ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা

ইস্রাফিল রনি
🕐 ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা

মোতাহার হোসেন চৌধুরী তার ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে মানুষের জীবনকে দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার নিচতলা হলো ক্ষুৎপিপাসা মেটানোর স্তর আর উপরের তলা হলো মনুষ্যত্ব অর্জনের। আমরা সকলেই জানি মনুষ্যত্ব অর্জনই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, কিন্তু মানুষের ক্ষুৎপিপাসা না মিটলে বা মানুষ স্বাবলম্বী না হলে সে মনুষ্যত্ব অর্জনের স্বাদ কখনো পাবে না। এজন্য শিক্ষার পাশাপাশি রুটি-রুজির ব্যবস্থারও চিন্তা করা উচিত। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিভিন্ন স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে; তারা ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে যেতে চায়, কোন সেক্টরে নিজেকে দেখতে চায় এসব চিন্তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল বিষয় হিসেবে দেখা হয়।

বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষা অনুসারে একজন শিক্ষার্থী অনার্স বা তার সমমানের ডিগ্রি অর্জনের পরই প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিগুলোতে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করে। এসব চাকরি পেতে হলে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের কয়েকটি ধাপে পরীক্ষায় বসতে হয়। কৃতকার্য হলে মৌখিক টেস্ট এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশি সার্টিফিকেটসহ নানা বিষয়ে বেগ পোহাতে হয়। এসব প্রক্রিয়া ছাড়াও সময় এবং প্রার্থীর বয়স নিয়ে কিছু শর্ত রয়েছে।

কিছু ব্যতিক্রম ভিন্ন বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারী চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ বছর, তার মানে ৩০ ঊর্ধ্ব কোনো ব্যক্তি সরকারি চাকরিতে আবেদনের যোগ্য হবেন না। বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বয়সসীমা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিসিএস পরীক্ষাকে দেশের প্রায় সকল ছাত্রদের চরম ও পরম প্রত্যাশার বিষয়ে উপনীত করেছে। শুরু থেকেই একটি ছাত্র লক্ষ্য হিসেবে এ পরীক্ষাকেই স্থির করে। পরবর্তীকালে এতসব বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়ায় চাকরির আবেদন না করতে পেরে প্রতিবছর অনেক ছাত্র মানসিক পীড়ায় ভোগে। বুকভরা আশা নিয়ে যেসব ছাত্ররা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাদের উপর পরিবার ও সমাজের থাকে আকাশ সমান প্রত্যাশা। কিন্তু পরবর্তীকালে এ ছাত্রকেই বেকার জীবনের অভিশাপ পোহাতে হয়। দারিদ্র্যের মর্মজ্বালায় অনেক শিক্ষিত যুবককে দেখা যায় বিভিন্ন কায়িক শ্রমে জড়িয়ে যেতে। শিক্ষিত যুবকদের আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের সবারই জানা। এভাবে করে সমাজে শিক্ষার প্রতি মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়। কিশোররা শিক্ষাবিমুখ হয়ে ওঠে। অভিভাবকরা শিশুদেরকেও শ্রমে নিয়োগ দেয়। কাজেই শিক্ষার প্রতি মানুষ আর আস্থা রাখতে পারে না।

আমরা দেখে আসছি, দেশের সাধারণ ছাত্রসমাজ সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বাড়াতে অনেক আগে থেকেই আন্দোলন করে আসছে কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে দেশের ছাত্রসমাজ এবং বুদ্ধিজীবী মহল নানান সময়ে নিদারুণ হতাশা প্রকাশ করেছে। এর মাঝে বিশ্বে শুরু হলো করোনা মহামারী।

দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়তবা একদিন গুছে যাবে কিন্তু ছাত্রদের ক্ষতি পূরণীয় নয়। এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ওই সমস্ত চাকরি প্রার্থীরা যাদের ইতোমধ্যেই বয়স ৩০ ছেড়েছে কিন্তু করোনার জন্য পরীক্ষায় বসতে পারেনি। এটি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। কিছুটা স্বস্তির বিষয় হলো, জনপ্রশাসন ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিতব্য বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা গত বছরের ২৫ মার্চ ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাদের লস হওয়া সময়গুলো ছাড় দেওয়া হলো। কিন্তু এটি আদৌ কোনো সুবিচার হয়নি বরং অবিচার হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ছোট্ট একটি অংশের জন্য হয়তো স্বস্তির কিন্তু বাকি পূর্বে আলোচিত বিভিন্ন জটিলতার কারণে যে শিক্ষার্থীরা ২৭ বছরে চাকরি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা না নেওয়ায় সেশনজটে পডে তাদের জীবন থেকেও তো দুটি বছর চলে গেল। এভাবে করে ইক্সিটিং অন্যান্য শিক্ষার্থীও সমান ভোগান্তির শিকার। সুতরাং এদের শিক্ষাজীবনে আজীবন ২ বছর ঘাটতি থেকেই যাবে। এদের বিষয় তো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হলো। একে তো মহামারীতে নানান টানাপোড়েনে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় পিছাল তারপর বয়সের কারণেও তারা কাক্সিক্ষত চাকরি থেকে বঞ্চিত হবে। সুতরাং দেশে কেমন অরাজক পরিস্থিতি আসতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

আমাদের আরেকটি বিষয় চিন্তা করে দেখা দরকার, দেশে গড় আয়ু যখন ৪৫ ছিল তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছিলো ২৭, যখন ১৯৯১ সালে গড় আয়ু ৫০-এ উপনীত হলো তখন থেকে বয়সসীমা করা হলো ৩০, এখন গড় আয়ু ৭১ বছর- এ সমীকরণে বয়সসীমা কত হওয়া দরকার? এর মধ্যে ২০১১ সালে চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বেড়ে হয় ৫৯; যেহেতু অবসরের বয়স ২ বছর বাড়ানো হয়েছে সেহেতু চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২ বছর তো অনায়াসেই বাড়ানোর কথা।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- আমাদের দেশ প্রায় সকল ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে অনুসরণ করলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমায় রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। বাংলাদেশের এ বয়সসীমা বিশ্বের ১৬২টি দেশের সর্বনিম্ন বয়সসীমা থেকেও পাঁচ বছর কম।

উল্লেখ্য, উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের জনগণকে মানবসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে এরকম কোনো বয়সসীমা রাখেনি আর কতিপয় রাষ্ট্র যেমন ইতালিতে ৩৫, ফ্রান্সে ৪০, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বনিম্ন বয়স ৪০ ধরা হয়েছে। যেখানে উন্নত বিশ্ব, স্বল্পোন্নত বিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বয়সসীমা এই রকম- এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এমন নাজুক পরিস্থিতি ছাত্রদের দারুণভাবে হতাশ করছে। এ পরিস্থিতিতে উক্ত বয়সসীমা ৩৫ বছরে উন্নিত করার জন্য অনেক আগে থেকেই ছাত্ররা নানান আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সময়ে সময়ে অনেকে অনশনে বসেছে কিন্তু আমরা ছাত্রদের এই ন্যায্য দাবির পক্ষে সরকার থেকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তের বিষয় পাইনি।

একটি কথা খুবই প্রচলিত, মানুষ যখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় তখন তার নীতি-নৈতিকতার মানদ- ঠিক থাকে না। বর্তমানে বয়সে কারচুপির ঘটনা অহরহ ঘটছে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই নানান কৌশলে নিজেদের বয়স কমাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই এ অপকৌশল ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলত যেসব ছাত্ররা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত তারা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। প্রথমত সমূহ যৌক্তিক কারণ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন বয়সসীমা বাড়াচ্ছে না, দ্বিতীয়ত সরকার কোনোভাবেই বয়স ফাঁকি কমাতে পারছে না। সুতরাং বয়সসীমা বাড়িয়ে এ সংকটের আশু সমাধান দরকার।

ইস্রাফিল রনি : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper