ইউনানি ওষুধের প্রতারণা
মো. ওসমান গনি
🕐 ৯:৪৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১১, ২০১৮
একজন মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে-স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। যার স্বাস্থ্য ঠিক তার কাছে দুনিয়ার সবকিছুই ভালো লাগে। হেসেখেলে মনের আনন্দে কাজ করে স্বচ্ছলভাবে চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। দেশের এক শ্রেণির অসাধু মানুষ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ চক্রটি রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। আর অপরদিকে দেশের এক শ্রেণির নিরীহ মানুষ তাদের রোষানলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে হারবাল ও ইউনানি চিকিৎসার নামে চলছে ব্যাপক প্রতারণা। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি, হাকিম, কবিরাজ ও ডাক্তার সর্ব রোগের চিকিৎসক সেজে দীর্ঘদিন থেকেই সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে আসছে। তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে ভেষজ ওষুধের নামে নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবন করে মানুষ আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন প্রায় সময়ে। এক রোগ সারাতে গিয়ে তারা নানা জটিল ও কঠিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু হাজারও অভিযোগ সত্ত্বেও মানুষকে প্রতারণা করা ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পদক্ষেপ নামমাত্র।
জনবহুল এলাকাগুলোয় ভেষজ ওষুধের নামে অসাধু ব্যবসায়ী ও তথাকথিত চিকিৎসকরা ফুটপাত ও দোকানে ব্যবসা জমিয়েছেন। ফার্মগেট, গুলিস্তান, গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কাওরানবাজার, মিরপুর, পল্লবীতে ফুটপাতে ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দামের এমন ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। মূলত দরিদ্ররা এসব ওষুধের ক্রেতা। অপরদিকে কলিকাতা হারবাল, দিল্লি হারবাল ইত্যাদি নামের দোকানে ভেষজ নাম দিয়ে ৯০০ থেকে ২০০০ টাকায় ওষুধ বিক্রি হয়। এসব প্রতিষ্ঠান রাস্তায় প্রচারপত্র, অপারেটরদের মাধ্যমে, স্থানীয় ডিস চ্যানেল ও বেসরকারি কিছু টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়। শনির আখড়া, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস-টার্মিনাল এলাকা, মেরুল বাড্ডা, মালিবাগ, মগবাজার, কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে অননুমোদিত এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু ওষুধে স্টেরয়েড কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। যা চিকন স্বাস্থ্যকে মোটা করতে ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধ সেবন করলে পরে রোগীর খাওয়ার রুচি বেড়ে যায় অনেক বেশি। সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য মোটা হয়ে যায়। এর মূল কারণ হলো যে কোনো মানুষ যখন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করবে তখন তার শরীরে পানি জমে শরীর ফুলে যাবে। তার কিডনি ও ফুসফুসে পানি জমে ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে বাতিল হয়ে যাবে। অবশেষে তার মৃত্যু অবধারিত। এ জন্য দেশের অ্যালোপ্যাথিক জগতের অনেক বড় মাপের ডাক্তাররাও পারতপক্ষে কোনো রোগীকে স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ দেন না। কিন্তু ইউনানি মতের যেসব কথিত ডাক্তার বা কবিরাজ রয়েছেন তাদের স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে তারা তাদের তৈরি ওষুধে হরহামেশাই এ ওষুধ ব্যবহার করছে। যা খেয়ে মানুষ মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে।
চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে যৌনোদ্দীপক ওষুধ বিক্রির প্রচারণা আমরা রাস্তাঘাটে অহরহ দেখতে পাই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারণার অভিযোগ পাওয়া যায়। ভুয়া কবিরাজ বা ভেষজ চিকিৎসকের প্রতারণায় গ্রামগঞ্জের ভেষজ চিকিৎসা কলুষিত হচ্ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভেষজ ওষুধ সংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু এ ওষুধের নামে বিশ্বব্যাপী নিম্নমানের, নকল ও ভেজাল ওষুধ রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হিসেবে দেশের ওষুধের বাজারের ২৫ শতাংশ ভেষজ ওষুধের নিয়ন্ত্রণে। দেশে আয়ুর্বেদ-ইউনানি ও হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান আছে ৫শ ওপরে। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রের হিসেবে, এগুলোর বাইরে অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান আছে কয়েক হাজার। হাঁপানি, চর্ম ও যৌন রোগ, বাত-ব্যথা, রং ফর্সা করা ও মোটা হওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ ভেষজ ওষুধ সেবন করে। এরই সুযোগ নেয় তথাকথিত হারবাল চিকিৎসাকেন্দ্র। প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ।
অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বা অল্টারনেটিভ মেডিসিন বিশ্বের সর্বত্রই স্বীকৃত। গাছগাছড়ার ভেষজ চিকিৎসা থেকে শুরু করে আকুপাংচার, হাইড্রোথেরাপি, অ্যারোমাথেরাপি ইত্যাদি ব্যতিক্রমী চিকিৎসা বিভিন্ন দেশে চালু আছে। হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ কিংবা ইউনানি পদ্ধতিতে চিকিৎসা তো অনেক দেশে সরকারিভাবে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেই দেওয়া হয়।
চিকিৎসার মূল লক্ষ্য রোগীকে সুস্থ করা। তা সম্ভব না হলে উপসর্গগুলো কমানো এবং অবশ্যই কোনো ক্ষতি না করা। তাই যে পদ্ধতিতেই চিকিৎসা দেওয়া হোক না কেন, তার পেছনে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। ভেষজ চিকিৎসা হলেও তা যথাযথ হতে হবে। এর পেছনে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। মনগড়া যা খুশি তাই করার সুযোগ কারও নেই। আমাদের দেশেও অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য চিকিৎসা পদ্ধতি চালু আছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একই সঙ্গে চালু আছে অপচিকিৎসা। বিশেষ করে ভেষজ বা হারবাল চিকিৎসার নামেই এসব অপচিকিৎসা করা হয় বেশি। রাস্তার ফুটপাত থেকে শুরু করে অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা এক-দুই রুমের ‘চেম্বার’ থেকে এসব চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফুটপাতের ক্যানভাসাররা মানুষকে বোকা সাজিয়ে প্রতারণা করছে।
জনগণকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও ভেষজ ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ভুঁইফোড় ও অসাধু প্রতিষ্ঠান। তারা বিপুল অঙ্কের করও ফাঁকি দিচ্ছে। রাস্তাঘাটে ওষুধ বিক্রি করা বেআইনি। প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেউ ওষুধ খাওয়া বা বিক্রি করাও বেআইনি। ভেজাল ওষুধ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অভিযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু তেমন কাজ হয়নি। রাস্তায় যারা ওষুধ বিক্রি করে তারা শক্তিশালী। না হলে তারা কীভাবে পুলিশ প্রশাসনের সামনে এ কাজ করছে।
উল্লেখ্য, ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রিসে আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে। গ্রিক মনীষী হিপোক্রেটিস, যাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক বলা হয়-তিনিই মূলত এ পদ্ধতির প্রসার ঘটান। দক্ষিণ এশিয়ায় এ চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভব পাঁচ হাজার বছর আগে।
মো. ওসমান গনি : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]