ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ত্যাগের মহিমা

কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুহাম্মাদ তোফায়েল আহমেদ
🕐 ১:৫০ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২১

কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ঈদ উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আদম (আ.) থেকে শুরু হওয়া এই কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই হলো সকল প্রকার ঠুনকো, যুক্তি-তর্ক থেকে আল্লাহর ওপর আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করা। যেমনটি করেছেন হযরত ইসমাইল (আ.)। আল্লাহতায়ালার হুকুম অনুযায়ী যখন ইবরাহীম (আ.)-কে বলা হলো তার প্রিয় বস্তুটিকে কোরবানি করতে। তখন তিনি পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে বললেন, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তাকে কোরবানি করতে হবে।

একথা শুনে ইসমাইল (আ.) কোনো প্রকার দুঃখ প্রকাশ না করেই সমস্ত দ্বিধা-ভয়কে উপেক্ষা করে আল্লাহর আনুগত্যকে স্বীকার করে নেন। এবং নিজেকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করে নেন। এ ঘটনা আল্লাহর হুকুমের পূর্ণ আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

হজের মৌসুমে উদযাপিত এ ঈদকে ইসলামী পরিভাষায় ঈদুল আজহা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) একে ঈদুল আজহা নামে নামকরণ করেছেন। এছাড়া ইয়াওমুন নহরও বলা হয়। জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও জাজিরার অধিবাসীরা এ ঈদকে ‘ঈদুল কাবীর’ বা বড় ঈদ নামে সম্বোধন করে থাকেন। বাহরাইনের লোকেরা ‘ঈদুল হুজ্জাজ’ বা হাজিদের ঈদ নামে সম্বোধন করেন। আর ইরান, আফগানিস্তানসহ এ উপমহাদেশের লোকেরা ‘ঈদুল কুরবান’ বা কুরবানির ঈদ নামে অভিহিত করেন। আজহা শব্দটিকে আরবিতে ‘কুরবান’ও বলা হয়ে থাকে, যা ফারসি বা উর্দুতে ‘কোরবানি’ রূপে পরিচিত হয়েছে। কোরবানের শাব্দিক অর্থ হলো- নৈকট্য অর্জন করা, কাছাকাছি যাওয়া। পারিভাষিক অর্থে ‘কোরবানি’ ওই মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হয়। প্রচলিত অর্থে, ঈদুল আজহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ তরিকায় যে পশু জবেহ করা হয়, তাকে ‘কোরবানি’ বলা হয়।

কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবিবকে লক্ষ করে বলেন, তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কোরবানি কর। (কাওছার-২)।

কাফের-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবীকে উৎসর্গ করে পশু বলি দেয়। কিন্তু মুসলমানদের জন্য আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন পশুকে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর কোরবানির পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (হজ্জ-৩৬)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর আমরা তার (ইসমাঈলের) পরিবর্তে জবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কোরবানি। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম।’ (ছাফফাত ১০৭-১০৮)।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’। (সুনানু ইবনু মাজাহ) রাসূলূল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা (জবেহ করা) অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় মানুষের কোনো আমল হয় না।’ (সুনানু তিরমিজি)।

তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রফুল্ল চিত্তে কোরবানি আদায়ের নিয়তে কোরবানি করে কিয়ামতের দিন তার এবং জাহান্নামের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।’ (আস-সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বি) এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে মদিনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবিগণও নিয়মিতভাবে কোরবানি করেছেন।

কোরবানির গুরুত্ব যেমন অপরিসীম ঠিক তেমনি কোরবানির শিক্ষা অনেক। এর মধ্যে নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তুলে ধরা হলো।

বিশ্বব্যাপী তাওহীদ প্রতিষ্ঠা : মহান আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নামেই পশু কোরবানি দেওয়া হয়। জগতের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেখানে তাদের দেব-দেবীর নামে কোরবানি করে, সেখানে মুসলিম সমাজ কোরবানি দেয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ : কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সকল আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেওয়াই হলো পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ। ঈদুল আজহার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র ঈসমাইল (আ.)-এর এরূপ পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্রই পবিত্র কোরআনুল কারীমে দেখতে পাই।

ইখলাস বা একনিষ্ঠতা : সকল কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই ইসলামের মহান শিক্ষা। ইখলাস ছাড়া পরকালীন কোনো কাজই আল্লাহতায়ালা কবুল করেন না। আন্তরিকতা ও মহব্বতবর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। তাই কোরবানিও একমাত্র আল্লাহতায়ালার রেজাবন্দি হাসিলের জন্য দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহতায়ালার আদেশ, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালার নিকট কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না। তার নিকট তোমাদের তাকওয়া (ইখলাস) পৌঁছে’। (সূরা হাজ্জ্ব-৩৭)। ইখলাসপূর্ণ কোরবানি হওয়ার কারণেই আল্লাহতায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কোরবানি কবুল করে নিয়েছিলেন।

তাকওয়াভিত্তিক জীবনযাপন : কোরবানির সুমহান দীক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবনযাপন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহতায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশন ঘটেছে। আদমপুত্র হাবিলের কোরবানি আল্লাহতায়ালা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই।

দরিদ্র ও অনাথের সুখে-দুঃখে অংশীদার : কোরবানির অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আজহার নামাজে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-অনাথের মাঝে কোরবানির গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয়, আমাদের সম্পদে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার রয়েছে।

কোরবানি মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমিন।

মুহাম্মাদ তোফায়েল আহমেদ : ছাত্র, দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদ্রাসা, ঢাকা

 
Electronic Paper