ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ছাত্রসংসদ নির্বাচন কেন প্রয়োজন

নূরুজ্জামান
🕐 ৯:৩২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৫, ২০১৮

জীবনসংগ্রামে প্রতিটি মানুষকে প্রতিনিয়তই নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও বিভিন্ন সময় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও ছাত্রদের সমস্যার কথা মাথায় না নিয়েই উন্নয়ন পরিকল্পনা বা আয়-ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ফলে ছাত্রদের দুই ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক ছাত্রকে সেসব সমস্যার মোকাবেলা করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, কয়েক দিন আগে মিডিয়ার কল্যাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন ছাত্রের জীবনসংগ্রামের খবর জানতে পারলাম। ওই খবরে বলা হয়েছে, ছাত্রটি দিনে ক্লাসের সময় ক্লাস করেন, আর ক্লাসের ফাঁকে কিছু সময় চা-বিস্কুট বিক্রি করে পড়ালেখার খরচ চালান। এই সমস্যা ওই ছাত্রের হলেও তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমাধান করতে অক্ষম নন। ওই ছাত্রের এই আর্থিক সমস্যার কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্যও ছাত্র প্রতিনিধির প্রয়োজন হয়। ছাত্রটি কিন্তু তার আর্থিক কষ্টের কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেননি। কারণ, তার অভিযোগ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানোর মতো তার পক্ষের প্রতিনিধি বা নেতৃত্ব নাই।

ছাত্রদের যে কোনো অভাব-অভিযোগের কথা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কাছে কারও একার পক্ষে জানানো সম্ভব নয়। কারণ, যে ছাত্রটি আজ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাকে হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চেনেনই না। অথবা চিনলেও তাকে গুরুত্বই দেন না। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কর্তৃপক্ষকেও নানাবিধ সমস্যার মধ্য দিয়ে পথ চলতে হয়। সেসব সমস্যার সমাধান করার সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজসাধ্য নয়। তাই তারা তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কোনো বিশেষ সাধারণ ছাত্রের বা ছাত্রদের সমস্যার কথা ভাবার সময় তাদের থাকে না। তদুপরি আছে আর্থিক সমস্যা ও অর্থলিপ্সার আকাঙ্ক্ষা।

এসব বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সবাই স্বেচ্ছায় কোনো ছাত্রের বা ছাত্রদের সমস্যার কথা ভাববে এমনটিও মনে করার কোনো কারণ নেই। এখানে প্রয়োজন পড়ে ছাত্র প্রতিনিধির। ছাত্ররা তাদের পক্ষ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের সমস্যাগুলো, দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য, দরকষাকষি করার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। যখনই ছাত্ররা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন তখনই ওইসব প্রতিনিধিদের পবিত্র দায়িত্ব হয়ে যায় সাধারণ ছাত্রদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও সে কারণেই ছাত্রদের মুখপাত্র হয়ে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার অধিকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে কিছুটা হলেও জবাবদিহির মধ্যে আনা যায়। কারণ, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কর্তৃপক্ষ করলেও প্রতিষ্ঠানে যারা পড়ালেখা করেন সেসব ছাত্ররাই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় অংশ। এই গুরুত্বপূর্ণ ও বড় অংশের প্রতিনিধি বা নেতৃত্ব থাকবে না তা কি করে হয়? অথচ সুদীর্ঘ ২৮-২৯ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না! সেই পথ ধরে কলেজগুলোতেও ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। এভাবে আমরা শুরু থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রকে হারিয়ে ফেলছি! ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রধানত যাদের কাছে জবাবদিহি করার কথা, তাদের গণনার মধ্যেই রাখছে না।

এভাবেই গত ২৮-২৯ বছরে আমরা গণতন্ত্রের শিকড় কেটে ফেলার কাজ করে চলেছি! যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে স্বেচ্ছাচারী। নির্বাচিত ছাত্রসংসদে থাকেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তিনি বা তার দল ছাত্রদের মননে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর জন্য বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। ছাত্রসংসদে থাকেন ক্রীড়া সম্পাদক। তিনি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করেন। থাকেন সাহিত্য সম্পাদক। তিনি প্রতিষ্ঠানের বা ছাত্রসংসদের পক্ষ থেকে সাহিত্যবিষয়ক সাময়িকী প্রকাশনা করেন, সাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এভাবে বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক তাদের দল নিয়ে শিক্ষার্থীদের মানুষিক ও শারীরিক বিকাশের কাজ করেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্ররা নানামুখী প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। আবার নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরাও এ ধরনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতাসম্পন্ন হয়ে ওঠেন।

ফলে দেশে গড়ে ওঠে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী আত্মবিশ্বাসী নেতৃত্ব। তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এই কারণে, ছাত্রসংসদেও তাদের ছাত্রসংসদের সংবিধান মোতাবেক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। তারা সেখানে ছোট পরিসরে হলেও সাংবিধানিক কাজ শেখার সুযোগ পান। আবার ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্ররা যাদের তাদের নেতা নির্বাচিত করেন, তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পরও ওই ছাত্রনেতাদের সমীহ করে চলার মতো মন- মানসিকতার রসদ পান। ছাত্রনেতারাও শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতার কারণেই কর্মজীবনে প্রবেশের পরও প্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্রটিকেও আদেশ করে তার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারেন।

ওই মেধাবী ছাত্রটিও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পরও ছাত্রনেতার আদেশ মান্য করতে কোনো হীনমন্যতায় ভোগেন না। আজ এই হীনমন্যতার সংকট প্রশাসনের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি তা কিন্তু বলা যাবে না। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর সংকট সামনের দিনগুলোতে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া যায় না। ইতোমধ্যেই সংকটের লক্ষণগুলো রাজনীতিতে প্রবেশের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেন নেতৃত্বের সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে। তাই তো দেখি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ নমিনেশন চাচ্ছেন। হয়তো দেখবো এদের একটা অংশ সে সুযোগ পাবেনও। আবার কিছু কিছু দলও শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী করে আনার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের জনপ্রিয় ব্যক্তিদের সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী করবেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। একজন ব্যক্তি খেলোয়াড় হিসেবে জনপ্রিয় হলেই তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে যোগ্যতম হবেন এমন তো কথা নেই। সংসদে প্রয়োজন সংসদ সদস্য হিসেবে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন এমন সংসদ সদস্য। তবেই না তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংগ্রহণপূর্বক দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে পারবেন।

শুধু জাতীয় সংসদের একটি আসন দখল করার জন্যই কি সংসদ সদস্য দরকার? দেশ ও জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম কেবল এমন ব্যক্তিই পারেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে সঠিকভাবে গতিশীল করে সঠিকপথে পরিচালিত করতে। আর যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন করা। এভাবে ছাত্ররা ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পান।

সুতরাং ভবিষ্যৎ যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়া খুবই জরুরি তেমনি আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য দূর করারও বলিষ্ঠ হাতিয়ার হতে পারে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নিত্যনতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা। আজ আমাদের দেশের ছাত্রসমাজের মধ্যে আমলা বা কেরানি হওয়ার প্রবণতাই বেশি। মেধাবী আমলা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন আমলাদের সঙ্গে কাজ করার মতো সুযোগ্য নেতৃত্ব। তবেই দেশ কাক্সিক্ষত উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। তাই দেশের সার্বিক প্রয়োজনেই যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার পথ পরিষ্কার করা জরুরি। আর সে জন্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়াও জরুরি। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও গণতান্ত্রিক জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। সেই জন্যও ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়া জরুরি। একমাত্র নির্বাচিত ছাত্রসংসদই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তো জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে চাইবেই। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। তাই দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য, সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিতভাবে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়া এখন সময়ের দাবি।

নূরুজ্জামান : কলাম লেখক।
[email protected]

 

 
Electronic Paper