ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আয়নার ভিতর দিয়ে পথ

সালেহা চৌধুরী
🕐 ৭:২০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০২১

আয়নার ভিতর দিয়ে পথ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কানপাকা বলে পয়সা, পয়সার স্বামী, বাদল বখশিশ, আমিরুলকে শেষ করার জটিল কাহিনি। এরপর ও উর্বশীর গল্প কেের। একদিন যে উর্বশী ওর সবকিছু নিয়ে ভেগে পড়বে সে কথাও বলে। এত প্রেম তারপর ভেগে পড়বে? যমরাজা মাথার টুপি খুলে মাথা চুলকে বলেন। আরও আছে হুজুর। রক্তআমাশা বলে, বাদল বখশিশ ঠিক করেছে ন্যাংটো উর্বশীর সব পয়সা বাগিয়ে নিয়ে ওকে মেরে ফেলবে। পয়সাকে পাঠিয়েছিল আমিরুল কিছু কাজপত্র বাগাতে। যাতে করে বখশিশের সব জারিজুরি ধরা পড়ে যায়। সেটা টের পেয়েই ও পয়সাকে মেরে ফেলে। এবং দোষ দেয় পয়সার স্বামীকে।

তখন আমাদের মেয়ে বিন্তি কী করছিল?

কী আর করবে হুজুর! খোসপাচড়া বলে, ছোট ছোট কাজ। ওটা ছিল তখন ওর কাছে মজার খেলা। আর এখন একেবারে ডিটেক্টিভ গল্প। এই মানুষ জাতি বড় জটিল হুজুর। কোনো কাজ সহজভাবে নিতে পারে না। সবগুলোতে জট পাকায়। এর বউকে ধরে, নিজের বউকে মারে। এর টাকা চুরি করে ওর টাকা দিয়ে বাড়ি বানায়। আরও হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ঘটনা হুজুর। কত শুনবেন?

আমাদের রাজ্যের মতো কোনো কিছু স্ট্রেট ফরোয়ার্ড নেই? দরকার হলে ঘাড় মটকানো, কাউকে একটু ধরে কিছুদিন নাচানাচি, মাছ চুরি, ভয় দেখানো, দাঁত কপাটি লাগানো এইসব সহজ ব্যাপার নেই বলে কানপাকা প্রেত।
আপনার বিয়ের একশ’ বছর হলো। একই রানীমা। ওদের তেমন নেই?

না হুজুর। একশ’ বছরে কতবার যে বউ বদল করত, পরকীয়া করত তার কি কোনো ঠিক আছে। ওরা আমাদের মতো সহজ নয়; বড়ই জটিল, মহারাজ।

বার্লিন থেকে ঢাকায় কী করে মারল পয়সার স্বামীকে? ওরা তো আমাদের মতো অদৃশ্য হতে পারে না।
তা পারে না হুজুর। তবে আর যা পারে আমার বাপ-দাদাকে চড়কে ওঠাতে পারবে। হুজুর ওর দুটো পাসপোর্ট কানপাকা বলে পেটফোলার সঙ্গে। একটা পাসপোর্ট দিয়ে একজনকে বার্লিন পাঠিয়েছে। তারপর বখশিশ বাদল নিজে মেরেছে। পথের কাঁটাকে সরাতে চেয়েছে। আসলে বখশিশ বাদলের আদি নাম বদনাচোর বাচ্চু। এখন নাম বদলে পিকাসো, মডিগলিয়ানি বা মনে কতকিছু হতে চায়। সার্টিফিকেট জোগাড় করে কলেজের অধ্যাপক। রাজা মহারাজ ওদের খুব জটিল বুদ্ধি আছে। আর একটা জিনিস আছে যদি দেখে একজন একটু উপরের দিকে যেতে চায় নিচে থেকে সকলে মিলে তার পা টেনে ধরে। সে আর উঠতে পারে না। এই খেলাটা ওদের খুব মজার।

এ ছাড়া আরও কত কী বলে আমাশা নামের প্রেত

থামো থামো থামো। চিৎকার করেন যমরাজ। পেটফোলা, কানপাকা, পানিবসন্ত, হুপিংকফ সব থামে, কানঠাসা, আমাশা এবং আর সকলে হাত তুলে থামতে বলে। বলে, এই ছিল আপাতত শেষ খেলা এরপর এই বাদল বখশিশ আবার উর্বশী উপমা নিয়ে ভেগে পড়ত আর বিন্তিকে মেরে ফেলত

