ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রেম-অপ্রেমের গল্পকার দীলতাজ রহমান

জাহাঙ্গীর আলম জাহান
🕐 ১২:৪৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

প্রেম-অপ্রেমের গল্পকার দীলতাজ রহমান

গল্পকার দীলতাজ রহমানের গল্পের বই ‘তারান্নুম’ নামটি যখন প্রথম শুনি, ভেবেছিলাম এটিও সে যুগের ‘আনোয়ারা’ কিংবা এ যুগের ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের মতোই কোনো ট্র্যাজিক গল্পেরই সংকলন। শফিক হাসানের মাধ্যমে বইটি হাতে পাওয়ার পর এবং গভীর অভিনিবেশে পাঠ করার পর এক নবতর আস্বাদে মনটা ভরে ওঠে। দীলতাজ রহমানের ভাষা এবং বাক্য গঠনের কৌশল এতই প্রাঞ্জল, পাঠক একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না। শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও নিজস্ব একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছেন তিনি। আটটি গল্পের এক অনবদ্য সংযোজন তারান্নুম। নামগল্পটিতে ভ্রমণকাহিনির আমেজ অনেকটাই প্রকট। গল্পটি বেশ মজার এবং এতে ব্যক্তিগত অনুভূতি, আনন্দ ও বেদনার কথা মূর্ত হয়ে উঠেছে।

বাংলা সাহিত্যে ‘চোর’ নিয়ে প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন মনোজ বসু। তার ‘নিশিকুটুম্ব’ উপন্যাসের নায়কই হচ্ছে নফরকেষ্ট নামের একজন চোর। সেই চোরের কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে মনোজ বসুর মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, একজন চোরের জীবনকাহিনি যদি সঠিকভাবে লেখা হয় তাহলে সমাজের প্রতিটি মানুষেরই জীবনী লেখা হয়ে যায়। মনোজ বসুর এ কথা মেনে নিলে আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে চোর। যার সত্যতা তুলে ধরেছেন দীলতাজ রহমান তার ‘চোর’ গল্পে। তবে এ চোর মনোজ বসুর সেই পেশাদার চোর নয়। এ যে নিতান্তই শৌখিন চোর। বই চুরিকে উপজীব্য করে গল্পের কাঠামো সাজিয়েছেন। গল্পটি বেশ মজাদার ও চমকপ্রদ। লেখকের আত্মকথার প্রকটতা ও স্মৃতিময় আত্মজৈবনিক ঘটনার সরল স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়।

নিজের ছেলের পরকীয়া প্রেম একজন মাকে কতটা আহত ও বিচলিত করে সেই চিত্রকল্প নিয়ে ‘প্রতিদান’ গল্পের কাহিনি সাজানো হয়েছে। আমাদের সমাজে এ নষ্ট প্রবণতা দিনে দিনে সামাজিক ব্যাধির আকার ধারণ করছে। প্রতিদান গল্পে এ নষ্ট ব্যাধির প্রতি মায়ের ক্ষোভ, বেদনা এবং নৈরাশ্যের যন্ত্রণা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি পরকীয়া নামক ব্যাধি থেকে সমাজকে উদ্ধারের বিমূর্ত ইঙ্গিতও এতে স্পষ্ট।

কবি হিসেবে তার দক্ষতা যেমন প্রশ্নহীন, কথাসাহিত্যেও কম যান না। এত ভালো গল্প লিখেও যতটা আলোচনার পাদপ্রদীপে তার থাকা উচিত ছিল, ততটুকু তিনি কেন নেই সেটি বিরাট প্রশ্ন বটে। প্রশ্নের সদুত্তর যাদের কাছে প্রত্যাশিত সেই সুশীল কর্তারা দীলতাজ রহমানকে সম্ভবত এখনো শনাক্তই করতে পারেননি। যদি পারতেন তাহলে এ কথাসাহিত্যিককে এত দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কারের বাইরে রাখার প্রবণতা হয়তো দেখতে হতো না।

পুরস্কারও তো হয়ে গেছে এখন কোটারি স্বার্থ আর সিন্ডিকেট-নির্ভর। এ কর্কশ পথে দীলতাজ রহমানের মতো রুচিশীল ও সৃজনশীল মানুষরা কখনো হাঁটতে অভ্যস্ত নন। তাই বোধহয় যোগ্যতার চূড়ান্ত উচ্চতায় পৌঁছেও তিনি বঞ্চিতদের দলেই পড়ে আছেন। এ বঞ্চনাকে গ্লানি ভাবার কারণ নেই। একজন ভালো লেখক যখন পাঠকের হৃদয়ে পদকের চেয়েও বড় মহিমায় বেঁচে থাকেন, সেটিই হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। দীলতাজ রহমান সেই পুরস্কারে বহু আগেই ভূষিত এবং অভিষিক্ত হয়েছেন।

মানুষ মনের দিক থেকে কতটা উদার হতে পারে, দীলতাজ রহমানকে না চিনলে সেটি জানা হতো না। সাদা মনের মানুষের গল্প পত্রপত্রিকায় প্রায়শই পড়ার সুযোগ হয়। পড়ে পড়ে সেই মানুষদের প্রতি অন্যরকম শ্রদ্ধায় আকণ্ঠ ডুবে থাকি। যান্ত্রিকতার এ যুগে মানুষ যখন দিনে দিনে যন্ত্রমানবে পরিণত হচ্ছে, মানবিকতাবোধ যখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেই পরাবাস্তব কঠিন সময়ে কিছু কিছু মানুষ প্রকৃত অর্থেই মানবপ্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেন।
তার অনেক লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চোখে পড়েছে। ২০০৯ সালে আমাদের (কিশোরগঞ্জ) ছড়া উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে কবি রোকেয়া ইসলাম এবং কবি তাহমিনা কোরাইশীকে সঙ্গে নিয়ে এ মমতাময়ী মা-সদৃশ লেখক কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন। সেই প্রথম তার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ এবং কথা বলা। প্রথম পরিচয়েই পরম মমতায় কাছে টেনে নেন আমাকে। সময় গড়াতে গড়াতে পরিচয়ের সূত্রটি প্রলম্বিত হয়ে এত গভীরতায় পৌঁছাল, এরা সবাই আমার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠলেন।

২০১৫ সালের নভেম্বরের শেষদিকে শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ পদক গ্রহণের জন্য চমৎকার এক সাহিত্য-আয়োজনে শ্রীপুরে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি দীলতাজ রহমানও কথাসাহিত্যে একই পদকে মনোনীত হয়েছেন। পদক গ্রহণের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে তিনিও অনুষ্ঠানে হাজির।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ। এ কবির ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতাকে চিত্রনাট্যে রূপ দিয়ে যে তরুণ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন, তরুণ কবি মাসুদ পথিক এবং শিশুসাহিত্যিক আশিক মুস্তাফাও একই পদকে মনোনীত হয়েছেন। এত এত গুণী মানুষের সঙ্গে এরকম পদক প্রাপ্তিতে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হচ্ছিল। সে অনুষ্ঠানে আমার সফরসঙ্গী হয়েছিল আমারই কন্যাতুল্য কবি মাহবুবা খান দ্বীপান্বিতা। দীপু তো কবি নির্মলেন্দু গুণকে পেয়ে মহাখুশি। মধ্যাহ্নভোজে একই টেবিলে কবির সঙ্গে খেতে বসে ও যত না খাওয়ায় মনোযোগী ছিল তারচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিল ছবি তোলায়। প্রিয় কবির সঙ্গে নানা এঙ্গেলে ছবি তুলতে পেরে ওর আনন্দ যেন আর ধরে না। আমার পাশে বসেছিলেন শ্রদ্ধার মানুষ দীলতাজ রহমান। অনুষ্ঠানের আয়োজক মোহসীন আহমেদ আর প্রিয় ছড়াকার আনিসুর রহমান খানের আতিথ্য আজও ভুলতে পারিনি।

বলছিলাম দীলতাজ আপার কথা। বরং সে প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সহমর্মিতার সবটুকু পাওয়া যায় এই মহিয়সীর মধ্যে। এত অসাধারণ তার আচরণ, মমতাপূর্ণ ব্যবহার, এ জনমে খুব কম মানুষের মধ্যেই পেয়েছি। তার প্রতি তাই মুগ্ধতার শেষ নেই, অতল শ্রদ্ধারও কোনো কমতি নেই। এ তো গেল মানুষ হিসেবে দীলতাজ রহমানের ব্যক্তি-পরিচয়। এর বাইরেও তার মধ্যে মননশীলতার একটি সৃজনী সত্তা রয়েছে। আমরা যাকে বলি লেখকসত্তা। বলতে দ্বিধা নেই, তার ব্যক্তিসত্তা যেমন মানবিকতার ঔদার্যে পরিপূর্ণ, তেমনি লেখকসত্তাটিও অপরিসীম সৌন্দর্য এবং সাবলীলতায় ভরপুর। দীলতাজ রহমানের গল্পসমগ্র-১ থেকে কিছু গল্প পাঠ করার পর তাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। যদিও পুরো বইটি না পড়ায় অনুযোগের সুরে অভিযুক্তও করেছেন। বলেছেন, তার লেখা আমাকে টানে না বলেই সব গল্প পড়িনি। বাস্তবতা কিন্তু মোটেই সে রকম নয়। দীলতাজ রহমানের লেখা অত্যন্ত সাবলীল এবং ঝরঝরে। তিনি একটি স্বতন্ত্র গদ্যশৈলী নির্মাণ করেছেন। পাঠক একবার পড়তে শুরু করলে বাক্যের গতিময়তাই শেষ অবধি টেনে নিয়ে যাবে।

আমি প্রায়ই একটি কথা বলি, গৃহিণীরা ভাত রাঁধতে গিয়ে হাঁড়ির চাল ফুটল কি না সেটি বোঝার জন্য কখনোই পুরো হাঁড়ির ভাত টিপে দেখেন না। একটি-দুটি ভাত টিপেই সমস্ত ভাতের অবস্থা ঠাহর করতে পারেন। একইভাবে একজন লেখকের শক্তিমত্তা বোঝার জন্য তার সমগ্র রচনা পাঠ করার প্রয়োজন পড়ে না। দু-একটি লেখা পড়েই লেখকসত্তার দৌড় অনুমান করা যায়।

দীলতাজ আপার সেই শক্তিমত্তা আবিষ্কার করে তার নিঃশর্ত ভক্তে পরিণত হয়েছি। বলে রাখা ভালো, সাহিত্যের বিশাল আঙিনায় আমি কোনো হোমড়াচোমড়া নই। সাহিত্যকে ভালোবেসে একটু-আধটু লেখালেখির চেষ্টা করি মাত্র। কারও লেখালেখির ব্যাপারে আমার এসব তথাকথিত মূল্যায়ন বাজারি সাহিত্যের হাটে হালে হয়তো পানি পাবে না। তবে একজন অসাধারণ ভালো মানুষ এবং আমার বিবেচনায় একজন চৌকস কথাসাহিত্যিকের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশের এই আয়োজনকে আমি কিছুতেই অতিশয়োক্তি মনে করছি না। তারান্নুম বইটির প্রকাশক ‘প্রকাশ পাবলিকেশন্স’, প্রচ্ছদ করেছেন শতাব্দী জাহিদ।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান : ছড়াকার, কিশোরগঞ্জ থেকে

 
Electronic Paper