ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বর্তমান চিত্র

হামিদা জান্নাত
🕐 ১২:৪৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৮, ২০২১

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশ জনসংখ্যায় বিশ্বে অষ্টম। জনবহুল দেশ আমাদের। সর্বশেষ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন-২০১৯ এর উপাত্ত অনুযায়ী এ জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৭ লাখ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৩%। একইসঙ্গে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। দেশে দেশে এখনো চলছে লকডাউন। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিত্যসঙ্গী হিসেবে রয়েছে মাস্ক, গ্লাভস এবং অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার। ভাবনার বিষয় হলো, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে আবর্জনার পরিমাণ। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাও।

আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবহার করার পর অব্যবহারযোগ্য যে আবর্জনা তৈরি হয় সেগুলোকে বর্জ্য পদার্থ বলে। বর্জ্য সাধারণত কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, বিষাক্ত ও বিষহীন এই পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে। পৌর এলাকার আবর্জনা, বাণিজ্যিক এলাকার আবর্জনা, শিল্প এলাকার আবর্জনা- এভাবে ময়লা সংগ্রহের সুবিধার্থে আবর্জনাকে শ্রেণিভুক্ত করা হয়। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সমস্ত জীবকুলকে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা, পরিবেশ দূষণ ও অবক্ষয় রোধের উদ্দেশ্যে আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনর্ব্যবহার ও নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়াই হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। পরিবেশের সৌন্দর্য রক্ষার কাজগুলোও এ প্রক্রিয়াতে অন্তর্ভুক্ত।

সহজ ভাষায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বর্জ্য বস্তুর উৎপাদন কমানোকে বোঝায়। উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশভেদে, শহর বা গ্রাম্য এলাকাভেদে, আবাসিক বা শিল্প এলাকাভেদে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার ধরণ আলাদা হয়। সাধারণত স্থানীয় বা পৌর কর্তৃপক্ষ আবাসিক বা প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা থেকে উৎপন্ন অবিষাক্ত ময়লাসমূহের জন্য ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। অপরপক্ষে বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকার অবিষাক্ত ময়লাগুলো ওই ময়লা উৎপন্নকারীদেরকেই ব্যবস্থাপনা করতে হয়। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে তা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরী।

এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের মোট বর্জ্যরে শতকরা ৩৭ ভাগ উৎপাদিত হয় রাজধানী ঢাকায়। করোনাকালে এই চ্যালেঞ্জ আরও উদ্বেগজনক। করোনা মহামারী শুরুর পর বর্জ্য উৎপাদনের হার বেড়েছে বহুগুণ এবং ফলস্বরূপ পরিবেশের ওপর পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। বর্তমানে মোট আবর্জনার ৭০ ভাগই হচ্ছে কোভিড আবর্জনা। এই বর্জ্যরে বেশির ভাগই কমবেশি সংক্রামক, এগুলোর মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। চিকিৎসা বর্জ্যকে অবশ্যই জনস্বাস্থ্যসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। না হলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকরী হবে না, বর্তমান নাগরিক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করত পারবে না। তাই আমাদের চাই পরিকল্পিত সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডোর) এর গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার একমাস পর উৎপাদিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় প্রায় ৩ হাজার ৭৬ টন যেখানে সার্জিক্যাল মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস এবং স্যানিটাইজারের বোতল এই বর্জ্যরে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এমনকি করোনা মহামারীর মধ্যে এখন মাস্ক রাস্তায় পড়ে থাকা একটি সাধারণ দৃশ্য। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের নির্বোধ ডাম্পিং এর ফলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে। বিপুল পরিমাণের এই কোভিড বর্জ্য গৃহস্থালি আবর্জনার সঙ্গে মিশ্রিত হচ্ছে এবং এতে অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো কোভিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্বেগকে বাড়িয়ে তুলেছে। সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণের সংস্থা আইইডিসিআরের প্রাক্তন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হোসেন বলেন, বিশেষত করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি থেকে যদি আবর্জনা সংগ্রহকারী এবং যারা তাদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠবে। প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয় তরঙ্গের মারাত্মক হুমকির মধ্যে কোভিড সম্পর্কিত বর্জ্যগুলো যথাযথ নিষ্পত্তি করা এখন সংগ্রামের মতো।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ক্লিনিকাল বর্জ্যগুলোর ভয়াবহ অবস্থার জন্য নাগরিকদের অজ্ঞতাকে দোষ দেয়। যদিও বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে এখন বর্জ্য যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করতে ধীরে ধীরে উন্নতি করছে। তবুও শহরের পরিবারগুলো থেকে কোভিড বর্জ্য পরিচালনার জন্য এখনো কোনো বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সিটি করপোরেশনগুলোতে আবর্জনা পোড়াতে বা পুনর্ব্যবহার করার সুবিধা না থাকায় অবশেষে আমিনবাজার এবং অন্যান্য নির্ধারিত জায়গায় বর্জ্যগুলো ফেলে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে যে কোভিড বর্জ্য থেকে সাধারণ গৃহস্থালি আবর্জনা বাছাইয়ে ব্যর্থতা এবং উভয় বর্জ্যরে বাতাসে মিশে যাওয়াই এই সমস্যার মূলে রয়েছে।

প্রতিদিন ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৬ হাজার ২৫০ টন বর্জ্য তৈরি হয়। কিন্তু মেগাসিটি ঢাকায় এখনো আধুনিক, টেকসই ও উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এই বর্জ্য পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা না গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. বদরুল আমিন মনে করেন, সঠিকভাবে কোভিড বর্জ্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেছেন, নিয়মিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং কোভিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া সাধারণ জনগণ এ বিষয়ে অজ্ঞ। তারা সর্বত্র মুখোশ ও হাতের গ্লাভস ফেলে দিচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তা এসএম শফিকুর রহমান জানান, তারা কোভিড বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন। তারা কোভিড বর্জ্য রাখতে পৃথক পলিথিন ব্যবহার সরবরাহ করতে বলেছেন। প্রাথমিকভাবে এটি কাজ করছিল তবে সাধারণ জনগণ এখন নিয়মিত আবর্জনার সঙ্গে কোভিড বর্জ্য মিশ্রিত করছে।

প্রিজম বাংলাদেশ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা রাজধানীর হাসপাতালগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করছে। আনিসুর রহমান জানান, তারা গত বছর দুটি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে পরিবারের কাছ থেকে সংগৃহীত কোভিড বর্জ্য আলাদাভাবে ধ্বংস করার প্রস্তাব নিয়ে বসেছিলেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। উত্তর সিটি করপোরেশনের পাঁচটি অঞ্চলে কোভিড বর্জ্য ডাম্প করা হয় এবং তা আমরা সংগ্রহ করি। তবে আমাদের প্রত্যাশিত পরিমাণ ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম পাচ্ছি না কারণ কোভিড বর্জ্যগুলো সাধারণ আবর্জনায় মিশ্রিত হয়।

মোহাম্মদপুরের মোহাম্মাদিয়া হাউজিং এলাকায় বাড়িঘর থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ফোরকান মিয়া বলেন, গত বছর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরে মুখোশ ও অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম পৃথক প্যাকেটে পাওয়া গেলেও এখন আর তা হয় না। তিনি বলেছিলেন, “গতবছর করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতে অনেক বাড়ি থেকে তাদের মুখোশগুলো আলাদা আলাদা প্যাকেট করে আবর্জনায় ফেলত। কিন্তু এখন আমরা অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গেই মুখোশ, গ্লাভস পাচ্ছি’। ডিপোতে নিয়ে যাওয়ার পরে আমরা এগুলো সমস্ত সিটি করপোরেশন পরিবহনে লোড করি।

গত বছর ব্র্যাকের করা একটি সমীক্ষা অনুসারে, করোনাভাইরাস সুরক্ষা সরঞ্জাম ও অন্যান্য মেডিকেল পণ্যগুলো থেকে প্রাপ্ত ৬ শতাংশ বর্জ্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, তবে আবর্জনার বিশাল অংশটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন পরিবারের বর্জ্যসহ ২৮২.৪৫ টন বর্জ্য সরানো হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিলে প্লাস্টিকের বর্জ্যগুলোর ১২.৭ শতাংশ ছিল অস্ত্রোপচারের মুখোশ থেকে। তখন প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মুখোশ ব্যবহৃত হয়েছিল যা কমপক্ষে ১৫৯২ টন প্লাস্টিকের বর্জ্য তৈরি করেছিল। তাছাড়া আবর্জনার ২৪.২ শতাংশ সাধারণ হাতের গ্লাভস থেকে আসে এবং ২২.৬ শতাংশ অস্ত্রোপচারের হাতের গ্লাভস থেকে।

সর্বোপরি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জনসাধারণের সচেতনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ এর বর্জ্য অন্যান্য বর্জ্যরে সঙ্গে কোনোভাবেই মেশানো যাবে না।

আমাদের সকলের উচিত “সমাধানের সঙ্গী হওয়া, দূষণের নয়”। পরিবেশের প্রতিটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। করোনাভাইরাস ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচতে চাই সর্বমহলের সচেতনতা বৃদ্ধি। সুতরাং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের আরও আন্তরিক হতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা আমাদের চারপাশকে বাসযোগ্য করে তুলতে পারব।

হামিদা জান্নাত : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 
Electronic Paper