেখানে গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রই একমাত্র মন্ত্র। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশ শিড়দাঁড়া টানটান করে দাঁড় করে রেখেছিল এই চার স্তম্ভের উপরে। কিন্তু এদেশের গণতন্ত্রের স্তম্ভ ধ্বংস হয়েছে বারবার। অগণতান্ত্রিক উপায়ে অনেকে ক্ষমতার আসনে সওয়ার হয়েছেন। এসময় পরিবর্তনের পরিক্রমায় লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হয়েছে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। দেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গঠিত হলেও- দেশের মুসলমান বা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান একত্রিত হওয়ার মাধ্যম ছিল ভাষার পরিচয়। এই একই ভাষিক পরিচয়ের মানুষকে কোনো আন্দোলন সংগ্রাম থেকে কখনো আলাদা করা যায়নি। কিন্তু বারবার তাদের একত্রিত থেকে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ। যে দেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও স্বস্তি পায়নি। কেননা একটি বিপ্লবের নাম বঙ্গবন্ধু, একটা বিদ্রোহের নাম বঙ্গবন্ধু কিংবা একটা চেতনার নাম বঙ্গবন্ধু। তাকে ঢাকায় কোথাও সমাধিস্ত করা যাবে না। তাকে মাটি দেওয়া হয় টুঙ্গিপাড়ায় মা-বাবার কবরের পাশে। ৫৭০ সাবান, কাফনের কাপড় ও অন্যান্য জিনিস গ্রামের মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। কতটা অবিবেচক ঘাতক হলে এই জাতির স্বপ্নদ্রষ্টাকে এমন অবহেলা করতে পারে। অথচ পরিবারের অন্য সদস্যদের বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। যে আলো-বাতাসে একজন বীরের জন্ম সেই মাটিতেই রাখা হল তাকে। এ যেন প্রজ্জ্বলিত প্রদীপে নতুনভাবে দম দিয়ে ছেড়ে দেওয়া। যা জ্বলবে নতুন উদ্যমে নতুন শক্তিতে। এজন্যই মজিদ মাহমুদ আবার এই বর্তমান সময়ে সেই অতীত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য কবিতায় বললেন-
বিপদ-সঙ্কুলে লড়াই-সংগ্রামে তুমিই সাহস
তোমার বাঁচা ও আত্মদান দেশের জন্য
মৃত্যু তোমাকে চিরঞ্জীব করেছে
একটি জাতি তোমার নামে চিহ্নিত
তুমি যেমন অতীতে, তেমন শত বছরে
সহ¯্র বছরেও স্পর্শ করবে না মলিনতা
কারণ তুমিই জাতির পিতা।
মজিদ মাহমুদ এই মহান বীরের বীরত্ব পরিবারের মানুষের মুখে শুনে শুনে বড় হয়েছেন কিংবা পরিবারের ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা এই ১৯৭১ সালের অবরুদ্ধ সময়ে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী জীবনযাপন তার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। নিজের বাড়ির ভস্মিত ছাই চোখের সামনে উড়তে দেখেছেন। যে কারণে হৃদয়-অভিঘাতে পরবর্তীকালে লিখলেন মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীনির্ভর কবিতা- বাবা। কবিতাটি কবির ‘বল উপাখ্যান’ (২০০০) কাব্যের অর্ন্তভুক্ত রয়েছে।
হানাদারের আঘাত সয়ে ভাইয়া যখন চলে গেলেন
বাড়ির সবাই কাল বোশেখি ঝড়ের মতো
দমকা দমকা মুর্ছাহত
বাবা তখন আদর করে ভাইয়ার গালে চুমু খেলেন
কত দিনেই ঝড় বয়েছে
ঘর ভেঙেছে...
মুজিব মানে একটি স্বদেশ একটি মানচিত্র একটি লাল-সবুজ সম্বলিত পতাকা। মজিদ মাহমুদ একজন প্রকৃত বীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘সর্বাধিনায়ক’ কবিতায় বলছেন-
ঈষাণ কোণে মেঘ, আম্রবাগানে নামে সন্ধ্যা
বরফে আচ্ছাদিত ওয়াটার লু, দ্যাখে
পরাজয়ের চিহ্ন; মৃত্যু, তবু প্রকৃত যোদ্ধা
পায় না ভয়- তার পশ্চাতে সমুদ্র
সম্মুখে শত্রুর তরবারি
সবখানে মৃত্যু ওত পেতে আছে-
তাই শুনতে পাই বিস্তীর্ণ ময়দানে তোমার কণ্ঠ
শত্রুর মোকাবেলায় ওঠো জেগে
‘মারো না হয় মরো’
মৃত্যুময় পৃথিবীতে কীসের ভয়
কাকে বলে পরাজয়...
শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক কবি। যাকে আমরা আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকি। যার মায়াময় চেহারা আর হৃদয়কাড়া কণ্ঠে বিমুগ্ধ করেছিল এদেশের মুক্তিপাগল জনগণকে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন এদেশের মুক্তি পাগল জনগণ। এই মন্ত্রীয় ডাক তো একজনই দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের জাতির পিতা। এই পিতার মৃত্যু নেই। তিনি কাল হতে কালান্তরে জাগ্রত জনগণের হৃদয়ের চিলেকোঠায়। তাই তো কবি বলছেন-
জেনে রেখো আমাদের সেনাপতির মৃত্যু নেই
পলাশির প্রান্তর থেকে আগরতলা
রেসকোর্স ময়দানে তিনিই তো করেছিলেন
তোমাদের ঘরের বাহির-
যার যা আছে তাই নিয়ে থাক প্রস্তুত।
বাঙালি জাতি এখন অবহেলিত তলাহীন ঝুড়ি নয়। বিশ্বের মাঝে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিত হয়েছে। যে বীর এই জাতিকে বিশ্বের মাঝে সম্মানিত জাতিতে পরিণত করলেন- তিনি কোনো রূপকথার বীর পালোয়ান নন। রক্ত-মাংসেরই মানুষ। জাতির পিতা, আমাদের মহান নেতা- শেখ মুজিব।
শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রে মানুষ নিজের বেঁচে থাকায় অধিকার পাবে। যোগ্য মানুষ পাবে সম্মান। কিন্তু আজ সেই বীর বাঙালির অবস্থা সত্যিই করুণ। পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র শ্মশান- স্বার্থান্বেষী মানুষ আজকে পিতা তোমাকে নিয়ে ভাঙিয়ে খাচ্ছে- নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য প্রকৃত প্রেমিককে বিপদে ফেলতেও যে কুণ্ঠাবোধ করছে না। যারা একদিন এই মহান নেতার বিরোধিতা করেছে তারা আজ বড় দেশপ্রেমিক হয়ে নিজেকে পিতার যোগ্য প্রেমিক সাজিয়ে অপরাজনীতিতে নিজেদের সামিল করেছে, তাদের উদ্দেশ্যে কবির স্পষ্ট বক্তব্য-
ব্যাংকে টাকা লুটছে যারা শেয়ারবাজার করছে মাত
তুমি তাদের করো না ক্ষমা তুমি থেক না তাদের সাথ
যারা ধর্ষক ক্ষমতালোভী বিচারহীন এক রাজ্য চায়
তারাই তোমার হত্যাকারী তারাই তোমায় ভাঙিয়ে খায়
নিজের দেশের অর্থনীতি অন্য দেশে করে পাচার
সে-সব মানুষ তোমার নামে ফন্দি আঁটে পিঠ বাঁচার
গর্জে ওঠো আবার পিতা তর্জনীর ওই ইঙ্গিতে
ভয় ধরে যাক কাঁপন উঠুক লুটেরাদের সঙ্গীতে
এই সব অন্যায় আর অসাম্যের কর্মযজ্ঞের বিরুদ্ধে পিতা স্বর্গ থেকেই চেঁচিয়ে ওঠেন- তিনি যাদের ভালোবেসে নিজের একান্ত কাছের মানুষ করেছিলেন তারাই তো ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করেন। কিন্তু এই জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তার স্বপ্ন আশাকে তারা হত্যা করতে পারেনি। তার শরীরের লয় হলেও স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ শত বাধার মধ্যেও নিজের অস্তিত্বকে জানান দিয়েছে। এ যেন জাতির পিতার শোকেরই শক্তিতে পরিণত হওয়ার পূর্ণরূপ।
এই কবির কবিতা বিবেচনা করলে বলা যায়, তিনি একটি রাষ্ট্রের রক্তাক্ত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যা বর্তমান কোনো ক্ষমতাবান, রাজনৈতিক, ব্যক্তিও এই তীব্র কটাক্ষতা থেকে রক্ষা পান না। আজ সত্যিই আশ্চর্য হতে হয় যে কবি বঙ্গবন্ধুকে কতটা হৃদয়ে ধারণ করলে এমন দৃশ্যকল্পের সৃষ্টি করতে পারেন।
কেবল একটি তর্জনী তখন মাস্তুলের মতো
নৌকার পালে বাতাস লাগিয়ে ছুটতে লাগল
আর পানির গভীরে দিশা হয়ে থাকল অনড়
এই আঙ্গুল যতদিন থাকবে মাঝিদের মনে
এই আঙ্গুল যতদিন স্থির থাকবে সর্বোচ্চ সম্মানে
ততদিন যাত্রীরা খুঁজে পাবে গন্তব্যের পথ।
সর্বোপরি বলতে পারি কবি মজিদ মাহমুদকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দারুণভাবে আন্দোলিত, মথিত এবং আবেগ আপ্লুত করেছেন- যে কারণে তিনি অভিঘাতে জন্ম দিয়েছেন একের পর এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী কবিতা। এ কবিতা সত্যিই অন্যদের থেকে আলাদা এক ইতিহাসকে সম্মুখে হাজির করে। ভাবিত করে, জাগ্রত করে আমাদের ঘুমন্ত সত্তাকে।
বঙ্গ রাখাল : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক