শব্দদূষণ রোধে এগিয়ে আসতে হবে
মো. রহমত উল্লাহ্
🕐 ১:১৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৪, ২০২১
সৌদি আরব আজান ও ইকামত ছাড়া মসজিদের মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া মাইকের আওয়াজ এক-তৃতীয়াংশে সীমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। গত ২৩ মে ২০২১ তারিখে গালফ নিউজ জানায়, সৌদির ইসলামবিষয়ক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ আল শেখ এই সার্কুলার জারি করেছেন মহানবী (সা.)-এর একটি হাদিসের ভিত্তিতে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘মনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকে নিঃশব্দে পালনকর্তাকে ডাকবে। আল্লাহকে ডাকতে গিয়ে একজন অপরজনকে কষ্ট দিবে না এবং কারো তেলাওয়াত বা প্রার্থনার আওয়াজ যেন অন্যজনের কণ্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু না হয়।’ গালফ নিউজ আরও জানায়, মোহাম্মদ বিন সালেহ আল ওথাইমীন এবং সালেহ আল ফাজওয়ানের মতো জ্যেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদদের পরামর্শে সৌদি আরবে মসজিদের মাইক শুধু আজান ও ইকামতের জন্য ব্যবহারের এই নিয়ম জারি করা হয়েছে।
আমরা অনেকেই জানি না, আমাদের দেশেও শব্দদূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই বিধি অনুযায়ী ‘হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা, সেই সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয়।’ কিন্তু সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না শব্দদূষণের মাত্রা। পরিবেশ অধিদফতরের মতে, শব্দের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে দিনে সর্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল পর্যন্ত। শয়নকক্ষে এই শব্দের সহনীয় মাত্রা ২৫ ডেসিবেলের নিচে থাকতে হবে। অথচ আমাদের দেশে এই শব্দের মাত্রা ১২০ ডেসিবেল পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই মাত্রাতিরিক্ত শব্দ অর্থাৎ শব্দদূষণ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ!
শহর এলাকায় গাড়ির হর্ন হচ্ছে সর্বাধিক শব্দদূষণের কারণ। আমাদের দেশের চালকগণ প্রয়োজন ব্যতীতও গাড়ির হর্ন বাজান। সেখানে হর্ন বাজানোর কোনো প্রয়োজন নেই সেখানেও হর্ন বাজিয়ে থাকেন। যেখানে একবার হর্ন বাজালেই যথেষ্ট সেখানে ১০/২০ বার বাজিয়ে থাকেন। যার শব্দ ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবেল পর্যন্ত হয়ে থাকে। অতিরিক্ত হর্ন বাজানোর ক্ষতি সম্পর্কে চালকের অজ্ঞতা এবং বিচারহীনতা এর প্রধান কারণ। অধিকাংশ গাড়ির চালক অল্প শিক্ষিত এবং নিয়ম ভাঙার মানসিকতাসম্পন্ন বিধায় তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও জরিমানা করাই এই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায়।
রাস্তায় চলাচলের সময় শব্দদূষণে অতিষ্ঠ হয়ে বাসা-বাড়িতে ফিরে এসে যখন একটু প্রশান্তি খুঁজতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই, ইবাদত করতে চাই, শান্তিতে ঘুমাতে চাই, তখনও পড়তে হয় শব্দদূষণের কবলে! উন্নয়নশীল এলাকায় পাইলিংয়ের শব্দ, রড কাটার শব্দ, টাইলস কাটার শব্দ, ইট ভাঙ্গার শব্দ, ঢালাই মেশিনের শব্দ ইত্যাদি মারাত্মক অসহনীয় ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবল মাত্রা তো আছেই। তার উপরে আবাসিক এলাকায় রয়েছে গ্রিল ও আসবাবপত্র তৈরির কারখানা এবং বিভিন্ন দোকানপাট। সম্প্রতি আসবাবপত্র কারখানায় যুক্ত হয়েছে বিকট শব্দকারী ডিজাইনিং মেশিন! অথচ আবাসিক এলাকায় কারখানা ও দোকানপাট স্থাপন সম্পূর্ণ বেআইনি। এক্ষেত্রেও নেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আইন ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় বেশিরভাগ মানুষ। তারা মনে করে, যার যা ইচ্ছা তাই করবে এটার নামই স্বাধীনতা! তারা জানেই না, অন্যের অসুবিধা করে অন্যের স্বাধীনতা ভোগ করার কোনো অধিকার নেই। হাতেগোনা যে কয়জন এসব বিষয়ে সচেতন তারা সংখ্যালঘু বিধায় দুর্বল। তাই প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন না কেউ। যারা প্রতিবাদে এগিয়ে আসার কথা তাদের কেউ কেউ আবার করে থাকেন অন্যরকম শব্দদূষণ।
আবাসিক এলাকায় সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হয়ে থাকে লাউডস্পিকারের কারণে। ‘সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দ-নীয়’ হলেও কেউ মানছেন না এই আইন! প্রয়োগকারী সংস্থাও কার্যকর করছে না দণ্ড। জন্মদিন, খতনা, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌ-ভাত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের নামে পাড়া-মহল্লায় সারারাত বাজানো হচ্ছে লাউড স্পিকার। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের অনুসারীরাও বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে ধর্মীয় বিধান লংঘন করে একাধিক দিনরাত বাজাচ্ছে বিকট বাদ্যযন্ত্র, করছে বেফাঁস নাচ-গান। জোর করে নিজের পছন্দের গান-বাজনা শুনতে বাধ্য করছে সবাইকে! সেসব বিয়েতে অংশ নিচ্ছেন অনেক স্থানীয় ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাগণ। ফলে শব্দ দূষণরোধ করার মতো আর অবশিষ্ট থাকছে না কেউ। ছেলেপেলে মিলে প্রায়শই রাতব্যাপী করছে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানেও লাউড স্পিকারে বাজানো হচ্ছে বিকট বাদ্যযন্ত্র।
জন্মদিন, খতনা, বিয়ে, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি উপলক্ষে ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দে হারাম করা হচ্ছে এলাকাবাসীর লেখাপড়া, ঘুম ও ইবাদত! গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে এসব শব্দদূষণ। পিকনিকের গাড়িতে, স্পটে, পার্কে ও রিসোর্টে হাই ভলিউম লাউড স্পিকারে চালানো হচ্ছে ধুমধারাক্কা গান-বাজনা। এসবের প্রতিবাদ করতে গেলেই মার খাওয়ার উপক্রম হয়। প্রতিবাদকারীর পক্ষ নিচ্ছে না এলাকার জনপ্রতিনিধি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। হালকা করে বলা হচ্ছে, দু’একদিন করুক না। বাস্তবে অমুকে দু’একদিন তমুকে দু’একদিন করতে করতে এলাকাবাসীর অসহনীয় যন্ত্রণা প্রতিদিন।
অপরদিকে অধিকাংশ এলাকার বিভিন্ন মসজিদে বাজানো হচ্ছে উচ্চশব্দে লাউড স্পিকার। আজান ও ইকামত ছাড়াও বিভিন্ন সময় জিকির, গজল, হামদ, নাত, দরুদ, কেরাত, বয়ান, সবিনা ইত্যাদি করা হচ্ছে আজান পরিবেশনকারী উঁচু মাইকে। এমনও মসজিদ আছে যেখানে মুসল্লির সংখ্যা অল্প থাকা সত্ত্বেও জুম্মাবারের বয়ান, খুতবা, দোয়া পরিবেশন করা হয় আজানের মাইকেই। এমনকি জামাতও পড়ানো হয় আজানের মাইকে। ফলে বাসাবাড়িতে অতি বৃদ্ধ ও মহিলাদের নামাজের অসুবিধা হয়। তাই মসজিদে উপস্থিত মুসল্লির সংখ্যা অনুপাতে ঘরোয়া স্পিকারের সংখ্যা নির্ধারণ করে নিম্ন আওয়াজে এসব করাই উত্তম। এমন আদেশই দেওয়া হয়েছে সৌদি আরবে। এমন আইনই জারি করা আছে বাংলাদেশে। তবু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিকট লাউড স্পিকারেই করা হচ্ছে এসব, আয়োজন করা হচ্ছে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও বার্ষিক তাফসির/ ওয়াজ মাহফিল। লম্বা তার টেনে অনেকগুলো বড় বড় হর্ন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে অনেক দূরের মোড়ে মোড়ে ও বাসাবাড়ির গলিতে। বিকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সুরে চালানো হচ্ছে ওয়াজ। সর্বশক্তি দিয়ে গলা ফাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্লোগান। মানুষের কানের ভিতর জোর করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল আওয়াজ। মাজার, খানকা, মন্দিরে, প্যাগোডা ইত্যাদি থেকেও লাউড স্পিকারে ভেসে আসছে নানান রকম পরিবেশনার বিকট শব্দ। অথচ সেই মাহফিলে, মাজারে, মন্দিরে, প্যাগোডায় গেলে হয়ত দেখা যায় হাতেগোনা কিছু লোক উপস্থিত। ছোট্ট একটা ইনডোর স্পিকারেই যাদের কানে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব এ সকল পরিবেশনা।
আমাদের দেশে কেউ কেউ বলছেন, যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে জিকির, গজল, হামদ, নাত, দরুদ, সবিনা, কেরাত, কাওয়ালি, ওয়াজ, বয়ান, তাফসির ইত্যাদি তত বেশি সওয়াব। তাই সবচেয়ে পাওয়ারফুল লাউড স্পিকার লাগানো হয় এসব প্রচারের জন্য। বাস্তবে কর্মব্যস্ত মানুষ মনোযোগ দিয়ে এসব শোনার সময়-সুযোগ কোনোটাই পান না। অথচ মানুষের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয় স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি এই শব্দদূষণ। সীমার বাইরের শব্দদূষণ মাথাব্যথার কারণ হয়, ইবাদত ও ঘুমের বিঘ্ন ঘটায়, শ্রবণ ক্ষমতা ধ্বংস করে, মেজাজ খিটখিটে করে, ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়, ফুসফুস আক্রান্ত করে, মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে, বুদ্ধিমত্তা বাধাগ্রস্ত করে, লেখাপড়ায় অমনোযোগী করে, বিষণœতায় নিমজ্জিত করে, স্মরণশক্তি কমায়, পেশীতে খিঁচুনি তৈরি করে, কর্মদক্ষতা হ্রাস করে এবং আরও অনেক রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থরা। অন্যকে কষ্ট দেওয়া কোনো যুক্তিতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাই তো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, ‘মনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকে নিঃশব্দে পালনকর্তাকে ডাকবে। আল্লাহকে ডাকতে গিয়ে একজন অপরজনকে কষ্ট দিবে না এবং কারো তেলাওয়াত বা প্রার্থনার আওয়াজ যেন অন্যজনের কণ্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু না হয়।’
বর্তমানে জিকির, গজল, হামদ, নাত, দরুদ, সবিনা, কেরাত, কাওয়ালি, ওয়াজ, বয়ান, তাফসির ইত্যাদি শোনার সুযোগ মানুষের ঘরেই রয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যার যখন যেমন ইচ্ছা তেমন শুনতে ও দেখতে পারেন। এক দেশে বসে একটা মোবাইল ফোনেই এখন শোনা যায়, দেখা যায়, বিশ্বের সব দেশের বিখ্যাত সব ধর্মীয় পরিবেশনা। কারও কানের ভিতর জোর করে ওয়াজের আওয়াজ পৌঁছে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কাজের চাপে পরিবর্তিত হয়ে গেছে মানুষের দৈনন্দিন রুটিন। কেউ যদি ধর্মীয় কোনো পরিবেশনার অতিরিক্ত আওয়াজে বিরক্ত হয় তো তিনি পুণ্যের চেয়ে পাপের ভাগীদার হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে। হযরত আবু বকর (রা.) বলতেন, ‘তোমরা তাহাজ্জুদ নামাজের কোরআন তেলাওয়াত খুব নি¤œস্বরে করো। যাতে অন্য কারও ঘুম না ভাঙে’। হযরত ওমর (রা.) বলতেন, ‘আমি চাই তেলাওয়াত হালকা উচ্চস্বরে হোক। যাতে নিদ্রিত ব্যক্তির ঘুম না ভাঙে’।
এমতাবস্থায় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সকল প্রকার শব্দ দূষণ রোধে সরকারের পাশাপাশি সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা উচিত ধর্মীয় নেতা ও হুজুরদের। শব্দদূষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক ওয়াজ করা উচিত গণমাধ্যমে ও ইউটিউবে। সেইসঙ্গে এগিয়ে আসা আবশ্যক রাজনৈতিক নেতা ও শিক্ষকদের। ইমাম-মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত কেন বিভিন্ন দেশের আইনে ও ধর্মে নিষেধ করা আছে শব্দদূষণ। যাতে তারা সেই শিক্ষা প্রদান করতে পারেন তাদের শিক্ষার্থী ও অনুসারীসহ সবাইকে। তারা নিজেরা যদি শব্দদূষণ থেকে বিরত থাকেন, অন্যদের শব্দদূষণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন ও সব ধরনের শব্দদূষণ রোধে আইন প্রয়োগে সহায়তা করেন তাহলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। মানুষকে শান্তি দেওয়াই তো ইসলাম ধর্মের অন্যতম কাজ।
মো. রহমত উল্লাহ্ : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক