বিশেষ ঈদ আয়োজন (১)
আয়নার ভিতর দিয়ে পথ
সালেহা চৌধুরী
🕐 ৭:১২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০২১
প্রেতলোক ও মানুষলোকের ভিতরে আগে একটা দরজা ছিল। কিন্তু একদিন সেটা বন্ধ হয়ে যায়। কেন বন্ধ হয়ে যায় সেটা জানতে বিন্তি নামের একজনকে জানতে হবে। তেঁতুল পাড়তে গিয়ে কচি ডাল ভেঙে নিচে পড়ে যায় বিন্তি। ঝুম বৃষ্টিতে তেঁতুল গাছের ডাল নরম হয়ে গিয়েছিল। প্রেতলোক, যমলোক, মৃত্যুলোক অনেকটা একই ব্যাপার। ওখানে একটা নদী আছে। সেটা পার হয়ে ওপারে যেতে হয়। সেখানে অর্ফিয়াসের মতো কেউ বাঁশি বাজায়।
বিন্তির গল্পটা এখন এমন- দশ বছর হলো বিয়ে হয়েছে বিন্তির। ছানাপোনা হয়নি। স্বামী আর্ট কলেজের অধ্যাপক। আঁকা শেখান এবং নিজে আঁকেন। বাজারে মোটামুটি নামদামও আছে। বখশিশ বাদলের ছবি অনেকেই চেনে। মূর্ত বিমূর্ত বিলিয়ে ছবিতে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেন। বখশিশ স্ত্রীর চাইতে বয়সে ছোট। তবে দেখে মনে হয় দুজনের ভাব খুব। আর বয়সও তেমন বোঝা যায় না।
বিন্তি প্লানজেট, ক্রিস্টাল বল, তারোতকার্ড, টি লিভস সব করেন। কিছু লোকজন আছে, যারা আসে, রিডিং নিয়ে চলে যায়। তবে পুরো কাজটাই করেন শখের জন্য। বলে- তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর, তাই এইসব। টাকার জন্য না। তোমরা যদি উপকার পাও দান করে দিও অল্পকিছু। বলতে বলতে কিছু টাকাও আসে। যখন কেউ এসে কেঁদে বলে আমার স্বামী মারা যাওয়ার সময় বলতে পারেননি উইলটা কোথায় লুকিয়ে রেখে গেছেন। আপনি যদি একটা সাহায্য করতেন। কাকতালীয়ভাবে কিছু কিছু ঠিকও হয়ে যায়। তখন ভালো টাকা পান। একবার উইল পেয়েছিলেন চালের বস্তার মধ্যে। যখন কারও কোনো উপকার হয় তিনি প্রথমেই বলে দেন- এরপর প্রচুর দান খয়রাত করতে হবে।
বিন্তি রাতের বেলা অন্ধকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী করেন কে জানে। ঠিক বলা যায় না। কে যেন তাকে বলে দেয় জিনিসটা কোথায় আছে। তবে এসবও খুব বেশি করেন না। বলেন- অন্ধকারে আত্মার মুখোমুখি ব্যাপারটা সবসময় সহজও নয় ঠিকও নয়। ওদের চির বিশ্রাম থেকে টেনে তোলা। কিন্তু যাদের কাছ থেকে খবর পান তারা কি সকলেই আত্মা? কে জানে। এ সত্য বিন্তি প্রকাশ করেন না। বিন্তি অনেক কথা কাউকে বলেন না।
লোকজন সবসময় ওর কথা বিশ্বাস করে না। তবে একজনকে বলেছিল- আমার স্বামী ভারী হীরের একটা নেকলেস কিনে এক্সিডেন্টে মারা যান। বলতে পারেননি জিনিসটা কোথায় রেখে গেছেন।
মেয়েটি হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে- বলে দেন না জিনিসটা কোথায়?
আপনি জানলেন কেমন করে?
ওর ডায়েরি থেকে। আমার জন্মদিনের কিছুদিন আগে ও মারা যান কিনা তাই বলতে পারেননি।
আমাকে সময় দিতে দেবে। আর জিনিসটার যা দাম তার বিশ ভাগের টাকা আপনাকে দান করতে হবে। পারবেন? যদি জিনিসটা সত্যি সত্যি পান তারপর।
জিনিসটা ছিল বছরের চাল রাখার কাঠের বাক্সের ভিতর। তবে এমন ভেলকিবাজি বিন্তি রোজ দিন করেন না। মানুষ যেন আর জায়গা পায় না গোপন জিনিস চালের বস্তা আর চালের বাক্সের ভিতর রাখে। যতসব!
মাঝে মাঝে ‘উইজিবোর্ডে’ একে ওকে আনেন। তারা নাকি যেতেই চায় না। অনেক কষ্ট করে যায়। সেটা যারা দেখেছে ঠিক বলতে পারে না কোথা থেকে আসে ওরা। তবে সত্যি সত্যি আমাদের দেখার বাইরে আর একটা জগত আছে সেটা ঠিক। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে যায় সকলে। এবং বিন্তি বিশ্বাস করেন যমলোক।
এসব নিয়েই ভালোই আছেন বিন্তি। তবে খেয়াল করেনি স্বামী বখশিশ বাদল উর্বশী নামের মডেল মেয়েটির ছবির আঁকার পরেও অনেক সময় কাটাতে শুরু করেছে। স্তন, নিতম্ব, সুডৌল পা, সুন্দর হাতের পরে যা থাকে তার নাম হৃদয়। বখশিশ নাকি আজকাল সেই হৃদয়ের নদীতে যখন তখন পানসি বিহার করেন। এবং দরকার হলে অর্ফিয়াসের বাঁশি বাজিয়ে মরতেও রাজি আছেন। এবং এখন সম্পর্কটা একেবারে আঠালো এবং না ছাড়ানোর মতো ভয়ানক। উর্বশী একটা এলে বেলে মেয়ে। বখশিশের মতো পিকাসোকে তার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে ফেলতে সে সদা উন্মুখ। কাজেই ছলাকলা বিহার বিলাস রঙ্গ রসের চিত্রিনী নারীর হাঁয়ের ভিতর বখশিশ বাদলকে আপাদমস্তক সহ টেনে নিয়েছেন। আজকাল বিন্তি বুঝতে পারছে রাত বিরাতে বখশিশ বাদল ঠিকমত বাড়ি ফিরছে না। বলে- অনেক কাজ বিন্তি। কি করব বল? তুমি থাকো তোমার ভুত প্রেত নিয়ে লোকজনের হারানো জিনিস খুঁজে দাও।
সেটা তো থাকবই। তাই বলে তুমি ছেড়ে দেওয়া গরুর মতো যার তার জমিতে ঘাস খেতে যাবে সেটা মেনে নেই কি করে?
কি যে বল? ওরা তো সব মডেল। পারু, পয়সা, চিনু, মিনুর মত আজে বাজে মাল। পয়সা নেবে, দেহ ন্যাংটো করবে, তারপর চলে যাবে। ওদের নিয়ে তোমার ভাবনা করার কি আছে? বখশিশ বাদল উর্বশীর নামটা উল্লেখ করেন না।
পয়সা নামের মডেল মেয়েটাকে ওর স্বামী খুন করল কেন?
সেটা আমি কি করে বলি?
তুমি বেশ একটু ঘাঁটাঘাঁটা হাতাহাতি করনি?
বউকে পয়সা রোজগার করতে পাঠিয়েছে তারপর এত খবরদারি কেন?
মেয়েরা পয়সা রোজগার করতে গেলেই বাজারের জিনিস হয়ে যায় নাকি?
সকলে নয়। তবে যারা ন্যাংটো হতে আসে তাদের এত শুচিবাই থাকতে নেই।
আর তোমরা হাঁ করে বসে থাকো গিলবার জন্য। তোমরা খুবই বেঈমান।
উর্বশীর পুরো ব্যাপারটি এখনো জানে না বিন্তি। সম্প্রতি এক মক্কেল লাখ লাখ টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। তার স্ত্রীকে যে খুন করেছে সেই সুবাদে একটি অস্ত্র পাওয়া গেছে। বিন্তি কি কোনোমতে বলতে পারবে এ অস্ত্র কার। বিন্তি বলে- সে এসব ডিটেক্টিভ গল্পের ভিতরে নেই। সে কাজ করে শখে। এমন কোনো কাজ ও আগে করেনি। রাতদিন তার পেছনে ঘুরছে লোকটা। এটা প্রমাণ করতেই হবে কাজটা মেয়েটার স্বামী করেনি। জামিনে বেরিয়ে এসে সে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। না হলে পুলিশ বিভাগ মনে করছে কাজটা ওর স্বামীর। পিস্তলে কোনো আঙুলের ছাপ নেই। কাজেই এটা যে কোনো একজনের হতে পারে। স্বামী দর কষাকষিতে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে বড় কোনো ব্যাপার আছে।
বিন্তি ঠিক বুঝতে পারছে না লোকটাকে কি ও চলে যেতে বলবে। এটা ছিল তার শখের কাজ। এখন এসব ডিটেক্টিভ ফিটেক্টিভ। শেষে আবার কি হয় কে জানে।
ঠিক তখনি মৌরী বলে- তুমি ভূত নিয়ে আছো ওদিকে তোমার স্বামী যে এক ভূতনির পাল্লায় পড়েছে।
কোন ভূতনি?
উর্বশী। উর্বশী উপমা। দারুণ দেখতে। প্রথম স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর এই করছে। দেখতে একেবারে সত্যিকারের উর্বশী।
ঠিক একদিন মধ্য রাতের দিকে বিন্তি স্টুডিওর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দারোয়ান ওকে চেনে। ভিতরে যেতে দেয়। না হলে অন্য কারও এখন প্রবেশের অধিকার নেই। যা ভেবেছিল তাই। মাটির কার্পেটে দুই আদিম নরনারী আর যা করছে ছবি আঁকছে না। জীবন-মদিরা পানে নিমগ্ন। বিন্তি জানে ছবি আঁকতে গিয়ে এমন হয়েছে দু’একবার। অন্ধকার রাত। নগ্ন সুন্দরী নারী। আর রক্তমাংসের আদিম পুরুষ। বলেছে বখশিশ- শোনো বিন্তি, এমন হতে পারে। তবে কেউ আমার বউ, আমার স্ত্রী বা আমার সহধর্মিণী নয়। ওরা আসবে চলে যাবে। তুমি আমার চিরকালের, আজীবনের।
বিন্তি ভূত-প্রেত নিয়ে ব্যস্ত বলেই বোধকরি আচ্ছা ঠিক আছে বলে অনেকটা মেনে নিয়েছে? কিন্তু আজ এসবের ফাঁকে যা বলছে বখশিশ বাদল সেটা শুনতে পেয়ে দাঁড়ায়। বখশিশ আবেগে আশ্লেষে বলছে, দরকার হলে ওকে শেষ করব। আমার জগতে কেবল থাকবে তুমি। আমি এমন করে আর কাউকে ভালোবাসিনি। এরপর বলছিলে তুমি সন্তানসম্ভবা। সন্তান আমার। তুমিও আমার।
কী যেন ভাবতে ভাবতে বিন্তি ফিরে গেছে। ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি। কে কাকে শেষ করবে? পারলে ওই তো বখশিশ বাদলকে শেষ করতে পারবে। ওরা কি জানে পর্দার আড়াল থেকে ছবি তুলে এনেছে বিন্তি। মদাসক্ত বখশিশ সেটা শুনতেও পায়নি। হুট করে কিছু নয়। কাজটা আর একটু ধীরে সুস্থ সামলাতে হবে। বিন্তির নাকি এটা দ্বিতীয় জন্ম। দশ বছর বয়সে একবার তেঁতুল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তিনদিন মরে ছিল। তারপর তিনদিন পর জীবন ফিরে পেয়েছে। ‘নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স করে’ আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। সকলে বলে। এই জন্ম তাকে দিয়েছে আর এক অচেনা জগত। সকলে বলে ব্রেনের আশি ভাগ নাকি ব্যবহার হয় না। সেখান থেকে কিছু বোধকরি ব্যবহার করতে শুরু করেছে বিন্তি। না হলে এসব করে কেমন করে? অন্য মেয়ে এমন দৃশ্যে যেখানে আগুন ছুটিয়ে চিৎকার করতো সেখানে কিছু না বলে কতগুলো ছবি নিয়ে চলে এলো? এটা বিন্তির পক্ষেই সম্ভব। মনে মনে বলছে ফসকাবে কোথায়? আমার হাত থেকে তোমাকে ছাড়ব না। আমি তেমন কোন উদার নারী নই। অভিমান করে চলে যাব। অভিমান না আমার শিট। তোমাকে এমন মজা দেখাব বাপের নাম ভুলে যাবে। তোমার ওই উর্বশীর হাঁড়ির হাল যদি আমি না করি তুমি আমার নামে কুকুর পুষো।
আসার আগে দারোয়ানকে বলে- ওনাকে বলার দরকার নেই আমি এসেছিলাম। কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত তাই বিরক্ত করিনি।
গতরাতে খুব কাজ ছিল? ক্লান্ত স্বামীকে প্রশ্ন করে বিন্তি।
ভয়ানক। সারা গায়ে যে গন্ধ নিয়ে এসেছে তা ইভিনিং ইন প্যারিস না ব্লুদানিয়ুব কে বলবে? না হলে নিনারিচি না হলে স্যানেল ফাইভ। বলে- জাপানে যাবে আমার ন্যুড ছবিগুলো, তাই খুব ব্যস্ত। তুমি তো আছ তোমার ভূত-প্রেত নিয়ে।
আর তুমি তো আছ যত প্রকার ঠাণ্ডা-গরম মাংস নিয়ে।
হোয়াট ডু ইউ মিন?
মাই ফুট। হোয়াট ডু আই মিন? আই মিন উর্বশী নামের সেই কাউ।
ও এই কথা? দেবে না কেন ও টাকা পাচ্ছে।
তুমি কী করছ? এমন ভাব করে ও কিছু জানে না।
আমি আর কী করব। ছবি আঁকি। আর তুমি?
যা করি। এক মক্কেল নাকি দশ লাখ টাকা দেবে। যদি বলে দিতে পারি পয়সার হত্যাকারী ওর স্বামী নয়। মেয়েটা পয়সা। যে তোমার মডেল ছিল। অল্পদিন। তারপর তো খুন হলো। বলব নাকি খুনি কে?
তোয়ালে নিয়ে শাওয়ার করতে যাবে বাদল বখশিশ। বলে- তাই নাকি?
তুমি বলতে পারো তোমার ওখানে সাত দিন কাজ করার পর ওর স্বামী ওকে গুলি করল কেন?
আমি কী করে বলব? যা করছ তুমিই কর। রাতের অন্ধকারে বড় বাথরুমের আয়নার সামনে হিং টিং ছট বলতে থাকো সেই যে কে যেন এসে বলে দেয়, ঠিক বলে দেবে। ওর স্বামী কেন ওকে গুলি করল।
ওর স্বামী ওকে গুলি করেনি। বিন্তি বলে।
খুনিরা এমন কথা সবসময়ই বলে।
ওদের দুজনের বাথরুম আলাদা। একটা বিন্তির, একটা ওর স্বামীর আর একটা কমন বাথরুম। মাঝে মাঝে ওরা এক বাথটাব শেয়ার করে। বড়ই জটিল এই সম্পর্ক। মাঝে মাঝে বিন্তি ওর হাঁয়ের ভিতরে বখশিশের পুরো শরীর টেনে নেয়। বিন্তি মনে হয় তখন আর এক জগতের একজন। বাদল বখশিশের তো তাই মনে হয়।
ও যাবে। ওকে নিয়ে ভেব না। ‘ন্যুড’ ছবিগুলো হয়ে গেলেই চলে যাবে। বিন্তিকে বলছে বটে তবে এটা ওর মনের কথা নয়। আর একইভাবে উর্বশী উপমাকে বলছে- ও এবার মারা পড়বে ভূতের হাতে। পয়সাকে কে মেরেছে সেটা বের করতে গিয়ে। যে মেরেছে মারুক তোমার এত মাথাব্যথা কেন!
কে মেরেছে পয়সাকে? উর্বশী উপমা বলে।
আলতায় লাল পা। একেবারে বঙ্গনারী। প্রসাধন বলতে আলতা আর কপালে টিপ। বড় আধুলির সমান। আর নাকে নথ। কপালের অর্ধেক ঢেকে দিয়েছে চুল। অনবদ্য অপরূপ। ন্যুড জগতে তোলপাড় আনবে। আর যখন টাকার পাহাড় হবে সেখানে একটি প্রাসাদ বানিয়ে উর্বশী আর বখশিশ ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’ করবে। তখনও যে ক্লান্তি আসতে পারে সে কথা এখন ভাবছে কে?
