ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুস্তাফা স্যারের চলে যাওয়া

শহীদ ইকবাল
🕐 ১:০৮ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০১৮

অনেক সময়ই তাঁকে দেখেছি। একবার সরাসরি সান্নিধ্য হলো। সময়টা সম্ভবত সাতানব্বইয়ের দিকে। আমার প্রয়াত এক শিক্ষক বললেন, মুস্তাফা স্যার আসবেন, তুমি তাঁকে রিসিভ করবে। তখন ঢাকা-রাজশাহী যোগাযোগ সহজ ছিল না। যমুনার ওপর ব্রিজ নেই।

দিনরাত মিলিয়ে সে জার্নি। ‘সুন্দরম’ পত্রিকার সম্পাদক মুস্তাফা স্যারকে কাগজেই চিনি তখন কিন্তু দেখিনি কখনো। অনুমান-মাফিক স্যার এলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে যখন নামছেন, তখন দীর্ঘদেহ, প্রখর ব্যক্তিত্ব আর ফর্সা মুখশ্রী দেখেই বোঝা গেল- ইনিই সেই কাক্সিক্ষত ব্যক্তি। লাগেজ যখন নামানো হচ্ছিল, কাচুমাচু স্বরে পরিচয় দিয়ে আমি যখন ওই কাজে একটু সমীহপ্রবণ হয়ে উঠি- তখন বললেন, এই ছেলে তুমি ছাড়, এখনো সামর্থ্য আছে। আমার তো তখন ধুলোঝড়ের দমকা বাতাসে থমকে দাঁড়ানোর অবস্থা। আমি ইতস্তত করে রিকশা নিতে গেলাম, তারপর তাতে উঠিয়ে জুবেরী ভবনে আনলাম। স্যার ‘সুন্দরম’ এনেছিলেন, থরে থরে সাজিয়ে। আমাকে বললেন, তুমি বিশ্ববিদ্যালয় নিউজ সেন্টারের সিদ্দিককে ডাকো। তথাস্তু। আমি ডেকে আনলাম। তারপর কথা প্রসঙ্গে সিদ্দিককে বললেন, কাবুলিওয়ালা হয়ে তো আসিনি- তুমি প্যাকেটটা নিয়ে যাও। আমি খুব তীব্রভাবে এ ব্যক্তিত্বকে লক্ষ করি। যা হোক, পরে দেখেছি, কার্যত তিনি এসেছিলেন একটি এম.ফিলের ভাইভার কাজে। অনেকক্ষণ ধরে সে মৌখিক পরীক্ষাটি তিনি নিয়েছিলেন। পরে প্রতিনিয়ত তাঁর প্রচুর লেখার সঙ্গে পরিচিত হই। তখন তার সম্পাদিত ‘বাঙালী : বাংলাদেশ’ সম্ভবত এমন একটি বই সাগর পাবলিশার্স থেকে বেরিয়েছিল। তাতে ‘বাংলা’ নামের ভূখণ্ড, বাংলা ভাষার রাষ্ট্র ও বাঙালি পরিচয়টা একদম হাতে গুণে পেয়ে গিয়েছিলাম। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ থেকে শুরু করে অনেক মনীষীর লেখা ছিল তাতে। মুস্তাফা স্যর মূলত সম্পাদনার কাজ কিংবা জাতীয় দৈনিকে লেখালেখির কাজ খুব দায়িত্ব নিয়ে করতেন। এ দায়িত্বশীলতা তার গৎবাঁধা ছিল না। এক অর্থে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালিত্বেও যে অভিন্ন- সেটা নানাভাবে যৌক্তিক ইতিহাসের ভেতর দিয়ে মেধা ও মননে তিনি প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিলেন। এ প্রতিষ্ঠায়, বাঙালির প্রান্তিক বা ব্রাত্য সত্তা, জনতার ঐক্য, পাকিস্তানি অপশাসন, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাঞ্জল সত্যে তিনি নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে আনেন। এজন্য টেলিভিশনে ‘মুক্তধারা’ বা ‘কথামালা’র মতো অনুষ্ঠানও তিনি দীর্ঘ সময় ধরে করেছেন। এসব অনুষ্ঠানগুলোও ছিল মৌলিক চিন্তার অনুসারী। বিশেষ বাচনে তিনি কথা বলতেন। লেখার মধ্যেও সে বাচনটি ফুটে উঠত। শব্দ ও বাক্যের মধ্যে উক্তির প্রযোজনায় এক ধরনের ভিন্নতা আনতেন তিনি। সেটি অবশ্য কোনো বিশেষ কারণে নয়, ভঙ্গিও নয়; কথনটাই মূলত তাতে উঠে আসত। সে কথনটা বেশ শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং দ্যুতিময়তায় উত্তীর্ণ বলা যায়। এমন বাক্যের সমাবেশ প্রাবন্ধিকদের মধ্যে তেমন একটা দেখা যায় না বরং বিপরীতে এ ধরনের লেখা সমালোচিতই হয়। কিন্তু নিজের মতো করে তিনি কাজটি করেছেন, নিশ্চিন্ত মনে ও আত্মবিশ্বাসে কারও দিকে না তাকিয়ে তা তিনি করে গেছেন।
পুলিশ অফিসার সা’দত আখন্দের সন্তান, চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুলের ভ্রাতা মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আশ্চর্য, নিপুণ, চুলচেরা হিসেবি জীবনযাপন করতেন। বলাইবাহুল্য, নিজের পরিচয়েই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। স্বল্পাহারি, ক্যালকুলেটিভ, পরিশ্রমী- প্রখর ব্যক্তিত্বময় স্পষ্টভাষী মানুষ তিনি। পরিণত বয়সে চলে গেলেও ঠিক একে চলে যাওয়ার মধ্যে আমরা নিতে পারি না। কারণ, প্রতিনিয়ত তিনি আমাদের মধ্যে থাকবেন। সেটি কেমন থেকে যাওয়া বা কী রকমেরই বা বেঁচে থাকা! আমাদের প্রজন্ম তাঁর কাছে অনেক শিখেছে- সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা, বঙ্গভ‚মি ও বাংলাদেশ, বাঙালিত্ব প্রভৃতি বিষয়ে। যে বিষয়গুলো তাঁকে রপ্ত করতে হয়েছিল অনেকটা এককভাবেই প্রায়। এক্ষেত্রে পাইওনিয়ার তিনি। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য-বিবরণীও আমরা পাই তার কাছ থেকে। আর তাঁর কয়েকটি সত্তার মধ্যে একটি ছিল শিক্ষক-সত্তা। সে সত্তাটিতে তিনি একক। পড়াতেন, পড়তেন- সে লক্ষ্যে নিয়মানুবর্তিতা, সময়যোগ, নীতিনিষ্ঠা একপ্রকার অতুলনীয়ই বলা যায়। শেষ কাল পর্যন্তও তিনি ছিলেন অক্লান্ত, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীর মতো। নিছক কোনো স্তুতি নয়, বিপরীত সমালোচনাও তাঁকে নিয়ে হয়েছিল- অনেকেই বলতেন অ্যাকাডেমিক লাইনে তাঁর কোনো মৌলিক কাজ নেই প্রভৃতি। এটা হয়তো ঠিক, একজন মানুষ যে নিজের হয়ে ওঠা (self-made manshift) সেটি তাঁর নিজের মতো; মেধার তারতম্য মানুষে-মানুষে থাকবে, থাকেও- কিন্তু কোনো জিনিস ধরে রাখা, তীর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া, নিষ্ঠার সঙ্গে প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া, দায়িত্বশীলতার ভেতর দিয়ে জীবনের মৌলিক শিক্ষাটা দেওয়া-  সেটা তিনি করেছেন। এবং এজন্যও কিছু শ্রম-নিষ্ঠা ও দক্ষতা দরকার। মুস্তাফা স্যার অসাধারণ মেধার অধিকারী হয়তো ছিলেন না- সে প্রশ্ন নানাভাবে আসতেই পারে কিন্তু কোনো কাজের ক্ষেত্রেই তিনি অসফল হননি। যখন জাতীয় জাদুঘরের দায়িত্বে ছিলেন, শিক্ষকতায় ছিলেন, অ্যাকাডেমিতে ছিলেন- কোথায় অরুচিকর তো নয়ই, পরিচ্ছন্ন এক ব্যক্তিত্বেরই প্রসূন লক্ষ করা গেছে। ঘটেছে চিন্তা-ভাবনার মসৃণ- দীপ্তিময় প্রকাশ। সম্প্রসারণও ঘটেছে। একপ্রকার প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বও ছিল তিনি। সে ব্যক্তিত্বের কাছে অনেক মেধাবী মানুষও মাথা নত করেছেন, সন্দেহ নেই। মেধার মূল্যায়ন কীভাবে করতে হয়? এটা তিনি জানতেন আবার মেধার লালন-পালন কীভাবে করতে হয় তাও জানতেন। বিদ্বেষ-ঈর্ষার দিকে কখনো তিনি পা মাড়াননি। ফলে, ব্যক্তিত্বের মধ্যে দম্ভ ছিল না, অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার একপ্রকার সম্মিলনই ঘটেছিল- তার মধ্যে। এটা বুঝতে পারা যায়, আমরা যারা তাঁর সরাসরি ছাত্র হতে পারিনি কিন্তু তবুও তিনি বরাবরই শিক্ষকের মতোই ছিলেন। শিক্ষক না হয়েও তিনি শিক্ষকতা করেছেন, সর্বত্র। এমনকি অবসরের পরও শিক্ষকতার দায়িত্ব তিনি তৎপরতার সঙ্গে করেছেন। পরিচ্ছন্নতাই ছিল স্যারের আদর্শ। সেটি সর্বপ্রকার কাজের ক্ষেত্রেই। কামরুল হাসানের করা ‘সুন্দরম’ পত্রিকার প্রচ্ছদ এবং সেটি একক ‘কর্তৃত্ব’বলে দীর্ঘ সময় পরিচালিত করা, সেখানে লেখক তৈরির কাজ করা, লেখকের লেখক হওয়ার কাজ কিংবা লেখা নির্বাচন- সবই সেই লেটার প্রেসের যুগের- যোগাযোগহীনতার যুগে তা একাই সম্পন্ন করেছেন।


বাংলাদেশ তো এখন খুব দ্রুত সম্প্রসারণশীল রাষ্ট্র। মানুষের পরিবর্তন হয়েছে। যোগাযোগে অভ‚তপূর্ব সাফল্য হয়েছে। সমাজ-অর্থনীতিতেও মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনগুলো যুগ ও হাওয়ার ছন্দে ঘটেছে। এই ঘটন কোনো অঘটন নয়। কিন্তু আমরা বুঝি অনেক কিছু থেকে সরেও এসেছি আমরা। মানবতা, মূল্যবোধ, নিষ্ঠা, কর্তব্য, দায়িত্ব, সততা ইত্যাদি তো এখন কথার কপচানি- অনেকটা কর্পোরেট আইকনের মতো হয়ে গেছে সব। বাইরে অনেক কিছু আছে কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা। বলতে হয়, উন্নয়নের স্রোত চলছে, মানুষের আয় বেড়েছে, মহাকাশে উৎক্ষেপণের মতো কাজও হয়েছে কিন্তু দেশপ্রেম ও সততার কাজটি আমরা এখন তেমন করতে পারছি না। এসব তো এখনো জীবনের মৌলিক প্রশ্ন। ভিত্তিটার ভেতরও তাই। সেটি গড়ে ওঠে কার ওপর? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে’- এই যে লোকে-লোকে মানুষের আহ্বান, সে আহ্বানের তরে কে আছেন! কে তার প্রতীক্ষা করবেন। কে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। এই প্রশ্নে মুস্তাফা স্যার নিবিড়ভাবে রবীন্দ্রচর্চাও করেছেন, জীবনের আহ্বানকে প্রাত্যহিকরূপে খুঁজেছেন- এবং তার চর্চাও করেছেন। এই চর্চার ভেতরে তাঁর ব্যবহারিক দিক ছিল, বাঁচার শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল, চিন্তার আকুতি ছিল, সূর্যোদয়ের আহ্বান ছিল। শুধু তাই নয়, নজরুলচর্চাতেও তিনি প্রচুর সৃজনশীল ছিলেন। এই সৃজনশীলতার ভেতরে বাংলাদেশ ও বাঙালির চিন্তাদর্শনকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। বাঙালির জয়, বাংলার জয়- এমন হাজার বছরের মানবতাবাদী দর্শনের অফুরন্ত আলোক উৎসবকে তিনি সকলের সামনে তুলে ধরেন- রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলচর্চার প্রত্যয়ে। হয়তো এ কাজটি তার মতো আরও অনেকেই করেছেন কিন্তু তিনি নিজের মতো করে উৎস সন্ধান করেছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন- বিশ্লেষণ করেছেন- প্রচুর পঠন ও চিন্তন-কাঠামোর ভেতর দিয়ে। মূল্যবোধের আলোকে যা একপ্রকার দ্যুতিময়। এবং পরিব্যাপ্তও বটে। বস্তুত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যা বিশ্বাস করতেন তাই করতেন। তিনি যা বুঝতেন যা অর্জন করেছেন- তার আলোকেই কথা বলতেন, কাজ করতেন। এবং এই চর্চাটা কোনো বিশেষ সময়ে নয়, আমৃত্যু-আজীবন তিনি করে গেছেন। এজন্য কোনো চাতুরীপনার বা স্বার্থবাদিতার প্রশ্রয় নেননি। বিবেকের কাছে সর্বদা সমর্পিত থেকেছেন। এই শেষ দিনেও তিনি নির্মোহ ও নিঃসম্পদ থেকে গেছেন। এ এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত- আর এ লক্ষ্যেই তাঁকে পাথেয় জ্ঞান করি।


‘পৃথিবী প্রবীণ আরো হয়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে; বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে’- জীবনানন্দ দাশ এরকম কথা বলে আমাদের কতভাবে ঋণী করেছেন; প্রবীণ পৃথিবীতে সবই নশ্বর, এই নশ্বরতা অস্বীকার করতেই চলতে হয় মানুষকে, বেঁচে রাখতে হয় মানবতাকে- বিবর্ণ প্রাসাদ আর কীই বা ধারণ করতে পারে! এই মানবসত্য মানুষ কি আদৌ জীবনের তরে বুঝতে পারে? গঠন-পুনর্গঠন তো সভ্যতার দান। কিন্তু মানুষের তরে কী রয়ে যায়! এমন মৌলিক অনেক প্রশ্ন এখন নির্বাপিত প্রায়। সেখানে মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা অহংকার প্রায় নিঃসহায়ের মতো। সময়ের সংকটে বড় হয়ে উঠেছে স্বার্থপরতা আর বিচ্ছিন্নতা। পরার্থপরতার মূল্য নেই। গুণীর কদর নেই। জীবদ্দশায় তা হয় খুব কম। কিন্তু মুস্তাফা স্যার হয়তো এ থেকে একটু আলাদা। তিনি সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু ভয় হয় এ সৌভাগ্য সবার হয় না। জ্ঞানীরা তো এখন প্রায় নির্বাসিত। বুদ্ধিজীবী সমাজশূন্য। এ সমাজশূন্যতার ভেতরে মুস্তাফা স্যাররা পঠিত হবেন, নানাভাবে- একেবারে চলতি সমাজপ্রবাহের বিপরীতে থেকেই। বোধ করি, সেইটিই তাদের আদর্শ। মুস্তাফা স্যার সবকিছুর ঊর্ধ্বে চির-অমলিন থাকবেন- বস্তুত, তাঁর চির-কল্যাণধর্মের ভেতরেই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

শহীদ ইকবাল : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

 
Electronic Paper