ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পল্লী মঞ্চনাটকের গোড়াপত্তন ও গুরুত্ব

জামাল জিলানী
🕐 ১২:০৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১

পল্লী মঞ্চনাটকের গোড়াপত্তন ও গুরুত্ব

পল্লী মঞ্চনাটক বলতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে সৃষ্ট সকল ধরনের মঞ্চনাটককে বোঝায়। পল্লী মঞ্চনাটক সরাসরি স্থানীয় মানুষদের দ্বারা প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয়েছে। লোকজ মঞ্চনাটকে, কলাকুশলীসহ অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং পুতুল (পুরুষ ও মহিলা উভয়ই) অন্তর্ভুক্ত। এখানে পরিবেশনা কেবল সংলাপ বা বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছন্দ, কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্য প্রভৃতি। বাংলাদেশের পল্লীনাট্য বর্ণনাত্মক, গীতি-নৃত্যমূলক, অধি-ব্যক্তিক, পুতুলনাট্য, যাত্রা প্রভৃতি ধরনের হয়ে থাকে।

মঞ্চনাটক দর্শকের সম্মুখে স্থাপিত মঞ্চে বা পটে অভিনীত নাটক। এটি শিল্প মাধ্যমের (পারফর্মিং আর্ট) একটি শাখা। দর্শক বা শ্রোতার জন্য যে কোনো পরিবেশনাকে মঞ্চনাটক হিসেবে বিবেচনা করা গেলেও পারফর্মিং আর্ট হিসেবে মঞ্চনাটক বিশেষভাবে জোর দেয়। সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের দ্বারা সৃষ্ট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নাটকের ওপর। এই দুইটি বিস্তারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী বলা যায় যে, মঞ্চনাটকের অস্তিত্ব ছিল মানব সভ্যতার প্রত্যুষকালেও, কারণ গল্প বলার একটি স্বাভাবিক প্রকৃতিগত প্রবণতা প্রতিটি মানুষে বিদ্যমান। সূচনাকাল থেকেই মঞ্চনাটক অনেকরকম রূপ বা প্রকার ধারণ করেছে; প্রয়োগ করেছে অনেক রকম কথা, দেহভঙ্গি, গান, নাচ, দৃশ্য বা ঘটনা।

দৃশ্যগ্রাহ্য কলাসহ (চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য ইত্যাদি) অন্যান্য পারফর্মিং আর্টকে মঞ্চনাটক একত্রিত করেছে একটিমাত্র সমন্বিত শিল্পের প্রকারে। মঞ্চনাটক শব্দটির মানে হলো দর্শনের জন্য যে স্থান।

নাটকের সূত্রপাত গ্রিস দেশে। তবে প্রথম প্রথম মানুষ নাটক বলত না। অর্থাৎ সব নাটক শুরুতেই আসেনি। নাটকের শুরুতে নাটক ছিল নির্বাক, অভিনেতারা আকারে, ইঙ্গিতে বোঝাতেন। নাটকের প্রথম দশায় কোনো স্থান বা স্থায়ী মঞ্চ ছিল না। কলাকুশলীরাও তখন রাস্তায়, যে কোনো প্রান্তরে কোনো কিছু ভঙ্গি করে দেখাত।

২৫০০ খ্রিস্টাব্দে মিশরে একটি ধর্মীয় নাটক মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি নেওয়া হয়েছিল খ্রিস্টীয় মিশরীয় পুরাণ ‘মিথ অফ ওসিরিস অ্যান্ড আইসিস’ থেকে। আর এটাই ছিল নাট্য সম্পর্কিত প্রথম কোনো ঘটনা, যার তথ্য নথিপত্রে পাওয়া যায়। তখন যে কোনো উৎসবে প্রতি বছর গড অফ ওসিরিস-এর এই নাটক মঞ্চস্থ করা হতো।

ইতিহাস ও বাংলাদেশিদের প্রতিদিনের জীবনে মঞ্চনাটক সংস্কৃতির নানা তাৎপর্য বিদ্যমান। মঞ্চনাটক পারফরমেন্স বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতার আন্দোলনকে তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এছাড়া বাংলা ভাষা আন্দোলনে এটি গভীর প্রভাব বিস্তার করে। পূর্ব পাকিস্তান আমলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুনীর চৌধুরী রচিত কবর নাটকটি ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে একটি বিখ্যাত নাটক। মঞ্চনাটক পারফরমেন্স বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। বর্তমানে অনেক এনজিও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনেক সামাজিক সমস্যার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে মঞ্চনাটক ব্যবহার করে আসছে।

গুপ্ত সাম্রাজ্য বঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত হলে উত্তরভারতীয় আর্য সংস্কৃতি প্রাচীন বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়। সে সময় গ্রামীণ সংস্কৃতির আদলে সংস্কৃত নাটকের চর্চা শুরু হয়। স্থানীয় মানুষদের নানামুখী কর্মকা- বেশ কিছু শহরাঞ্চলের গোড়াপত্তন ঘটায়, যা প্রাচীন বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। চন্দ্রগোমী রচিত চার অঙ্ক বিশিষ্ট লোকানন্দ নাটকটি সে সময়ের জনপ্রিয় নাটক হিসেবে বিবেচিত হয়।

অষ্টম শতাব্দীতে আর্য সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাচীন বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সমন্বয় ঘটে। এই সময়কালে, ভাস্কর বর্মণ, হর্ষবর্ধন, ললিতাদিত্যের আনুকূল্যে এই অঞ্চলসমূহে নাট্যচর্চা আরও বিস্তৃত হয়। কাশ্মীরি কবি কল্যাণের মতে, সে সময় পুরবর্ধনে কমলা নামে এক বিখ্যাত নর্তকী ছিলেন। পরবর্তীকালে পাল শাসনামলে বিক্রমপুর বিহার নাট্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

বর্ণনাত্মক মঞ্চনাটকে বর্ণনাকারী বা গায়েন বিভিন্ন চরিত্র উপস্থাপনার মাধ্যমে নামপুরুষে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। এ সময় তিনি আংশিক গদ্য, আংশিক ছন্দ, আংশিক গানে তার গল্প উপস্থাপন করেন। কখনো কখনো গায়েন কোরাস শিল্পী বা বাদকদের (মৃদঙ্গ ও মন্দিরা সহযোগে) সাহায্যও নিয়ে থাকেন। গায়েন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একটি ঝাড়– বহন করেন এবং মাঝে মাঝে গাওয়ার সঙ্গে নাচও করেন। কখনো কখনো কলাকুশলীগণ কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে চরিত্রায়ণ ফুটিয়ে তোলেন। কখনো তিনি তার মূল পোশাক (গামছা, উত্তরীয় ইত্যাদি) দিয়ে আনুষঙ্গিক উপকরণ হিসেবে উপস্থাপন করেন।

একটি গীতি-নৃত্যমূলক নাট্যরূপ গায়ক এবং সঙ্গীত শিল্পীদের একটি দলের সঙ্গীত পরিবেশনায় নাচ দ্বারা চিহ্নিত হয় এবং কুশীলবদের চরিত্রায়ন দ্বারা মঞ্চস্থ হয়।

দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে, যখন বাংলাদেশের তান্ত্রিক শৈবমত ক্ষয়িষ্ণু তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের সম্পৃক্ত ছিল, গধযধশধষর চুধুধশযধহ, দেবী চুধুধশযধহ এবং অনুরূপ নাচের উৎকর্ষে বৌদ্ধ মুখোশধারী নাচ যুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশে তান্ত্রিক ঝধরারঃব ছদ্মবেশী নাচ, যা কাঠমান্ডু উপত্যকার নাচের সদৃশ নয়, তা মুসলিম বিজয়ের কারণ জীর্ণ হয়ে পড়ে। বর্তমানে কেবল মুক্তনৃত্য, কালীনৃত্য, গম্ভীরা ও সঙ্গযাত্রা অবশিষ্ট রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রাচীন পটুয়াগান উৎপত্তির ইতিহাস নির্দেশ করে। মধ্যযুগে রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, মনসা চরিত্রের পটপ্রদর্শনী অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পটপ্রদর্শনী মুসলমানদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা পায়, যেমন গাজীর পট, যা আজও বাংলাদেশে দেখা যায়।

পল্লী মঞ্চনাটকের মধ্যে যাত্রাপালার বড় অবদান রয়েছে। যাত্রা শব্দটির অর্থ গমন করা। অতীতে কোনো স্থানে যাত্রা বা গমন উপলক্ষে যেসব উৎসব অনুষ্ঠিত হতো, তাই যাত্রাপালা রূপ ধারণ করে। দেবতার উৎসব উপলক্ষে নৃত্যগীতপূর্ণ শোভাযাত্রা বের করা হতো। রথযাত্রা এরূপ একটি উৎসব। যাত্রা প্রাচীন লোকসাহিত্যের একটি ক্রমবিবর্তিত রূপ। এটি দেশীয় মঞ্চনাটক সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপ যা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় নাট্যশালার সমার্থক দাবি করতে পারে।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুর হিন্দু মঞ্চনাটক প্রতিষ্ঠা করেন যা বাঙালি প্রতিষ্ঠিত প্রথম মঞ্চনাটক। সে সময় বাংলা আধুনিক নাটকের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি নাটক অবলম্বনে বেশ কিছু নাটক রচনা করেন। ফলে ইউরোপীয় প্রভাবে আধুনিক বাংলা নাটকের ভিত রচিত হয়।

এছাড়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ নাটকটি সে সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য নাটক হিসেবে পরিগণিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপীয় ভাবধারার বাংলা নাটকের নিজস্ব রূপ প্রদান করেন। পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাংলা নাটকের এই আধুনিক রূপ গণমানুষের দ্বারে নিয়ে আসেন।

১৯৪৭-এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা নাট্যচর্চা ছিল ১৯ শতকের ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিপীঠ কলকাতাকেন্দ্রিক। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে পরিগণিত হয়। নতুন দেশের মঞ্চনাটক ধীরে ধীরে দুটো বিপরীতধর্মী শিবিরে মেরুকরণের দিকে ধাবিত হয়। ক. ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী এবং খ. ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী। ধর্মভিত্তিক প্রবণতা ঢাকার বাইরে শহরাঞ্চলে প্রভাবশালী ছিল। এ প্রবণতা ঐতিহাসিক নাটকের মাধ্যমে ইসলামের মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ও বাংলা ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করার প্রয়াস পায়। আকবর উদ্দিন, ইবরাহীম খাঁ, আসকার ইবনে শাইখ এ ধারার অন্যতম পথিকৃৎ। দ্বিতীয় ধারাটি প্রধানত ঢাকা শহরে প্রভাবশালী ছিল এবং এই প্রবণতার নাট্যকারগণ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ ধারার পথিকৃৎ হলেন নাট্যগুরু নুরুল মোমেন। তার পরে এই ধারায় যারা অবদান রাখেন, তারা হলেন শহীদুল্লা কায়সার, জসীম উদ্দীন, মুনীর চৌধুরী, শওকত ওসমান। যা ইতিহাস কথা বলে।

বাংলাদেশে মঞ্চনাটক সত্যিকার অর্থে বিকাশ লাভ করে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন মঞ্চনাটক আন্দোলনের জন্ম দেয়। সে সময়ে পল্লী তথা শহরাঞ্চলের সচেতনতা বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত বলে প্রমাণিত। মঞ্চনাটক গ্রাম্য মানুষের বিনোদনের বড় একটা অংশ। মঞ্চনাটকের বদৌলতে গ্রামাঞ্চল নানা বিষয়ে সচেতন। গ্রামীণ জীবনে সচেতনতা বৃদ্ধিতে মঞ্চনাটকের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বর্তমানে মঞ্চনাটকে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং পল্লীতে বিভিন্ন প্রকার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ঘরে বসে বিনোদন উপভোগ করার সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মানুষের মনে অযথা সময় বিনষ্ট করার প্রবণতাও কমেছে। পক্ষান্তরে নিজ নিজ অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবণতা সীমাহীনভাবে বেড়েছে। এতে করে বাংলাসাহিত্যে এ ধারাটির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

তাই সরকারের উচিত বর্ণনাত্মক মঞ্চনাটকে বর্ণনাকারী বা গায়েনদের সংগঠিত করে গ্রাম বাংলার পুরাতন ঐতিহ্য মঞ্চনাটক পুনঃজীবিত করে সচেতনতার মাধ্যম হিসেবে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।

জামাল জিলানী : কলাম লেখক, দিনাজপুর

 
Electronic Paper