আধ্যাত্মিক বিপ্লবী সারোয়ার হোসেন
সাজেদ রোমেল
🕐 ১২:০৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১
সত্তরের দশক, ছায়াঘেরা ময়মনসিংহের শহরতলী আকুয়া মোড়লবাড়ির পুরো বাসাটা ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। বাসাটি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বাসা। কর্মকর্তার ছেলে হোসেনকে খুঁজছে পুলিশ। টিনের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন পুলিশের দলনেতা। দরজা খুলে দাঁড়ালেন সৌম্য চেহারার একজন মা। সোজা পুলিশ কর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাকে চান?
পুলিশের দলনেতা বললেন, এখানে সারোয়ার হোসেন থাকেন?
ব্যক্তিত্ববান মায়ের জবাব, হ্যাঁ হোসেন এখানেই থাকেন। আপনারা কী চান?
জবাব এলো, আমরা তাকে গ্রেফতার করতে এসেছি।
মায়ের চোখ এবার সরাসরি পুলিশ কর্তারা চোখে। সে চাহনি এতই ভার, পুলিশ কর্তা ভড়কে গেলেন। তারপর মা বললেন, আমার ছেলের অপরাধ কী?
পুলিশ কর্তার জবাব, তিনি পার্টি করেন।
মায়ের জবাব, পার্টি করলে কী সমস্যা?
পুলিশ কর্তা বললেন, উনি সর্বহারা পার্টি করেন। এটা নিষিদ্ধ দল।
এবার মায়ের কঠোর চাহনি। বললেন, ওয়ারেন্ট আছে?
পুলিশ কর্তা নয়, পুরো দলটি কঠোর মায়ের কাছে আর জবাব দিতে পারলেন না। চলে গেলেন হোসেনকে গ্রেফতার না করেই।
বাবা সরকারি বড় চাকরি করেন, সারোয়ার হোসেনের ভাইদের কেউ উকিল, ডাক্তার, কেউ সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু সারোয়ার হোসেন এর কোনো কিছুই হলেন না। তিনি হলেন বিপ্লবী, অবশ্য তারুণ্যের শেষভাগে তিনি সংসারী হতে চাইলেন। বিপ্লবের তাবত তত্ত্ব ও চর্চার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিনি চল্লিশে গিয়ে জীবনসঙ্গী বেছে নিলেন ফুলপুরের সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে মমতাজ সাহানাকে। মমতাজ সাহানা মৃত্যুর পর বলেন, তিনি নানা ব্যবসায় সাফল্য পেতে চেয়েছেন। সব মিলে ২৮টি ব্যবসায় হাত দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কাজে বিপ্লবী, চিন্তায় আধ্যত্মিক মানুষের দ্বারা ব্যবসা সফল হওয়ার কথাও নয়।
আধ্যত্মিক বিপ্লবী সারোয়ার হোসেনকে আমি মামা বলে ডাকতাম। উনার বিপ্লব ছেড়ে সংসারী হওয়ার সময়টাতে তার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমার সাংবাদিকতা জীবনের অন্যতম উৎসাহদাতা তিনি। সেসময় তিনি প্রিন্টিং ব্যবসায় নেমেছেন, ভাতিজার নামে রামিম প্রিন্টার্স নাম দিয়েছিলেন। কিছু সময় এই প্রিন্টার্সে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ততদিনে বিপ্লবী কাজ কর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেও সিরাজ সিকদার প্রতিষ্ঠিত সর্বহারা পার্টির নানা উপদলের নেতারা হোসেন মামার বাসায় আতিথেয়তা নিতেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিন পদত্যাগের পর বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টি রেজা ভাই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একবার হোসেন মামার বাসায়।
আমার এখনো বিশ্বাস হয় না, সত্তর ও আশির দশকের বিশিষ্ট বাম নেতা ও সাংবাদিক সারোয়ার হোসেন তালুকদার আর নেই। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় তার মৃত্যু হয়। তিনি ক্যান্সার ও বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তবে ডাক্তারদের বরাত দিয়ে তার পরিবার বলছে, স্ট্রোকে হোসেন মামার মৃত্যু হয়েছে। এরপর ওই দিনই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলা রামনাথপুরে নামাজে জানাজার পর পারিবারিক গোরস্তানে লাশ তার দাফন হয়। তিনি স্ত্রী এবং দুই ছেলে রেখে গেছেন।
উপজেলা রাজস্ব কর্মকর্তা (বর্তমানে এসিল্যান্ডের সমমানের) মরহুম আজমান আলী এবং মরহুমা মোছা. জুবেদা আজমান দম্পতির চতুর্থ সন্তান ছিলেন সারোয়ার হোসেন। সারোয়ার হোসেনরা ছিলেন সাত ভাই ও দুই বোন, সবাই প্রতিষ্ঠিত। সারোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি আশির দশকে বামপন্থী সংগঠন জাতীয় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে কর্মজীবনে সে সময়ের দৈনিক জনতার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী নাজিউর রহমানের এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সারোয়ার হোসেন।
সে চাকরি ছেড়ে তিনি ময়মনসিংহে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সেসময় গোপন বাম সংগঠন বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। তিনি দু-দুবার নিজ উপজেলা নেত্রকোণার কলমাকান্দা থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশ নেন। সেখানে সাফল্য না পেলেও শিল্প-সাহিত্য ও বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মিলনস্থল হয়ে ওঠে ময়মনসিংহের আকুয়ায় তাদের পৈতৃক বাসাটি। নানা ধরনের সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে আজীবন যুক্ত ছিলেন। অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সমাজের প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জনপ্রিয়তা পান ময়মনসিংহ শহরে।
কয়েক বছর আগে তার শরীরে মারণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে। ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং সাত ভাই দুই বোনসহ স্বজন ছাড়াও অসংখ্য শুভাকাক্সক্ষীকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন দরাজ গলায় সত্য বলায় উচ্চকণ্ঠ মানুষটি। তবে সুখের বিষয় এই, আর দশজন বিপ্লবীর মতো বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যাননি। সুপ্রতিষ্ঠিত ভাইবোনরা তাকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। অন্য বিপ্লবীদের মধ্যে মিল এখানেই, জীবনের প্রতি খামখেয়ালিপনা ছিল তার। একেবারে মারণব্যাধি ক্যান্সার তাকে সরাসরি কাবু করার আগ নাগাদ রোগ-বালাইয়ে নজর দেননি তিনি। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন যখন, তখন তা একেবারে শেষ পর্যায়ে। তাকে ফেরানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে চিকিৎসকদের।
সারোয়ার হোসেন তালুুকদারের বাবা মরহুম আলহাজ আজমান আলী তালুুকদার, মা মরহুমা মোছা. যোবেদা আজমান। বাবা উপজেলা রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন। ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীকালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়ন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। কর্মজীবন শুরু হয় দৈনিক বাংলা পত্রিকা দিয়ে। তারপর দৈনিক জনতা এবং আরেকটি দৈনিকের পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কমরেড সারোয়ার হোসেন সাপ্তাহিক পরিধি নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ক্রীড়ামোদি মানুষটি সূর্য সেনা ক্লাব ময়মনসিংহ জেলা শাখার সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
সামাজিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন সারোয়ার হোসেন। তিনি আকুয়া মোড়লপাড়া ডিফেন্স পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলায় শিক্ষা থেকে অনগ্রসর একটি অবহেলিত জনপদ উদয়পুরে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং দুই বছর অবৈতনিক প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তবে এই মানুষই বার্ধক্যে যাওয়ার আগে যেন কেমন হয়ে গেলেন। তিনি না ধার্মিক, না বিপ্লবী। সেটা হবে ১৯৯০ বা ৯১ সালের দিকের কথা। হঠাৎ আমাকে নিয়ে গেলেন ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। সেখানে এক মাজারে দরজায় আমাকে দাঁড়িয়ে রেখে তিনি ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি দিনমজুরদের সঙ্গে ইট মাথায় তুলে নিতে শুরু করলেন।
আমি কাছে যেতেই বললেন, তুমি দাঁড়াও আমি কাজটা সেরে আসি। কিছুক্ষণ পর আমি নিজেও ইট মাথায় নিতে চাইলে তিনি নিষেধ করলেন। পরে বাসায় ফিরে তিনি বললেন, বিদেশ থেকে একজন পীর এসেছেন। উনার আদেশেই তিনি এ কাজ করছেন। সে সময় ময়মনসিংহ ও আশপাশে আনোয়ার কবিরের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, কর্নেল জিয়াউদ্দিন ও কমরেড কামরুলের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টির দুই গ্রুপ এবং আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা হোসেন মামাদের বাসায় আসতেন।
তাদের প্রতি হোসেন মামার যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা, একই শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেতেন পীর-মাজারের ভক্তরাও। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সদা হাসিখুশি কথা বলতেন জোরে ও উচ্চকণ্ঠে হাসতেনও একইভাবে। তার মৃত্যু তার পরিবার, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য যেমন ক্ষতি, একই রকম ক্ষতি হয়েছে তার শত-সহস্র শুভাকাক্সক্ষীরও।
সাজেদ রোমেল : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক