ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গানের সঙ্গে বয়ে চলছি

শ্রীকান্ত আচার্য
🕐 ১২:৪১ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০১৮

ঝটিকা সফরে একদিনের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন শ্রীকান্ত আচার্য। অবশ্যই গান গাইতে। সুরের ধারার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমন্ত্রণ ছিল। ১২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে গানের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় সেই অনুষ্ঠানে রওনা হওয়ার ঘণ্টাদুয়েক আগে নিজের হোটেল কক্ষে এ নাছোড় ভক্ত সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন। কথা ছিল আধা ঘণ্টা সময় দেবেন।

কিন্তু গল্প আর খালি গলায় সাক্ষাৎকারের প্রয়োজনে গান গাইতে কেটে গেল দেড় ঘণ্টা। এত বড় একজন শিল্পীকে আমার মতো অভাজন সাংবাদিকের সামনে মন খুলে কথা বলতে দেখে অভিভূত হলাম। আমি, খোলা কাগজের প্রতিনিধি, জগন্নাথ বিশ্বাস, প্রশ্ন কয়েকটা করেছি বটে, আসলে ছিলাম মুগ্ধ স্রোতার ভূমিকায়। সাক্ষাৎকার দিয়ে ‘অতিশয় অসময়ে অভাজন পরে অযাচিত অনুগ্রহ’ করেছেন শ্রীকান্ত আচার্য...

শুনে খুব অবাক লাগে, শ্রীকান্ত আচর্যের মতো এমন মেলোডিয়াস গায়ক প্রায় ৩৩ বছর মার্কেটিং কোম্পানিতে চাকরি করে কাটিয়েছেন। কীভাবে সম্ভব হলো তা?
আসলে ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে। আমার পরিবারে গান-বাজনার চল ছিল না। আমিও কোনোদিন গান-বাজনা করব ভাবিনি। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুতও করিনি। প্রস্তুত করিনি মানে আমি সেভাবে গান শিখিনি। যা শিখেছি তা খুব সামান্য। সচরাচর অনেকেই এমনটা শিখে থাকে। আলাদা করে বলার মতো কিছু নয়। আমার পরিবারটাও সংগীতমুগ্ধ ছিল না। যেটুকু উৎসাহ পরিবার থেকে পেয়েছি সেটুকু আর পাঁচজনও পেয়ে থাকে। বড় মুখ করে বলার কিছু নেই। তাই গান-বাজনা আমার পেশা হবে স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। পারিবারিক ঐতিহ্যে গান ছিল না। পরিবারের সবাই লেখাপড়া করে চাকরি করত। ফাইন আর্টসের দিকে কারও ঝোঁক ছিল না। আমিও গান নিয়ে স্বপ্ন দেখিনি। সহজাতভাবে যেটুকু আসত, চেষ্টা করতাম। তবে গানের প্রতি ভালোবাসা কিন্তু প্রথম থেকেই ছিল। এবার চাকরি করতে করতে মনে হলো, যে জিনিসকে এত ভালোবাসি তা থেকে আমি বোধ হয় দূরে সরে যাচ্ছি। এখানে একটু বলে রাখি, আমার চাকরিটা ছিল হার্ডকোর মার্কেটিংয়ের চাকরি। প্রচণ্ড ঘুরতে হতো। এতটাই যে গানের সঙ্গে যা যোগ ছিল তাও ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় সাত-আট বছর আমি গান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। একসময় মনে হতে লাগল, জীবন তো একটাই, যা সবচেয়ে ভালোবাসি সেই গান নিয়ে কি একবার চেষ্টা করে দেখব না? এ ভাবনা আসার পর থেকে চাকরিতেও একটা ঝামেলা শুরু হলো। আমরা যে কোম্পানিতে চাকরি করতাম, সেখানে মটিভেশনে সমস্যা হচ্ছিল। আমরা মার্কেটে প্রচণ্ড পরিশ্রম করছিলাম। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের সেভাবে মূল্যায়ন করছিল না। এতে আমরা উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। আমি একা নই। আমরা মানে আমাদের যে বড় মার্কেটিং টিম ছিল, এ হতাশা থেকে তাদের কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিল। এটা দেখে মনে হলো ধুর, আর চাকরিই করব না। কিন্তু চাকরি না করে কী করব সে সম্পর্কে আমার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। তখন মনে হলো গান-বাজনা করব। কিন্তু মনে হলেই তো আর করা যায় না। একটা আর্থিক নিরাপত্তার প্রশ্ন থাকে। যেভাবেই বলি না কেন গান-বাজনা কিন্তু আমাদের দেশে সেভাবে আর্থিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় না। সুতরাং আমরা কয়েকজন বন্ধুরা শলাপরামর্শ করে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ব্যবসাতেও তো প্রচুর সময় দিতে হয়। কিন্তু সেখানে ব্যাপারটা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে, একটা স্বাধীনতা থাকে। নিজের মতো করে সময় বের করা যায়। কারও গোলামি করতে হয় না। চাকরিতে যেমন কোম্পানির কথামতো উঠতে-বসতে হয়, নির্দেশ পলন করতে হয়। নিজের জন্য কোনো সময় বের করা যায় না। ব্যবসা করলে এটা থেকে মুক্তি পাব এবং গানের পেছনে সময় দিতে পারব। এমন একটা ভাসা ভাসা অপরিকল্পিত ভাবনা এবং গান গেয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার একটা অস্পষ্ট উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে, আমি একদিন দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। অগ্রপশ্চাৎ কিছুই না ভেবে। এখন হয়তো ব্যাপারটা সহজ মনে হবে কিন্তু কাজটা তখন আমি ঠিক করিনি। তবে চাকরি ছাড়ার অল্প দিনের মধ্যে আমার কাছে অভাবনীয় একটা সুযোগ এসে গেল। আমার শুভানুধ্যায়ী দাদার মতো এক ব্যক্তি আমাকে কলকাতার একটি অডিও কোম্পানিতে রেফার করলেন। আমি অবশ্য কিছু প্রত্যাশা করিনি। আমায় কেউ চেনে না। গানের চর্চাও খুব করিনি। আমার গান লোকে শুনবে কেন?
 
অডিও কোম্পানির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগেই বোধ হয় আপনি ঘরে বসে একটা ডেমো ক্যাসেট তৈরি করেছিলেন?
হ্যাঁ, দাদার রেফারেন্সে ওখানে যাওয়ার আগে আমি ঘরে বসে একটা ডেমো ক্যাসেট তৈরি করি। ওটাই কোম্পানিতে জমা দিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, ভদ্রতার খাতিরে এ ক্যাসেটটা নিচ্ছে বটে, শুনবেও হয়তো কিন্তু পাত্তা দেবে না। কোম্পানি আমার গান শুনে পছন্দ করে। এবং আমার সঙ্গে একটা এক্সক্লুসিভ চুক্তিতে আসতে চায়। তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তাবটা শুনে আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে, কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছিলাম না। তাই আমাকে যখন অডিও কোম্পানিটি চুক্তিপত্রে সই করতে বলে তখন আমি সময় চেয়েছিলাম। কোম্পানির লোকেরা আমাকে বলল, আপনি সময় চাইছেন কেন? আপনার হাতে তো কোনো অফার নেই। আসলে প্রস্তাবটা শুনে আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। যেখানে কিছু প্রত্যাশা ছিল না সেখানে এমন অবিশ্বাস্য প্রাপ্তিতে আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম কত মানুষ কত মেহনত করে, আমার চেয়ে তারা প্রতিভাবানও। স্রেফ একটা সুযোগের অভাবে তারা কিছুই করতে পারেনি। অথচ আমার সামনে অযাচিত সুযোগ। আমার তো হারাবার কিছু নেই। তাছাড়া চাকরি ছেড়ে তখন অন্ধকারে পথ খুঁজছি... তাই ভাবলাম চেষ্টা করে দেখা যাক। ফল কী হবে তা তো জানা নেই। আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। অ্যালবাম রেকর্ড হলো। ভেবেছিলাম সুপার ফ্লপ হবে। কিন্তু ওটা সুপার হিট হয়েছিল।

এটা তো ১৯৯৬ সালের ঘটনা। অ্যালবামের নাম ‘মনের জানালা ধরে’.... বাংলা গানের শ্রোতার কাছে পৌঁছে গেলেন শ্রীকান্ত আচার্য....
ফিরে তাকালে এখন মনে হয়, চেষ্টা করেছিলাম, ভাগ্যেরও সাহায্য পেয়েছি। ওই অ্যালবামটাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারপর থেকে গানের সঙ্গে বয়ে চলছি।

শুনেছি অডিও কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি, অ্যালবাম রেকর্ডের খবর... সবার কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন.... অর্ণাদি জানতেন?
আমি কাউকে কিছু বলিনি। গোপন রেখেছিলাম। ভয় ছিল ক্যাসেট ফ্লপ করলে তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। তাছাড়া মামারা জানতে পারলে হয়তো বলবে, চাকরি ছেড়ে কী ক্যাসেট-ফ্যাসেট করছ.... কারণ আমার মামারাও ছিলেন চাকরি ওরিয়েন্টেড। তবে অর্ণা (শ্রীকান্ত আচার্যের স্ত্রী অর্ণা শীল) জানত। এত বড় একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার ওকে না জানিয়ে কী হয়। ও খুব উৎসাহ দিয়েছিল।

চাকরির সময় গান আর করবেন না ভেবে নিজের হারমনিয়াম নাকি বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলেন?
সাত্যি তাই। আমারই এক বন্ধুকে দিয়েছিলাম। বাসায় পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। যন্ত্র না বাজালে নষ্ট হয়ে যায়, তাই বন্ধুকে দিয়েছিলাম। আমার নিজেরই অবাক লাগে। গান ছেড়ে দেওয়া, চাকরি ছেড়ে আবার গানে ফেরা এবং সাফল্য... সব অদ্ভুত ব্যাপার আমার জীবনে ঘটেছে। সত্যি সত্যি ঘটেছে।

বাংলা আধুনিক গানের হাত ধরে প্রথম সাফল্য পেয়েছিলেন। এরপর রবীন্দ্রসংগীত গেয়েও সমান জনপ্রিয়। গয়ক হিসেবেও নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন... গায়ক শ্রীকান্তের ক্রমবিবর্তনে রেওয়াজের ভূমিকা কতটুকু?
ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত আমার গান-বাজনার শিক্ষা খুব অল্পই। আমি ১০ বছর কলকাতায় ‘দক্ষিণী’তে গান শিখেছি। মূলত রবীন্দ্রসংগীত। দক্ষিণীতে তখন নামজাদা কেউ ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে দক্ষিণীর একটা নিজস্বতা ছিল। সেই ঘরানা অনুসরণ করেই আমি গান শিখেছি। সংগীতে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে ওটুকুই। রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া আমি অন্য যে গান গেয়েছি, তার সবই কিন্তু শুনে শেখা। রেডিও এবং ক্যাসেট শুনে শুনে। আমি এখনো আগে একজন লিচেনার (শ্রোতা) তারপর পারফরমার। আমি শোনাকে ভীষণ গুরুত্ব দেই। নিজেকে টপ ক্লাসের লিচেনার মনে করি। গাওয়ার চেয়ে আমি শোনাকে প্রাধান্য দেই। এখনো আমি গান হোক কিংবা ইন্ট্রুমেন্ট... খুব গভীরভাবে শোনার চেষ্টা করি। আমি ক্লাসিক্যাল মিউজিক এবং ইন্ট্রুমেন্টের খুব ভক্ত। কিন্তু সেভাবে গুরুর কাছে গিয়ে আমি কখনো ক্লাসিক্যাল শিখিনি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার শিক্ষা খুব দুর্বল। গানে আমি স্বল্প শিক্ষিতও নই। বরং অশিক্ষিত বলা যেতে পারে। সামান্য কিছু যদি শিখে থাকি, তা শুনে শুনে। এটুকুই আমার ঋদ্ধি। এটুকুই আমার সম্বল।

কবীর সুমন কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এ প্রজন্মের সবচেয়ে মেলোডিয়াস কণ্ঠের অধিকারী শ্রীকান্ত আচার্য...
(প্রশ্নটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে) এটা (কম্পিলিমেন্ট) সুমনদার মহানুভবতা। আমি সুমনদার স্নেহ পেয়েছি, এ প্রশংসাটুকু তার স্নেহের নিদর্শন হিসেবেই দেখি। (চলবে)

 
Electronic Paper