সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দূর হোক বাল্যবিয়ের অভিশাপ
জামাল জিলানী
🕐 ১২:৫৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৫, ২০২১
‘রইল বাকি এক’, ‘ছাত্রীর সন্তান কোলে নিয়ে শিক্ষকের পাঠদান’, ‘ঠেকানো যাচ্ছে না বাল্য বিবাহ’সহ নানা শিরোনামে প্রকাশিত হচ্ছে বাল্যবিবাহের সংবাদ। বাল্যবিবাহ হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ। আজকাল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উদ্যোগ গ্রহণ করেও ঠেকানো যাচ্ছে না। বর্তমান বিশে^ বাল্যবিবাহ নারীদের জন্য একটি চরম অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ অভিশাপ থেকে আমাদের দেশের নারীরা এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বাল্যবিয়ে পরবর্তী জীবনে নেমে আসছে নানা বিড়ম্বনা। এতে মামলা-মোকদ্দমা, অর্থবিনষ্ট, সামাজিক অবক্ষয় ও অকালমৃত্যু লেগেই আছে। দেশে আইন আছে ১৮ বছরের নিচে নারীদের বিয়ে দেওয়া অপরাধ। তবুও দেশে অবাধে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে সংঘটিত হচ্ছে। বিয়ে হচ্ছে ১৩/১৪ বছরের বালিকাদেরও।
বিয়ের মাধ্যমে জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বাল্যবিবাহের নানাবিধ কারণও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দারিদ্র্য। কম বয়সে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রচলিত সামাজিক প্রথা, যৌতুক প্রথা, মেয়েশিশুর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অজ্ঞতা, পারিবারিক ওয়াদা পূরণ, সচেতনতার অভাব, কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা। এগুলো প্রথম বিষয়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, করোনাকালে লকডাউনে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় মেয়েশিশুদের বোঝা মনে করা। আর এসবের মূলে হচ্ছে, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া।
বাস্তবে আমাদের দেশে কোনো কোনো শিশুর এত অল্প বয়সে বিয়ে হয় যখন তাদের কাছে বিয়ের অর্থই পরিষ্কার থাকে না। বিশেষ করে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক পূর্ণতা প্রাপ্তির আগেই বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। বাল্যবিবাহের খেসারত ছেলেমেয়ে উভয়কে দিতে হলেও মেয়েদের জীবনে এর কুফলের পরিধি ও মাত্রা ভয়াবহ এবং ব্যাপক। বাল্যবিবাহের মধ্য দিয়ে মেয়েশিশু বা কিশোরীকে এক ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্দশাগ্রস্ত দাম্পত্য জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। অল্প বয়সী মায়েরাই বেশি মাতৃমৃত্যুর শিকার হয়। জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ নারী সংসারে নানাভাবে নির্যাতিত হয়। তার শিক্ষা ও দক্ষতা লাভের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। জীবিকার সংগ্রামে পিছিয়ে পড়ে নারী। দক্ষ শ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয় পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা প্রয়োজন।
দেশের কিশোরীদের প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশই অপুষ্টির শিকার। বিয়ের পরই স্বামী ও অন্যরা সন্তানের মুখ দেখতে চায়। এক বা দুই বছরের মধ্যে সন্তান না হলে স্বামী যদি বংশরক্ষার জন্য আবার বিয়ে করে ফেলে, সেজন্য মেয়ের বাড়ি থেকেও সন্তান নেওয়ার জন্য মেয়েটিকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু এই অপুষ্ট মা কম ওজনের সন্তানের জন্ম দেয়। নবজাতক মারা যায় কিংবা মারা না গেলেও মা ও সন্তানের অসুখ লেগেই থাকে। চিকিৎসার খরচ, পরিবারের লোকজনের কাজ কামাই দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি শুরু হয়। এতে নেতিবাচক অবস্থা চলতেই থাকে পরিবারটিতে। ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মেয়েদের বাল্যবিবাহের কারণে বছরে দুই লাখ শিশুর জন্ম হয় স্বল্প ওজন ও মারাত্মক অপুষ্টিতে মায়েরও স্বাস্থ্যহানি ঘটে। আইনত বিয়ের বয়স ১৮ বছর, বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে। বাল্যবিবাহ শুধু মায়ের স্বাস্থ্যই না বরং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের অপরিণত সন্তান জন্মদান বা কম ওজনের সন্তান জন্মদানের আশঙ্কা ৩৫-৫৫%। তাছাড়াও শিশু মৃত্যুর হার ৬০% যখন মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে। যেসব নারী কম বয়সে শিশুর জন্ম দেয় ওইসব শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয় ও শিশু অপুষ্টিতে ভোগার আশঙ্কা বেশি। বাল্যবিবাহের প্রাদুর্ভাবের কারণে জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পায়।
অল্প বয়সে বিয়ে এবং মা হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়াসহ জরায়ুতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা। অন্যদিকে আবার সন্তান লালন-পালন সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনের আগেই বাল্যবিবাহ হলে সন্তনেরা মায়ের সঠিক পরিচর্যা থেকেও বঞ্চিত হয়। বাল্যবিবাহ স্কুলে যাওয়ার উপযোগী সন্তানদের শিক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। অথচ এই শিক্ষাই মানবসম্পদ হওয়ার প্রতি গ্রহনের জন্য একটি খুবই জরুরি চাহিদা। বাল্যবিবাহের ফলে বিশেষ করে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
মেয়েশিশুদের ব্যক্তিগত বিকাশ বা উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে ফেলে বাল্যবিবাহ। আর এ বঞ্চনার ফলে অবশেষে সমাজ ও পরিবার মেয়েশিশুদের ভবিষ্যৎ সৃষ্টিশীল অবদান থেকে বঞ্চিত হয়। বাল্যবিবাহ মেয়েদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যেরও হানি করে। অন্যদিকে বালিকারা তাদের যৌন ও প্রজনন অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়। বাল্যবিবাহের কবলে পড়া মেয়েকে পারিবারিক নির্যাতনের দুর্ভোগও পোহাতে হয় অনেক বেশি। বিশেষ করে নারীদের নতুন মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। যা বেশির ভাগ মেয়ে অনুভব করে। জন্ম নেয় কিছু চাপ ক্ষোভ। বিয়ে মানে নতুন কিছু পরিবর্তন ও সমঝোতা। কিন্তু এটা যদি সব সময় এক পক্ষেই করতে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে মনোমালিন্য ঘটে। অল্প বয়সী মেয়ে সংসার জীবনে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে মাথা গরম হয়ে যায়। শুরু হয় ঝগড়া-বিবাদ, এর মধ্যে গর্ভে সন্তান। বিবাহিত দম্পতি নতুন অতিথির আগমন ঘটাবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু অন্যের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে নয়। পুরোপুরি যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে দিলে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেক সময় সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। অনেকে সন্তান প্রসবের আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
প্রজনন ক্ষমতা পুরোপুরি পরিপক্ব না হওয়ার কারণে অল্পবয়সী মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারের পিতা-মাতা মেয়েদের ভরণ-পোষণ করতে না পেরে তাদের অল্পবয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। অনেক সময় বখাটে তরুণ সমাজের লোলুপ দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অসহায় বাবা-মা অল্পবয়সে তাদের মেয়েদের বিয়ে দেন। সচেতনতার অভাবও বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ। দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বাংলার মানুষকে রক্ষা করা, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। বাল্যবিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি মারাত্মক সমস্যা। ইউনিসেফের শিশু ও নারী বিষয়ক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের ৬৪% নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। আমরা যদি সবাই সচেতন হই তাহলে কন্যা শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।
দেশে মা ও শিশুর অকাল মৃত্যুরোধ করা সম্ভব হবে। তাই বাল্যবিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এখন থেকেই। বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক অন্যায়, একে প্রতিহত করি, এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। আইনে জানতে পারি, বাল্যবিবাহে সম্মতি দিলে অভিভাবকরা দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। অথবা পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে কিংবা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারে। শিশুকে বিয়ে করার অপরাধে নারী ও পুরুষ উভয়কেই একই শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না বিয়ে পরিচালনাকারীরাও। এমন বিধান রেখে ১৯২৯ সালের বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৪’ এর খসড়া করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। তা বাস্তবায়ন করতে হবে সংশ্লিষ্ট দফতরকে। কথা উঠেছে, এফিডেভিট করে বিয়ে দেওয়ার বিষয়ে। অনেক সাধারণ অভিভাবক এলাকার নাম মাতব্বর ধরনের লোকের পাল্লায় পড়ে ছেলেমেয়ের বয়স বাড়িয়ে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিবাহ দিচ্ছেন এবং পরে সামাজিকতা রক্ষায় মৌলভী দ্বারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করছেন।
আমার মতে, নতুন আইনে আরও কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে সামাজিক সচেতনতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব ও পরিধি বাড়াতে হবে। সরকার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সকল গণমাধ্যমের সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানগণকে যুক্ত করতে হবে। জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্তকর্তা বা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়াসহ প্রশাসনের মোবাইল নম্বর উন্মুক্ত করতে হবে।
গ্রাম, পাড়া, মহল্লায় স্থানীয়ভাবে বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি করতে হবে, যা স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক স্বীকৃতি দিতে হবে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এ কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে হবে। বিশেষ করে বিবাহের এভিডেভিটের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বয়স নির্ধারণে সচেতন হতে হবে। অথবা বিবাহের এফিডেভিট বন্ধ করতে হবে। এছাড়া গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক, গম্ভীরা, ক্ষুদ্র মঞ্চনাটক-নাটিকা, সচেতনতামূলক লিফলেট ও হ্যান্ডবিল বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সকলে এগিয়ে এলে বাল্য বিবাহের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।
জামাল জিলানী : কলাম লেখক, দিনাজপুর