ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শিক্ষার অধিকার

আব্দুর রউফ
🕐 ১২:২৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১

শিক্ষার অধিকার

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে এদেশের সংগ্রামী ছাত্র জনতা শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশের গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুলসহ অনেকেই। সেদিন ঢাকার রাজপথে অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের শিক্ষার অধিকার হনন করার কৌশল রুখে দেওয়া। এদেশের ছাত্র জনতা সেদিন সেই অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। নিজেদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে সেদিন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীকে শরিফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতিকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল।

কথায় আছে, যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যেটি আন্দাজ করতে পেরেছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন পাকিস্তানের সদ্য সামরিক জান্তা সরকার আইয়ুব খান। যেটি ঐতিহাসিকভাবে শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। সেই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। যে শিক্ষানীতির বেশ কিছু সুপারিশ তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে একদম প্রাসঙ্গিক ছিল না।

৬২-এর সালের শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষাকে সর্বজনীন অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তথা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সালের এই সময়টুকুতে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থায় নানা ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে অন্যতম এই শিক্ষা আন্দোলন। যে আন্দোলনের সুফল কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে আজকে আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। তবে বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর শিক্ষানীতি পরিহার করে এদেশের মানুষের যে সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তৎকালীন শরীফ শিক্ষা কমিশন যে সুপারিশগুলো প্রকাশ করেছিল তাতে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি ও উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক সীমাবদ্ধতা ও শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শরীফ কমিশনের এই শিক্ষা সংকোচন নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তৎকালীন অনেকেই বলেছেন, যেন এই বঙ্গের মানুষ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে না পারে তার সকল ব্যবস্থা ছিল এই প্রস্তাবনায়। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল ডিগ্রি কোর্স দুই বছর থেকে তিন বছর করা, কলেজ পর্যায়ে বছর শেষে পরীক্ষা ও তার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী বর্ষে উন্নীত হওয়ার শর্ত, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফলের নির্ভর করা। এই শর্তগুলোকে ছাত্রজনতা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ বন্ধ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। প্রতিবেদনটি ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়। সামরিক আইন জারি থাকার কারণে দেশে সকল প্রকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই আন্দোলন তেমন বেগবান করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে এই প্রস্তাবনায় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আইয়ুব খান চেয়েছিলেন ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে। যেন কোনো শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে না পারে। তবে ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয় রিপোর্ট বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্দোলনের শুরু থেকেই আইয়ুব খান সরকার ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হামলা ও বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন করতে থাকে। নানা চড়াই-উৎরাই পার করে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৪৪ ধারা উপেক্ষিত করে তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। সেদিন পুলিশের সঙ্গে ছাত্রজনতার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিল সামনের দিকে এগোতে থাকলে পুলিশ নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করে। এতে অনেকেই আহত ও নিহত হলে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে আইয়ুব খান সরকার এই শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়।

শিক্ষা দিবসের মতো আমাদের এত বড় একটি ঐতিহাসিক অর্জন থাকলেও নতুন প্রজন্ম এটির সঙ্গে পরিচিত নয়। শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছেন, সেদিন যদি ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন সংগঠিত না হতো তাহলে আমরা হারাতাম আমাদের শিক্ষার অধিকার। হয়তো ভুলে যেতাম আমাদের কৃষ্টি-কালচার ও মাতৃভাষা। নতুন প্রজন্মের নিকটে এই ঐতিহাসিক অর্জনগুলোর সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দিতে হবে। যদি ১৭ সেপ্টেম্বরকে সরকারিভাবে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয় তাহলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই শিক্ষা দিবস সম্পর্কে জানতে পারবে। তাই এই শিক্ষা দিবসে বাংলাদেশ সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি প্রত্যাশা থাকবে ১৭ সেপ্টেম্বরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সকল শহীদদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

আব্দুর রউফ, শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper