রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : একজন শব্দশ্রমিক
রহিম ইবনে বাহাজ
🕐 ১২:৪০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৬, ২০২১
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলাদেশের কবিতায় বহু উচ্চারিত নাম। তারুণ্য যদি জীবনের গতিময়তার প্রতীক হয় আর কবিতা যদি হয় সেই প্রতীকের শিল্পিত প্রকাশ, তা হলে সেই ভূমিকায় রুদ্র’র পরিচয় নিজে। রুদ্র’র কবিতা যারা মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছেন কিংবা করবেন, তারা এটা অবশ্যই লক্ষ করবেন, যে কেন্দ্র হতে তার অভিযাত্রা সূচনা বহুপথ ঘুরে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জীবনের স্বপ্ন ও সংগ্রাম, প্রেম ও বিরহবন্ধন ও বিচ্ছেদ সবকিছুর মধ্যে ও কেন্দ্রাতি সংলগ্নতা হতে সে বিন্দুমাত্রও বিচ্যুত হয়নি। পথ চলতে বারবার হোঁচট খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে অসুন্দরের প্রলোভনে সমর্পিত হয়ে ও সে কখনো আত্ম বিক্রীত ক্রীতদাসে পরিণত হয়নি।
রুদ্র’র কবিতার প্রধানপ্রবণতা দ্রোহ। বাংলা কবিতার এক অন্যতম ধারার প্রতিনিধি হিসেবে এর উত্তরাধিকার বহন করতে গিয়ে রুদ্র কখনো কখনো উচ্চকিত রূঢ় কণ্ঠের ধারক হওয়া সত্ত্বেও কবিতার শৈল্পিক অঙ্গীকার সে অস্বীকার করেননি।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে কাজ সমাজকর্মীর যে কাজ রাজনীতিকদের এদেশের সেই কাজটির সাহসী সূচনা সবসময়ই করতে হয়েছে কবিদের। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এই দাবি তীব্র হওয়ায় কবিদের ওপর সে গুরুভার অর্পিত হয়েছে তার বোঝা কাঁধে নিতে যে কজন কবি সামনের কাতারে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ অন্যতম। সে কারণেই রুদ্রর কবিতা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে শুধু কণ্ঠস্বর, শুধু স্লোগান। রুদ্র নিজেও এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন ছিলেন। তাই ধীরে ধীরে সে নিজেকে সংযত ও সংযমী করে তোলার কাজে নিয়োজিত হয়ে ছিল কিন্তু পরিণত হওয়ার আগেই অকালমৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে যাওয়াতে সেই কর্মোদ্যোগ সফল করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না আমরা বঞ্চিত হলাম। সম্ভাবনাময় এক তরুণ কবির পরিণত প্রয়াসে শিল্পিত ফসলের আস্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ থেকে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা রচনার সূচনা স্কুলজীবন থেকে শুরু হলেও মূলত পঁচাত্তর সালের পরেই তার সরব উপস্থিতি বাংলাদেশের কবিতার ভুবন উচ্চকিত করে তোলে। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতাপ্রিয় করে তোলে রুদ্র তাদের অন্যতম। রুদ্রর অনেক কবিতাই এই শ্রোতাদের লক্ষ্য করে লেখা। তাই তার কবিতার অনেকগুলোই মঞ্চসফল।
রুদ্রর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল সে কারণে সে কখনো পরাজিত হতে চায়নি জীবন মানে সংগ্রাম, জীবন মানে দু’পা পিছিয়ে আবার চার পা এগিয়ে যাওয়া এই বিশ্বাসের জোরেই এগিয়ে যেতে পেরেছেন। রুদ্রর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সম্ভবত এই, তিনি এদেশের আত্মাকে ভালোবাসেন। এটাকে শুধু দেশপ্রেম বলা যায় না, একে বলা যেতে পারে মাতৃপ্রেম। সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বস্ত কবিদের অন্যতম। ‘আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই’ কিংবা ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছ সেই পুরনো শকুন’ এই দুই বিখ্যাত কবিতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতি তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাতে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছেন। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক, স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে রুদ্র’র কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। এই উচ্চকিত কণ্ঠের কবিতাসমূহের অধিকাংশই সফল কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু সমাজের দাবি মিটিয়েছে এবং সময়ের দাবি মিটিয়েছে। বাংলা কবিতার বিচারে এমনকি বাংলাদেশের কবিতার বিচারে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অবস্থান কোথায়, তা বিচার করবে সময়। সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নিজেকে সবসময় দাবি করেছেন শব্দশ্রমিক হিসেবে, কবি দাবি করেননি।
শব্দ-শ্রমিক
আমি কবি নই- শব্দ-শ্রমিক।
শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই
ভুল বোধে ভুল চেতনায়
হৃদয়ের কালো বেদনায়।
রুদ্রর গানের সংখ্যা হয়তো বেশি নেই। কিন্তু যে গানটি বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়, শীর্ষে রয়েছে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে, অ্যান্ড্রু কিশোর দরাজ ভরা কণ্ঠে ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ ঠোঁট মিলিয়েছেন ‘তোমাকে চাই’ সিনেমায়। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বেঁচে থাকতে ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তার জন্ম ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে, বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে। শৈশব কেটেছে মিঠেখালি গ্রামে ও মোংলায়। ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি, ১৯৭৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮০ ও ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় সম্মান এবং এমএ পাস করেন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯), ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১), মানুষের মানচিত্র (১৯৮৪), ছোবল (১৯৮৬), গল্প (১৯৮৭), দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮) ও মৌলিক মুখোশ। ২৯ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে বিয়ে করেন লেখক তসলিমা নাসরিনকে। ১৯৮৮ সালে সাত বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টানেন। ১৯৯১ সালে ২১ জুন এই শব্দশ্রমিক ও প্রতিভাবান তরুণ কবি অকালে মারা যান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যুগের পর যুগ বাঙালি জাতি স্মরণ করবে শব্দশ্রমিক রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে।
রহিম ইবনে বাহাজ : কবি ও কলাম লেখক