ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ ও রমণের গল্প

এম এম মাসুমুজ্জামান
🕐 ২:৩১ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০২১

শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ ও রমণের গল্প

অনেক দিনের পরিকল্পনা, শ্রীমঙ্গল যাব। বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণের তারিখ নির্ধারণ করি। এর মধ্যে কারওর না কারওর সমস্যা এসে আটকে দেয় ভ্রমণযাত্রা। এর মধ্যে আবার মহামারী করোনার প্রকোপ! ভ্রমণপিপাসু মন! অনেক দিন আটকে ছিল। তাই ব্যস্ততার পালে তুড়ি মেরে আমরা ৮ বন্ধু একসঙ্গে শ্রীমঙ্গল যাব। সেটাই সিদ্ধান্ত। গিয়ে কোথায় উঠব? অন্যান্য ট্যুরে আবাসনের টেনশন থাকে। এই ট্যুরে সেই ঝক্কিটা নেই। কেননা আমাদের বন্ধু সোহেল karanja spa resort ltd নামের একটা ইকো রিসোর্ট করেছে শ্রীমঙ্গলে। ওর রিসোর্টে গিয়েই উঠব। লেলিনের জরুরি কাজ থাকায় আমাদের সঙ্গে যেতে পারল না। আমরা খুলনা সেন্ট জোসেফস স্কুলের একই ব্যাচের ৭ বন্ধু মিলে বৃহস্পতিবার ১০ জুন ২০২১ তারিখে দুপুর তিনটার দিকে রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের পথে। ড্রাইভার নিইনি।

বন্ধু সোহেল (সাজ্জাদ) নিজেই ড্রাইভ করছে। ড্রাইভার থাকলে স্বাধীনভাবে আড্ডা দেওয়া যাবে না। গাড়িতে বসে শুরু হলো আমাদের দুষ্টুমি। ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ। খুলনার প্রত্যেকটি রাস্তা, রূপসার জল-কাদা। আমাদের স্টুডেন্ট লাইফে সবারই কোনো না কোনো প্রেম-ভালোবাসা, ব্যক্তিগত পছন্দ, ভালো-মন্দ সবকিছুর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে পলাশের সম্পৃক্ততা ছিল। এখন বুঝতে পারি ছোটবেলা থেকেই পলাশ এসবে খুব পাকা ছিল। মেঘমেদুর স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে, পলাশ ও সোহেলের ভুল দিকনির্দেশনায় অনেকদূর সিলেটের রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম। এরপর শ্রীমঙ্গলের দিকে ফিরে এলাম। শ্রীমঙ্গল শহরে গাড়ি রেখে একটা জিপ নিয়ে রিসোর্টের দিকে রওনা দিলাম। বৃষ্টিতে রাস্তার কিছুটা অংশ নষ্ট হয়েছে। তাই জিপ নিই। একটা জায়গায় এসে জিপও মাটিতে আটকে যায় আর যেতে পারছিল না। তখন সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আর আমি একাই গাড়িতে ছিলাম। কাদার রাস্তাটা পার হয়ে আমি আর ওদের জন্য দেরি না করে গাড়ি নিয়ে হাসতে হাসতে কধৎধহলধ রিসোর্টে চলে এলাম। দেখি ওরা কী করে। ওরা সবাই পিছে হেঁটে আসতে লাগল। যদিও রাস্তাটা কম ছিল। ওরা সবাই হাঁপাতে হাঁপাতে এল, তখন বুঝতে পারলাম আমাদের সবার আসলে বয়স হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির দিন, রিসোর্টের ভিতরে অন্ধকার, এক টিলা থেকে নেমে আরেক টিলাতে যেতে হবে। সবাই তো সোহেলের উপর চোটপাট করছি। সোহেল আমাদের সান্ত¡না দিচ্ছেÑ সকালে দেখিস, কী সুন্দর জায়গা!

সবাই ফ্রেশ হয়ে রাত বারোটার দিকে ডিনার করলাম ডাইনিংয়ে। রিসোর্টের ডাইনিংটা একটু উঁচু টিলার ওপরে। সামনে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি ছোট একটা চাতাল। এই জায়গাটায় বসে চাঁদ দেখার মজাই আলাদা হবে। সারারাত আড্ডা দিয়ে ভোর পাঁচটার দিকে সবাই ঘুমাতে গেলাম।

সকাল নয়টার দিকে ঘুম থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি আসলেই চমৎকার একটি পরিবেশ। সবুজে ঘেরা, আশপাশের টিলাগুলোতে চা বাগান। রিসোর্টের ভিতরে অনেক কাঁঠাল গাছ। গাছে কাঁচা/ পাকা কাঁঠাল ঝুলছে। আমাদের কটেজের সামনে লজ্জাবতী গাছে ফুল ফুটে ভরে আছে। কী চমৎকার একটি রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। একে একে সবাই ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা সেরে রিসোর্টের উপরে আরেকটি টিলাতে ঘুরতে যাই। ওই টিলাতে আছে দুইটি সিঙ্গেল কটেজ। কী চমৎকার নির্মল বাতাস।

কিছুক্ষণ উপরে কাটিয়ে আবার ডাইনিংয়ের সামনের খোলা জায়গায় বসে চলতে থাকে অবিরাম আড্ডা। দুপুর দুইটার দিকে আকাশে মেঘ করে আসে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়। আমি আর সোহেল অনেক আশা নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা শুরু করি। কিন্তু বৃষ্টি মিসকল দিয়ে চলে গেল; আর হলো না! অবশেষে সবাই মিলে দুপুরের খাবার সারলাম। এরপর আমি, রিয়েল, সোহেল (সাজ্জাদ), চয়ন রিসোর্টের আশপাশে একটু ঘুরতে বের হই। কী অপরূপ দৃশ্য! তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সন্ধ্যার পর থেকে রাত অব্ধি বিশাল আড্ডা।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সুন্দর একটি সকাল পেলাম। আর চিন্তা করতে থাকলাম কাল থেকে ঢাকাতে আর এমন সকাল পাব না। সকালের নাস্তা সেরে রেডি হয়ে জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ঢাকার উদ্দেশে। পথিমধ্যে লাউয়াছড়া উদ্যান ঘুরে শ্রীমঙ্গল শহর থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিই। ঢাকাতে পৌঁছাই রাত ৮টায়।

পুরো ট্যুরে আমরা কিছু সময় পরপর চয়নকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চারিদিকে কেউ নেই সুনসান নীরবতা তারপরও চয়ন বারবার উপরের সিঙ্গেল কটেজের দিকে চলে যাচ্ছিল, আমার মনে হয় ওর ঘাড়ে জিন আছে।

ট্যুরে পলাশ আর কামাল একসঙ্গে থাকলে বাকিরা সবাই কনফার্ম মজা পাবে। মনে হবে যেন টেলিভিশনে টম অ্যান্ড জেরি দেখছি। আর রিয়েল সে তো একজন রিয়েল (জেনুইন) ফটোগ্রাফার। আর সোহেল (সাজ্জাদ) ও-তো বুদ্ধিজীবীদের মতো অল্প কথা বলে। যদি বুদ্ধি কমে যায় এই ভয়ে। এত রাস্তা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া-আসা আসলেই সোহেলের মতো ঠা-া মাথার ছেলে ছাড়া সম্ভব না।

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে Karanja spa resort ltd এর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। ২৪ বিঘার ওপর গড়ে তোলা রিসোর্টটি এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। তবে ২ রুমের ৪টি কটেজ ও ১ রুমের ২টি কটেজ বসবাসের জন্য রেডি আছে। বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ ঘোরার সুযোগ হয়েছে। তবে শ্রীমঙ্গলের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আসলেই মনে রাখার মতো। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্যদিকে কৈশোর-তারুণ্যের বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়া। ভ্রমণ রোমাঞ্চকর হয় পাশাপাশি মধুরও হয় বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে। এত সুন্দর! মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ যা আজীবন থাকবে।

শ্রীমঙ্গলে দর্শনীয় স্থান

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যোন, চা জাদুঘর, টি রিসোর্ট, ডিনস্টন সিমেট্রি, চা কন্যা ভাস্কর্য, নিমাই শিববাড়ি, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন, টিপরা পল্লী, মণিপুরীপাড়া, গারো পল্লি, নীলকণ্ঠ টি কেবিন, বার্নিস, টিলা, গলফ কোর্স, পাখি বাড়ি, বাদুড় বাড়ি, লালমাটি পাহাড়, রাবার বাগান, আনারস বাগান, মাধবপুর লেক, হাইল হাওড়, বাইক্কা বিল প্রভৃতি।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সহজেই বাস কিংবা ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল যেতে পারেন। আন্তঃনগর ট্রেন, পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস সিলেটের উদ্দেশে পছন্দমতো যেকোনো ট্রেনের টিকিট কেটে শ্রীমঙ্গলে নামতে পারেন। ট্রেনের টিকিটের ভাড়া-শ্রেণি ভেদে ১৮৫ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত।
ঢাকার ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ, মহাখালী থেকে শ্যামলী, এনা, বিআরটিসি ইত্যাদি পরিবহন শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। বাস ভাড়া ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা, এসি বাসের ভাড়া ১০০০ টাকা।

এম এম মাসুমুজ্জামান : প্রতিষ্ঠাতা, বুকল্যান্ড লাইব্রেরি ও ট্রাভেলার

 
Electronic Paper