আয়নার সামনে একা বিন্তি। কুচকুচে কালো ঘর। কী বলছে কী পড়ছে ওই জানে। মনে হলো আয়নার ওপারে সিঁড়ি দিয়ে অন্য কোনো শহরে চলে গেছে একটুখানি আলোর রেশ। আয়নার শহরটাও কালো। ঘোরতর কোনো এক শহর। চোখ বন্ধ করে একমনে বলেই চলেছে। ছায়া থেকে কায়া। বাতাসের ভিতর দিয়ে একটু হালকা শব্দ। ছায়া ছায়া আমার ছায়া। আমার মরলোকের মায়া। তুমি আমার সব। জীবন দেব তোমাকে করো না কলরব। একসময় ছায়া আসে। প্রশ্ন করে- তুই কী জানতে চাস?
আমি জানতে চাই। ‘হে আমার গোপন জীবনের সঙ্গী’ আমি জানতে চাই পয়সাকে কে খুন করেছে।
সাত দিন পর অমাবস্যা। দাঁড়িয়ে থাকিস ভেজা শরীরে তিনঘণ্টা। আয়না থেকে চোখ ফেরাবি না। তারপর জানতে পারবি।
আমার কাজটা একটু সহজ করা যায় না।
তোকে আমরা একটা উপহার দিয়েছিলাম। আমাদের জগতে তিনদিন থাকলি তারপর চলে এলি মানে তোকে আমরা ফেরত দিলাম। প্রেতলোক থেকে তোর নিজের লোকে। তেঁতুল গাছ থেকে ডাল ভেঙে পড়ে মৃত্যুর পর তুই আমাদের জগতে গিয়েছিলি। ‘নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স’ লোকজন বলে। তোকে ফিরে আসতে হয়েছে। তারও কারণ আছে। তেঁতুল গাছ থেকে প্রেতলোকে গিয়েছিলি তুই। আমরা তোকে ফেরত দিয়েছি। আর সঙ্গে দিয়েছি বজরুকি দেখানোর একটুখানি ক্ষমতা। তাই মাঝে মাঝে এমন বুজরুকি দেখাতে পারিস। তবে এবোরে একেবারে খুনোখুনির ভিতরে ঢুকছিস? ফল জানিস? মারাও পড়তে পারিস। তবে এবার মারা পড়লে আমাদের মৃতলোকে তোকে নেব না। তুই মানুষলোকে যাবি। তোর আর ফিরে আসা হবে না। তবে যা করছিলি তাই কর না। ওসব খুনোখুনির ভিতর যাস না।
আমি যেতে চাই। ঘ্যানঘ্যান করে বলে বিন্তি।
আমি রহস্য ভেদ করতে চাই। তারপর আবার মারা যাব আবার ফিরে আসব।
আর না। এবারে মরলোকে। মানুষের লোকে। অনেক পুণ্য করেছিস তোকে প্রেতলোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নরলোকে যাবি। যেমন তোর ধর্ম বলে। কোথায় যাস তোরা? বারজাক না কী যেন তার নাম?
সেখানে যাই প্রথমে। তোমার ধর্ম কী?
যম আমাদের রাজা। গুপ্তদেশ। নদীর ওইপারে। ওসব শুনে কী করবি? তোকে তো কিছু আমরা দিয়েছি দিইনি? যমের আর তিনটা ডিপার্টমেন্ট চালাতে হয়। তিন চারটা ‘পোর্টফলিও’ নিয়ে হিমশিম অবস্থা। তোকে যা দিয়েছি সেটা নিয়ে থাক। বেশি কিছু আর চাইবি না।
পয়সার স্বামী তো পাগল করে দিল। ওকে বলতেই হবে কে মেরেছে পয়সাকে।
চেষ্টা কর। তারপর মারা পড়। আমরা আর এসবে নেই। সুখবর তুই লোভী নস। ধীরে-সুস্থে পা ফেলিস।
কার সঙ্গে কথা বলছে বিন্তি যখন জ্ঞান ফিরে পায় তাকে আর মনে করতে পারে না। আয়নার শহরটা আবার ফিরে গেছে। আয়নায় কেবল কালো ছায়া। সেখানে ওর নিজের মুখ। অচেনা, অপ্রকৃতিস্থ। সত্যি কি আয়নার ওপারে আর একটা শহর আছে। একটা ঘোরতর কালো শহর? যমরাজার দেশ। যমরাজা আর আজরাইলে কী পার্থক্য! ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করে ফেলে। তারপর ভাবে এসব ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার আজগুবি গল্প। মাথা গরম হয়ে এসব দেখতে পায়। এবার গিয়ে মাথায় বরফ পানি দেবে।
কথা নাই বার্তা নেই একদিন ঝপাৎ করে বলে বিন্তি- তুমি উর্বশীকে তাড়াও। না হলে ব্ল্যাকমেইল করব। তোমার সুনাম যাবে।
কারণ কী?
একটু কি বেশি বাড়াবাড়ি করছ না! চিনি, মিনি, পয়সা, মুখপুড়িদের মতো সস্তার মাল নয়। চাইলে ওই সিনেমায় নামতে পারে।
তুমি জেলাস?
অবশ্যই। ওকে বদলাবে। না হলে খবর আছে। আমি প্রায় জেনে ফেলেছি পয়সাকে কে মেরেছে।
বেশ একটু আয়েশিভাবে সোফায় শুয়ে কী যেন পড়ছিলেন বাদল বখশিশ। এবার সোজা হয়ে বসেন।
দশটার মেঘলা আকাশের আলো ঘরে। প্রচুর মদিরা ও উর্বশীতে একটু ক্লান্ত। না জাপান নিয়ে ভাবনা কে জানে।
তুমি তো একটা নকল মানুষ। তুমি আবিদ রহমান। বিন্তি বলছে- ওই বখশিশ বাদল একটা নারীঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। তার ফলে তুমি ওকে ব্ল্যাকমেইল করে ওর সবকিছু নিজে বাগিয়ে নিয়েছ। নাম পর্যন্ত! তারপর প্যারিস থেকে ঢাকায় এসে নতুন নামে ব্যবসা করছ। তুমি আমিরুলের সার্টিফিকেটগুলো পর্যন্ত ব্যবহার করছ। একটা নকল মানুষ তুমি, একটা ভয়ানক নরপিশাচ।
এসব কি তোমাকে অন্ধকারের ভূতনিরা বলছে?
সে যাই বলুক। ও দিয়ে কী করবে। এখন যে আমিরুল ‘হা ঘরে’ হয়ে গেছে তুমিই তাকে তা করেছ। পয়সা সব জেনে ফেলেছিল কারণ এসব জানতে ওর স্বামী ওকে পাঠিয়েছিল তোমার কাছে। গন্ধ পেয়ে তুমি মেয়েটাকে খুন করেছ।
এখন আর কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকতে পারছেন না বাদল বখশিশ। বলেন কেবল- পয়সা গেলে আমার কী সুবিধা।
ছবি আঁকার সর্বময় কর্তা, বাংলাদেশের পিকাসো আর কী যে হতে চাও তুমি কে জানে। বল- আমি কারাভাজিও। না হলে রাফায়েল বা আর কিছু। এবার সব শেষ হবে।
ওই অন্ধকারের আয়না সব বলে দেবে তোমাকে? যেদিন পয়সা মরা যায় আমি বার্লিন ছিলাম।
বার্লিন না জুরিখ সব বের হবে।
এবার একটু নরম হন বাদল বখশিশ। বলেন- উর্বশী আমার ব্যবসার একটা কাঁচামাল। ওর ন্যুড ছবিতে বড়লোক হব আমরা। তারপর তুমি আর আমি বিন্তি। একটা নতুন শহরে গিয়ে প্রেম আর ভালোবাসায় জীবন কাটিয়ে দেব। আহা কেবল প্রেম আর প্রেম। সব অপ্রেম চলে যাবে তখন। কী মনে হয় তোমার? আমার আর কোনো পরিচয় নেই। আমি এখন বাদল বখশিশ।
এমন কথা তুমি উর্বশীকেও বলেছ। ওকে সাত দিনের ভিতর তাড়াও। তারপর পাক পবিত্র হয়ে জীবন শুরু কর।
আমার কাজ তো এখনো শেষ হয়নি।
শেষ কর। তোমার সামনে খুব খারাপ সময়।
মনে মনে বলে বাদল বখশিশ- আমার সময় খারাপ? আর তোমার ভালো? তুমিও শেষ হবে। আমি শেষ হওয়ার আগে তুমি শেষ হবে।
স্বামীকে এসব বলে সাতদিন পর অমাবস্যার রাতের প্রস্তুতি নেয়। সেদিন সব জানবে। বার্লিন থেকে কী করে মেরে ফেলল পয়সাকে। স্বামীকে ফাঁসাল। পয়সার স্বামী আমিরুল শেষ কড়ি দিয়ে খবরটা জানতে চায়। মরা হাতি লাখ টাকা। মরা আমিরুল আবার কোটি কোটি টাকার একজন হয়ে উঠতে পারে।
অমাবস্যার রাত। সারা ঘর কালো। আয়নার শহর কালো। দুই ঘণ্টা ধরে কী বলছে কে জানে। আজ জানবে কেমন করে বার্লিন থেকে একজনকে গুলি করা যায় লন্ডনে।
আবার তিন ঘণ্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সামনের কাচ ভেঙে আয়নার সমস্ত কাঁচ একে এক করে ফুটে যায় বিন্তির শরীরে। মনে হলো আয়নার ওপার থেকে কেউ গুলি করেছে ওকে। কিন্তু বিন্তির পেছনে দাঁড়িয়েছিল বাদল বখশিশ। বিন্তিকে কাচের শেষ পোজ দেবে বলে। এ কাঁচ আয়নার কাঁচ নয়, এটা বাদলের হাতের অস্ত্র। সকলে কি খুঁজে দেখবে এ কাঁচ আয়নার কাঁচ নয়। সকলে তো আর ইতালির কলাম্বো নয়। কাচ ভেঙে কেবল বিন্তি শেষ হয়নি, আয়নার গুলি বখশিশকে শেষ করেছে। -‘ফেডআপ’ এই মর্ত্যলোকের জটিল মানুষদের কারবারে। যমরাজা বলেন। মেয়েটাকে একটু ক্ষমতা দিয়েছিলাম; কী হলো তারপর? যত প্রকার জটিলতা সব এই মানুষের রক্তে। আমাদের রক্তও নাই জটিলতাও নাই।
সভা বসেছে যমপুরীতে। যমরাজা সভাপতি। তিনি বিন্তির কাজ নিয়ে সভা ডেকেছেন।
পঁচিশ বছর আগে মেয়েটা কেন এসেছিল আমাদের যমলোকে কানঠসা?
প্রশ্ন করেন তিনি। কানঠসা কিছু বলার আগে। উজির চিকেন পক্স উত্তর দেয়- হুজুর গাছ ভেঙে পড়ে গিয়েছিল বলে ওলাওঠা ভূতনি ওকে কুড়িয়ে আনে। তিনদিন পর জ্ঞান ফেরে। মনে আছে, হুজুর?
আছে। গেঁটেবাতকে বলেছিলাম ওকে আবার পৃথিবীতে দিয়ে এসো। সঙ্গে একটা আয়না দিও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।
এখন সমস্যা কী?
ওকে কিছু এই হালকা গুপ্ত বিদ্যা দেওয়া হয়েছিল। ও নিয়ে ভালো ছিল। অনেকটা খেলার মতো ব্যাপার ছিল হুজুর। জলবসন্ত নামের প্রেত বলে।
যমরাজা বলেন- হ্যাঁ, আমি গলাফোলাকে বলেছিলাম, ওর খেলার সবটা যেন সবসময় ঠিক না হয়। কিছু হবে কিছু হবে না। এখন শুনতে পাচ্ছি যাদের কোনো উপকার হয় তাদের নাকি পুণ্যের পথে ঠেলে দেয়। তাহলে তো এই লোকে ওকে রাখা যাবে না। কানপাকা শেষ ঘটনাটা আমাকে খুলে বলো।
চলবে...
সালেহা চৌধুরী : শিক্ষক ও সাহিত্যিক