ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গণমাধ্যমের ভোঁ-দৌড় ও পাঠকের মন

রনি রেজা
🕐 ১২:৪০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

গণমাধ্যমের ভোঁ-দৌড় ও পাঠকের মন

প্রায়ই দেখা যায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন শিরোনাম বা খবর নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। তীব্র সমালোচনায় সাংবাদিককে বিদ্ধ করা হয়। গোটা সাংবাদিক জাতিকেও উদ্ধার করতে ছাড়েন না কেউ কেউ। এমন আলোচনা-সমালোচনা যে কোনো বিষয়েই হতে পারে, হয় এবং অতীতেও হতো। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে তা দ্রুত পৌঁছে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ জোরেশোরে সমালোচনাগুলো ভাইরাল হয়। তা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে না। সমালোচনা কাজে লাগিয়ে শুধরে নেওয়া যায়। অনেকে নেয়ও। আবার অধিকাংশই নেয় না। এখানে আলোচনা হতে পারে মূলধারার গণমাধ্যম আর অখ্যাত গণমাধ্যম নিয়ে। দেশে বর্তমানে কমপক্ষে পাঁচ হাজার অনলাইন সংবাদমাধ্যম রয়েছে।

সারা দেশে অনুমোদিত প্রিন্ট পত্রিকা রয়েছে কমপক্ষে তিন হাজার। টেলিভিশন রয়েছে প্রায় ৩৫টি। প্রচারের অপেক্ষায় রয়েছে আরও প্রায় ১১টি। আইপি টিভি, এফএম রেডিও-কমিউনিটি রেডিও, অনলাইন রেডিও-টেলিভিশন তো আছেই। এই যে বিশাল সংখ্যক নামসর্বস্ব গণমাধ্যম রয়েছে দেশে। এর অধিকাংশই স্পষ্ট করে বললে হয়তো ৯৯ শতাংশ গণমাধ্যমই তথ্যবহুল খবরের চেয়ে চটকদার শিরোনামে ভুয়া খবর কিংবা অখবর প্রচারেই বেশি ব্যস্ত। তাদের উদ্দেশ্য ব্যবসা করা। একটা বা দুইটা কম্পিউটার নিয়ে এসএসসি/ এইচএসসি পাস বা তারও কম শিক্ষিত কোনো ছাত্র বা বেকার কাউকে আট হাজার টাকা বেতন দিয়ে বসিয়ে দিলেই একটা অনলাইন গণমাধ্যমের মালিক হওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন বিজ্ঞাপনও পাওয়া যায়। একটা ডোমেইন কিনেই দুই-পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে হয়ে যাচ্ছেন সাংবাদিক কিংবা গণমাধ্যমের মালিক।

এরপর চটকদার সব শিরোনাম দিয়ে, কোনো এথিক্সের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই প্রকাশ করে টাকা উপার্জনই এদের লক্ষ্য। যদিও কয়েক বছর ধরে অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তথ্যমন্ত্রী আইপি টিভির বিপক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন; তবু এসব থেমে নেই। আশা করছি, এসব নিয়ন্ত্রণ হবে। আজ অথবা কাল। কিংবা নিয়ন্ত্রণ না হলেও পাঠক নিজ দায়িত্বে এদের চিনে নেবে। আশ্রয় নেবে মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে। কোনো খবর কানে ভাসলে আগে দেখে নিতে হবে বিশ্বস্ত ‘মূলধারার গণমাধ্যমগুলো’ কী বলে? এজন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে মূলধারা ট্যাগ পাওয়া গণমাধ্যমগুলোকে। কিন্তু তাতেও এ সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। কারণ এরই মধ্যে মূলধারার ট্যাগ পাওয়া গণমাধ্যমগুলোও একই দোষে দুষ্টু হয়েছেন।

তাদের করা খবরের শিরোনামগুলোও সমালোচিত হচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে ট্রল গ্রুপগুলোতে। যদি প্রশ্ন দাঁড়ায়— মূলধারার গণমাধ্যম কি সে আস্থার জায়গায় অনড় থাকতে পারছে? অখ্যাত অনলাইনগুলোর মতো তারাও চটকদার শিরোনামে কিংবা ভুয়া খবরে পাঠক আকৃষ্ট করার প্রতিযোগিতায় নামছে কিনা! জবাব হতাশাজনকই বটে। প্রতিনিয়তই মূলধারা ট্যাগ পাওয়া গণমাধ্যমগুলোর সমালোচনাও সামনে আসছে। বরং দিন দিন তা বাড়ছে। এই নিবন্ধ লেখার সময়ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমে আলোচিত নায়িকা পরীমনিকে নিয়ে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যমেরই অনেক বোদ্ধাজন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেনÑ শিরোনামের সঙ্গে সংবাদের কোনো মিল নেই। শুধু আজকের প্রকাশিত সংবাদ নয়। পরীমনিকে নিয়ে গত কয়েকদিনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অধিকাংশ খবরই সমালোচিত হয়েছে। সমালোচনা শুধু ফেসবুক বা টুইটারে নয়, তুমুল সমালোচনা হয়েছে খবরের লিংকের মন্তব্যের ঘরেও। কোনো কারণে যদি ধরেও নেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমালোচনা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছায় না, তবে প্রকাশিত খবরের মন্তব্যের ঘরেরটা তো নিশ্চয়ই চোখ এড়ায় না। সেখান থেকে তো শোধরানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু শোধরাচ্ছে না। প্রতিদিনই এমন শিরোনাম সামনে আসছে।

আর সমালোচিত হচ্ছে সাংবাদিকরা। যারা এমন খবর পরিবেশন করেন, তারা যেন জেনে-বুঝেই করেন। গালি বা সমালোচনায় তাদের কিছু যায় আসে না। যারা সাংবাদিকই না বা ভুঁইফোঁড় বলে দাবি করি যাদের তারা এমন করলে অসহায়ভাবে হলেও কিছুটা মেনে নেওয়া যায়। তাদের থেকে এমনটা পাওয়াই স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তাদের প্রতিহত করার কৌশল নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু ওই সমস্যা সমাধানের আগে যখন মূলধারার গণমাধ্যমের মধ্যে ব্যাপক হারে একই সমস্যা সংক্রমিত হতে দেখা যায় তখন সমাধানের পথ একটু বেশিই জটিল মনে হয়। মাথায় পচন ধরলে যেমনটা হয় আর কী। তবে এক্ষেত্রেও সমাধান নেই মোটেও তেমন ভাবার কারণ নেই।

এক্ষেত্রে সমাধানেও ওই মাথাকেই বেছে নিতে হবে। তার আগে দেখতে হবে কেন এমন শিরোনাম বা খবর প্রকাশিত হচ্ছে? প্রথম শ্রেণির একটি নির্ভরযোগ্য পত্রিকার অনলাইনে কেন এমন শিরোনাম দেওয়া। তাদের লাভ কী? এত সমালোচনার পরও কেন নিজেদের শুধরে নিচ্ছে না? কারণ ওই লাভ-ক্ষতি। বাণিজ্যিক। অনলাইনে যে খবরে বেশি হিট হবে অর্থাৎ বেশি পঠিত হবে সে খবর প্রকাশ করে লাভ বেশি। গণমাধ্যম অনেক আগেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। যেহেতু বিনিয়োগ আছে, উপার্জনও করতে হবে। বেশি উপার্জনের কৌশলই এখানে মুখ্য বিষয়। আর যে কোনো বিষয় যখন ব্যবসায়ী রূপ পায় তখন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে ভোক্তার চাহিদার বিষয়টি। ভোক্তা যে ধরনের পণ্য বেশি গ্রহণ করে ব্যবসায়ীরা ওই পণ্যই বেশি সরবরাহ করবে। এজন্য মার্কেটিং কলাকৌশল প্রশিক্ষণ বা নিয়মিত গবেষণাও করেন বিশেষজ্ঞরা। এসব গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো ভোক্তার মন বিশ্লেষণ। ভোক্তা যেহেতু মন ও মস্তিষ্কের দ্বারা পরিচালিত হয়। পণ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তার প্রভাব ব্যাপক। এজন্য ভোক্তার মন-মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা হয়। সে অনুযায়ী পণ্য বাজারে ছাড়া হয়। খবরকে যদি পণ্য ধরা হয়, এই পণ্যের ভোক্তা হচ্ছে পাঠক। তাই স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা পাঠকের মন নিয়ে গবেষণা করবেন, সে অনুযায়ী খবর সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন। করেনও তাই। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে ভিতর থেকেই জানি। প্রতিনিয়ত মিটিং, প্ল্যানিং হয়, কোন ধরনের খবর পাঠক বেশি গ্রহণ করে। সেই খবরই দিতে হবে। তাই এ পর্যায়ে আলোচনায় আসে বাঙালি পাঠকের মন। এ অংশের আলোচনায় প্রথমেই স্মরণ করছি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আর্থার ব্রুস ম্যাকডোনাল্ডের একটি বাণী। তিনি বলেছেন ‘মনের উপর কারও হাত নেই। মনের উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করা বৃথা।’ কথাটির সঙ্গে আমি খুবই একমত। বিশেষ করে বাঙালি পাঠকের মনের ক্ষেত্রে। এ মনের নিয়ন্ত্রণ যে কার ওপর তা কেউ-ই জানে না। স্বয়ং মন নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিও জানে না। কখন কী চায়, কার কথা শোনে, কোনটা বলবে, বলা উচিত বা কতক্ষণ তা ধারণ করবে কিছুই জানে না। তবে বলে। বলার জন্য বলে। এখন যে বিষয়ের পক্ষে বলছে হয়তো কিছুক্ষণ পরই তার বিপক্ষে বলতে একটুও দ্বিধা হচ্ছে না। যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছে সেটির পেছনেই আবার ছুটছে। যেদিন পরীমনির ‘ডোন্ট লাভ মি, বিচ’ লেখার খবর প্রকাশ নিয়ে সাংবাদিকদের পি-ি চটকানো হলো, সেদিন আরও ভালো ভালো খবর ছিল। গণমাধ্যমগুলো প্রকাশও করেছিল। কিন্তু পাঠক বেছে নিয়েছে ওই পরীমনির ‘ডোন্ট লাভ মি, বিচ’। লাখ লাখ ভিউ এসেছে ওই বিতর্কিত খবর থেকে। শবনম ফারিয়ার আম খাওয়ার নিউজ যে পরিমাণ পঠিত হয় অত পঠিত হয় না পদ্মা সেতুর কাজের সমীকরণ নিয়ে করা নিউজটি। তবে কেন গণমাধ্যম শবনমের আম খাওয়ার নিউজ করবে না? একটি স্কুলের সামনে আইসক্রিমওয়ালা দাঁড়াবেনই। এখানে আইসক্রিম বিক্রেতা নিশ্চয়ই আইসক্রিমের উপকার আর ক্ষতির দিক নিয়ে পর্যালোচনা করতে বসবেন না। বাচ্চাদের স্বাস্থ্যগত বিষয় বিবেচনার দায়িত্ব ওই আইসক্রিম বিক্রেতার নয়।

এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক কিংবা শিক্ষকদেরই ভাবতে হবে। যদি তারা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যগত দিক বুঝিয়ে আইসক্রিম খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারেন বা শিক্ষার্থীরা নিজেরা বুঝে আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ করেন তবেই ওই আইসক্রিম বিক্রেতা আর ওই স্কুলের সামনে যাবেন না। কারণ ওখানে তা বিক্রি হয় না। তখন তিনি ব্যবসার কৌশল বদলে বাচ্চাদের প্রিয় খাবারটি নিয়েই হাজির হবেন। তখন ওই আইসক্রিম বিক্রেতাও গবেষণা করবে, বাচ্চারা কেন আইসক্রিম খায় না। গবেষণা করে যখন বুঝবেন, স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় বাচ্চারা আইসক্রিম খাচ্ছে না। তখন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বিক্রি করতে উদ্বুদ্ধ হবেন। এখানে বাচ্চাদের উদাহরণ উল্লেখ করা হলেও খবরের পাঠক কিন্তু বাচ্চাদের মতো নন।

শিক্ষিত শ্রেণিই গণমাধ্যমের পাঠক। তাদের জন্য খবরে প্রভাব রাখা আরও বেশি সহজ। তারা তো সচেতনভাবে ভালো খবরগুলো পড়তে পারেন। চটকদার শিরোনাম পরিহার করতে পারেন। তারা কেন এত সমালোচনা করেও ওই চটকদার খবরেই বেশি আগ্রহ দেখান? পাঠক যদি সচেতন হন, ভালো খবরে আগ্রহী হন, সমালোচনা করার মতো খবরগুলো ত্যাগ করেন; তবে গণমাধ্যমও নিশ্চয়ই ওপথে হাঁটবে না। তারাও যতœসহ ভালো খবরগুলো প্রকাশ করবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেহেতু এত বিশ্লেষক, এত বিশেষজ্ঞ দেখা যাচ্ছে সেহেতু তারাই সিদ্ধান্ত নিক তারা আইসক্রিম খাবে নাকি স্বাস্থ্যসম্মত ডিম সিদ্ধ খাবে? আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের রুচিমাফিক খবর পরিবেশন করতেই প্রস্তুত।

রনি রেজা : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক

 
Electronic Paper