উর্বশী উপমা কোথায়?
বাড়িতে। পেয়ে যাবে আর একটা শাসাল মক্কেল।
বিন্তির অনুরোধে আমরাই ঠিক করেছি- বিন্তি আর বাদল বখশিশ মারা যাবে। বিন্তি আর একটু হলে আমাদের সব কথা ফাঁস করে দিত। তাই দুজনকেই মারতে হলো। শাকচুন্নি টাইফয়েড আয়নার ভিতর দিয়ে ওকে গুলি করে হুজুর। অন্যভাবেও মারা যেত তবে গুলি-টুলি না করলে ওদের মতো কাজ কারবার হতো না।
মহারাজা কী ভাবছেন! বলেন এবার আমাকে একটু পরিষ্কার করে।

বলো তো গলগ- পৃথিবীর মানুষজন এত জটিল কেন? সবকিছুকে এমন পাকায় কেন? আমাদের পাতালপুরীর প্রেতলোকেও সমস্যা আছে। তবে ওদের মতো নয়। এই লেজের সঙ্গে ওই লেজের গেরো দেয় ওই লেজের সঙ্গে সেই লেজের গেরো দেয়। সে এক মহাখেলা মানুষ জাতির। কারও পা ধরে টানে। কারও পেছনে একটা মনগড়া লেজ লাগিয়ে দেয়। কারও মাথায় কাল্পনিক শিং বসায়।

গলগ- আরও বলে, মহারাজ ওদের জন্মের সময়ই এই জটিলতা নিয়ে আসে। আর সবচেয়ে বেশি জটিলতা নিয়ে আসে, ওরা কাউকে বিশ্বাস করে না। নিজেকে সময় সময় মহাপ-িত মনে করে। ফট করে একজনকে ভুল বোঝে মহারাজ। জটিলতা, জটিলতা এবং জটিলতা। এই জটিলতার কারণে মানবসভ্যতার উন্নতি নাই। এখন ওদের রাজত্ব করছে করোনা। হুজুর এটা পশ্চিমের যমরাজার অনুচর। প্রথমে চীনে ছিল। তারপর সারা বিশ্বে।
গলগ- কথা বলতে বলতে গলা ফুলিয়ে ফেলে।

এবারে বিন্তিকে ওর নিজের মর-জগতে চলে যেতে হবে। আয়না শহরের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। বিন্তিকে মেরে ফেলেছে বখশিশ। কাচের চাকুতে। লোকজন ধরে নিয়েছি এটা আয়নার কাচে কেটেছে। তেমন কোনো ডিকেটটিভ হলে ধরে ফেলতে পারে। সেটা পারবে না। আর বখশিশ বাদলকে কে মেরেছে সেটাও ওরা ভাববে সেই আয়নার কাচ। এও ভাবতে পারে দুজনে যুক্তি করে একসঙ্গে মারা গেছে।

আমাদের মাঝের দরজা একেবারে চিরদিনের মতো বন্ধ করে দাও। এসব জটিলতার মধ্যে আর যেতে চাই না। পৃথিবীর মানুষ সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা ছিল না। এই জটিলতার জন্য তারা একদিন সমস্ত পৃথিবীর ক্ষতি এবং ধ্বংস ডেকে আনবে।

কুমড়োপটাশ, হুফিংকফ, হাম, ডিপথিরিয়া তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে আসার পথ বন্ধ হোক। দরকার হলে আমি যেখানে যাওয়ার তোমাদের পাঠিয়ে দেব। পরশ দিয়ে চলে এসো। কাল কোথায় যাবে তুমি?
হামের পরশ দিতে যাব মহারাজ। অনেকদিন মানুষের জগতে কোনো হাম নেই। তবে এখন আমরা ছুটি কাটাতে পারি। করোনা খুব ভেলকি দেখাচ্ছে মানুষ নিয়ে।

দেরি করবে না। যাবে আর আসবে। তোমাদের আমি কিছুদিন ছুটি দেব।
মহারাজ এবার যদি নিমগাছ বা তেঁতুলগাছ, বা গাবগাছ বা মান্দার গাছ থেকে কেউ পড়ে যায় যায়?
পা ধরে ওদের মানুষের দেশে ডাম্প করে আসিস খোসপাচড়া। এত জটিলতা আমরা সামলাতে পারব না। যেখান থেকে পড়ে পড়ুক। আমাদের প্রেতলোকের শান্তি নষ্ট করতে ওদের কাউকে আর আনবি না।
মহারাজ মানুষ যদি আমাদের মতো অদৃশ্য হতে পারত তাহলে কী হতো?
ভাবছি। পরে বলব।
যমরাজ বললেন, নতুন অ্যাপার্টমেন্টের ক্যান্সার, আলঝাইমার আর অস্টিওপরোসিসকে ডাক দে। আজকের ডিশিসন ওদের জানানো দরকার।

সব শুনে বলে আলঝাইমার, বাই পোলার একটা খবর এনেছে যমরাজ।
কী খবর?
মানুষলোকের একজন প্রেতলোকের মতো ঘটনা ঘটাতে শুরু করেছে।
সেটা কেমন?
লোকটা লেখালেখি করে। ঢাকায় বসে কী যেন লিখেছে- দেখা যায় তার লেখার কথা বরিশালের একজন জানে। কী ভাবছে তাও।
ফোন, ফেসবুক।
ফোন করার আগেই জানে। বরিশালের ওই লোকটার ফেসবুক নাই।
কেমন করে ওর খবর পাচার হয়?
মনে হয় ওর মাথায় একটা ভুল ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। তারই ফলে। সকলে খুব খুশি। এমন হতে পারে ও লন্ডনে বসে লিখবে সেটা চাঁদে বসে জানা যাবে। সকলের এমনই আশা। সকলে বলছে ও অমর অব্যয় অক্ষয় হবে।
ওকে কি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে?

না দেশ বিদেশের সাইক্রিয়াট্রিস্টরা সভা করে ওকে বড়ি দেবে বলে ঠিক করেছে। নাম দিয়েছে- থট ব্রডকাস্ট। পৃথিবী টু চাঁদ। এবং রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন ওয়ান মিনিট।

এদের মধ্যে যার গোঁফ বিশাল কারণ ওর বউ বলেছিল বিশাল গোঁফ পুরুষের লক্ষণ সেই বিশেষ পরুষ লক্ষণাক্রান্ত সাইক্রিয়াটিস্ট গোঁফ দুটোকে সুতো দিয়ে টেনে কানের চশমার হ্যান্ডেলের সঙ্গে বেঁধে রাখে না হলে ফ্রথিকফি খেতে গেলে মনে হয় সাইবেরিয়ার বরফ ওর নাকের উপরে ও নিচে, সে চোরের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলেÑ বাহ বাহ, আজ থেকে তুমি, অমর, অব্যয়, অক্ষয়! ভাবদেখে মনে হলো- পুরো কীর্তি ওর। আর যাকে বলছে সে মানুষ নয় একটা গাবগাছ। আসলে এখন গাব গাছের চেয়েও করুণ অবস্থা।

যমরাজা হাঁক দিয়ে বলেন, এই কানপাকাকে বলিস আজ থেকে ওর তিনটে নাম টিনেটাস আর থটব্রডকাস্ট। আমি তিন নামে ওকে ডাকব।

যার এমন ফ্রিকি ঘটনা ঘটছে তার মনের অবস্থা কেমন?
চোরের মতো। ভাবে নিশ্চয়ই একটা কবীরা গুনাহ করেছে না হলে এমন কেন হবে। লোক দেখলেই পায়ে পড়তে চায়। হাত জোড় করে সকলের করুণা ভিক্ষা করে।
এটার নাম কী দেওয়া যায়? উটকো রোগটার?

বিনা তারে সংবাদ। ওয়্যারলেস নিউজ নো অ্যানটেনা নাথিং। নো মাইক্রোচিপস। হিউম্যান ওয়্যারলেস। ভাবা যায়?
এই প্যারানাইয়া আজ থেকে তোরও তিনটে নাম- বিনা তারে সংবাদ আর চোর চোর মন।
আমরা কি আর কোনোদিন ভেতরের দরজা খুলে দেব না, আয়নার দরজা? প্রেতলোক আর মনুষ্যলোক এক হবে।
যমরাজা বলেন, বিনা তারে সংবাদ আর চোর চোর থাকতে এসব লাগবে না।
বিন্তিকে ডাম্প করেছিস তো?

দুজনকেই। বিন্তি আর বখশিশ বাদলকে। সকলে বলছে যুক্তি করে ভূতের হাতে মরেছে। বখশিশ বাদলের হাঁ করা মুখে গুলি টুক করে চলে গেছে আর গিলে ফেলেছে। কেউ গুলির কথা জানে না। একসঙ্গে মরা! একেবারে গলা পর্যন্ত প্রেমের ব্যাপার। এই তাদের ধারণা। ওরা হুজুর সবকিছুতেই প্রেম দেখতে পায়।

যমরাজা উঠতে উঠতে বলেন, মানুষ এত জটিল! এরপর থেকে ওদের আর আমাদের ভিতরে আর কোনো দরজা থাকবে না।

শেষ...

সালেহা চৌধুরী : শিক্ষক ও সাহিত্যিক

 
Electronic Paper