ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ডালপালা মেলা বিক্ষিপ্ত ভাবনা

লতিফা নিলুফার পাপড়ি
🕐 ১:৫৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৪, ২০২১

ডালপালা মেলা বিক্ষিপ্ত ভাবনা

মনের ভিতর প্রায় সময়ই বিক্ষিপ্ত ভাবনা আসে। কোনো ভাবনায় উৎফুল্ল হই, কোনো ভাবনা আমাকে বিষণœ করে। ভাবনাগুলো এমনি এমনি আসে না; কোনো না কোনো ঘটনা কিংবা দেখা বিভিন্ন বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আসে। কোনো ভাবনায় যখন খুব বেশি আচ্ছন্ন করে তখন কাগজ-কলম নিয়ে লিখে ফেলি। আমি যেহেতু নারী, নারীদের নানা বিষয় ভাবায় বেশি। ভাবনাগুলো ডালপালা মেলে। বিগত কিছুদিনের ডালপালা মেলা বিক্ষিপ্ত ভাবনা থেকে টুকরো টুকরো যে লেখাগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো তুলে ধরলাম।

এক.
মনুষ্যত্বে ও মানবিক চেতনায় সব নারীকে ফুলের মতো ফুটে উঠতে হবে। হৃদয়ে মানবিক চেতনা ধারণ করতে পারলে একজন নারী হয়ে উঠবে সব গুণে গুণান্বিত। তারা সবাইকে সম্মান করবে, কখনো কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না; সব মানুষ তাদের কাছে সম্মানের পাত্র হবে। তাই মানবিকভাবে ফুটে ওঠাটাই একজন মানুষের কাছে সম্মানের উচ্চ শিখরে পৌঁছার সবচেয়ে বড় জায়গা। এই জায়গায় ফুটে উঠতে হবে সবাইকে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ৭১ টিভির একটি সাক্ষাৎকারে তার এমন অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করেন। তার আকুল আবেদন, কোনো মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেবেন না। তার আশা সব নারী বিএ, এমএ পাস করবে, তারপর তারা কর্মক্ষেত্রে যাবে। তিনি চান দেশের প্রত্যন্ত এলাকার নারীরা শিক্ষিত হবে।

নারীকে নিয়ে তার এমন ভাবনা-চিন্তা তথা সাহিত্য রচনা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, নারী অধিকার, নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে যদিও তার অনেক লেখা; তবে তার ব্যক্তি জীবনে স্বামী আনোয়ার হোসেনের প্রভাবের কথা বলে আবেগাপ্লুত হন। অকপটে স্বীকারও করেন স্বামীর আধিপত্য নিয়ে, সাংসারিক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কখনো তাকে দোষারোপ করেননি। তিনি যেন সাহিত্য রচনায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করতে পারেন তার জন্য তাকে সারাজীবন আগলে রেখেছেন। সেলিনা হোসেন বলেন, যেভাবে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন আমাকে, ঠিক সেই মর্যাদা সারাজীবন দিয়ে গেছেন। পাশে অতন্দ্রপ্র্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে ভরসা দিয়ে গেছেন।

লাল শাড়ি পরা ৭৫ বয়সী এই মহিলাকে বয়সের ভার একটুও কাবু করেনি। চেহারায় নেই কোনো মলিনতা। বাগানের কাজে, লেখালেখি করে তার সময় কাটে। প্রিয় লেখক সেলিনা হোসেন লেখার মাধ্যমে সমাজের যেসব অসামঞ্জস্য তুলে ধরছেন, সেগুলো দূর হোক। নারীর মর্যাদা নারীরা দিতে শিখুক। মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচুক নারী।

দুই.
সুখ ক্ষণিকের। কিছু সুখ আসে জীবনে, বাকি জীবনের সুখগুলো কেড়ে নিতে। তাই তো মানুষকে সুখের সঙ্গে কৌশল করে বাঁচতে জানতে হয়, নয়তো চলতি পথে হঠাৎ করে অন্ধকারে ছেয়ে যায় জীবন। আমি বলি, জীবনে সুখের সময়গুলোতে বেশি উৎফুল্ল হয়ো না, বেশি আনন্দ করো না।

যারা সুখের সঙ্গে কৌশল করে বাঁচতে জানে, তারা কখনো অহংকার করে না, কখনো অন্যের ক্ষতি করে না। কেবল মনের মাঝে এক সমুদ্র বিনয় এবং ভালোবাসা পুঁজি করে রাখে মানুষকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলোর উপরের আবরণ দেখতে ভালো না হলেও ভিতরটা কিন্তু একদম হাস্যোজ্জ্বল এবং সুখে ভরা থাকে। আর যারা সুখের সঙ্গে কৌশল করে বাঁচতে জানে না তারা তাদের জীবনে একটু সুখ আসলেই অহংকারী হয়ে যায়, মানুষকে মানুষ মনে করে না। সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। অন্যের সম্পর্কে ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। অন্যের সংসারে অশান্তি ডেকে আনা, অন্যকে নিয়ে উপহাস করা, লজ্জা দেওয়া, সব কিছুতেই কেমন উৎপাত শুধু।

তিন.
বাঙালি মেয়েরা অসহায়, কখনো তাদের পরিবারের কাছে, কখনো স্বপ্নের কাছে, কখনো নিজেদের ইচ্ছেগুলোর কাছে, কখনোবা তাদের ভালোবাসার কাছে, এটাই মূলত তাদের জীবন! তারা প্রতিটি মুহূর্ত অন্যের জন্য বেঁচে থাকা, জন্মের পর বাবা-মায়ের জন্য, বিয়ের পর তার স্বামীর জন্য আর সন্তান হওয়ার পর তার সন্তানের জন্য, সত্যি এটাই যে তাদের জীবন!
তাদের নিজেদের কোনো চাওয়া পাওয়া থাকে না, যা থাকে সেটা সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন, মেয়েরা চাইলেই পারে না ইচ্ছেমতো চলতে, পারে না তাদের ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে পূর্ণ করতে, পারে না কাউকে ভালোবেসে সুখে থাকতে! যদি মেয়েরা বাবা-মায়ের কথা মতো চলে, তাহলে মেয়েরা খুবই লক্ষ্মী, খুব ভালো, আবার যদি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়, তাহলে সবার কাছে মেয়েটা খুব খারাপ! আবার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে ঘর ছেড়ে চলে গেলে, মেয়েরা ভালোবাসার মানুষদের কাছে তাৎক্ষণিক সময়ে খুবই প্রিয়, ভালো! আর যদি তা না করে পরিবারের কথা মতো চলে, তাহলে মেয়েরা হয়ে যায় স্বার্থপর, বেঈমান, প্রতারক বা বিশ্বাসঘাতক! সব সময় মেয়েরাই কেন দোষী হবে?
শ^শুরবাড়িতে হয়তো শাশুড়িকে না জানিয়ে কিছু খেলে শাশুড়ি বলবে চোর। তার পছন্দ শ^শুরবাড়ির সকলের খাাবারের পছন্দের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। সে আলাদা কিছু বানিয়ে সকলকে দিয়ে খেলেও শ^াশুড়ি বলবে, এসব আমার বাড়িতে চলবে না। আর না দিলেÑ একা খেয়ে ফেলল বউটি! অপবাদ জুটবে কপালে।
প্রশ্ন হলো, মেয়েদের আসলেই কী করা উচিত? জীবনে সব কিছুরই ত্যাগ স্বীকার করে মেয়েরা। কখনো কেউ জানতে পারে না এই মেয়েটি তাদের জন্য কী কী ত্যাগ স্বীকার করেছে। সব মেয়েই কিন্তু ছেলেদের পকেটভর্তি টাকা চায় না। কিছু মেয়ে চায় একটু কেয়ার, একটু ভালোবাসা আর সম্মান। মেয়েদের জীবন কি কেবল অপরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে শেষ করে ফেলা? কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া সমাজে মেয়েরাই সব থেকে বেশি শোষিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, অত্যাচারিত।

চার.
সেই প্রাচীন যুগ থেকে এই আধুনিক সময়েও যারা সাহিত্য রচনা করেছেন ও করছেন তাদের অনেকের রচনাতে নারীর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, হাসি কান্না নানারূপে, ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন স্বাদে চিত্রায়িত হয়েছে। যতটুকু পড়েছি বা জেনেছি তা থেকে যতটুকু বোধগম্য হয়েছে, তা নিয়ে কত কত প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। নারী কখনো মাতৃরূপে, কখনো পতœীর ভূমিকায়, কখনো প্রেয়সী হয়ে সাহিত্যে বিশাল তার অবতারণা। মূল লক্ষ্য একটাই একজন অতুলনীয়া হতে হবে তাকে। তাদের ভূমিকাটা এককথায় বলতে হয় তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে হবে। তাকে তার জীবন বিসর্জন দিয়ে চারপাশের মানুষকে সুখী করতে হবে। আসলেই কি সুখী করা সম্ভব! যে নারী এতই অস্বাভাবিক মানুষকে কখনো মেনে নিতে হয়, যখন তার সমস্ত কার্যক্রম সামান্য কিছু ত্রুটির জন্য অশুদ্ধ হয়ে যায়। অথচ সেই ত্রুটি সে অহরহ সেই নারীর প্রতি করে থাকে। তখন স্ত্রী কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না। সব মেনে নিতে হবে।
যদি বলি কেন মানবে? তাহলে সমাজ আমাকে অস্পৃশ্য ভাববে। এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু শিক্ষকতা করতে গিয়ে মিথস্ক্রিয়া হয় সমাজের অনেকের সঙ্গে। আলাপে অনেক কিছু বের হয়ে আসে। মানসিক নির্যাতন পুরুষরা তো করে থাকেই; একটা নারী আরেকটা নারীর ওপরও অধিক পরিমাণে করে থাকে। এগুলোর কোনো সমাধান নেই। যুগের পর যুগ ধরে চলছে। যৌথ পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকা কোনো সমস্যা নয়। যদি সবার মানসিকতা সমান হয়। অসম মনের মানুষরা এক ছাদের নিচে বসবাস করতে সমস্যা। শুধু নারীর নয় সন্তানের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। আমার তোমার, তোমার আমার, বিষয়গুলো অনেক পরিবারে খুবই প্রকট আকারে থাকে। সকল কিছু নিয়ে একটা কাড়াকাড়ি যেন। এগুলো কিন্তু নারীরা করে থাকে। এখানে নারী উদার হতে পারেনি। সে শাশুড়ি হোক বা ছেলের বউই হোক। কিংবা জা-ননদই হোক। বাড়ির পুরুষরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না ঠিকই। কিন্তু যেকোনো কারণে বাধ্য হয়ে ভাইদের আলাদা করে দেন। ঘটনা কিন্তু অত্যন্ত ক্ষুদ্র বিষয়াদি। সবাই মনে করে আমি ভালো। আমি আরেকজনকে খারাপ বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে ভালো সাজার প্রবণতাকে ঘৃণার চোখে দেখি। কত নারী দেখেছি ইনিয়েবিনিয়ে মিথ্যা গল্প সাজিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে ভাঙন ধরায়। সে বোনই হোক মা-ই হোক ভাইয়ের বউ-ই হোক। কাপুরুষ সেই ফাঁদে পা ফেলে।
আমার এই সমস্ত লেখার পেছনে অনেকেই ভাবেন ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে লেখা। ব্যাপারটা সেরকম নয়। ব্যক্তিগত ক্ষোভ থাকলে থাকতেও পারে, তবে মূল লক্ষ্য নারীরা যেন নারীকে মানুষ ভাবতে শেখে। সে যেন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। আজকের মেয়েরা কোনো দিক দিয়ে বোঝা নয়। সে লেখাপড়া করছে, চাকরি করছে, বাজার করছে সংসার করছে। কোনটা সে পারে না! জীবন অনেক বিস্তৃত। আবার জীবন অনেক ছোটও। তারাশঙ্কর বলেন, ‘মেটে না আশা’। হিংসা, লোভ, মিথ্যাচার থেকে বেরিয়ে আসা অনেক কঠিন; আবার সহজও বটে। আমি ভালো থাকি সবাই ভালো থাকুক। এটাই আমার নীতি। মিথ্যা অপবাদ সহ্য হয় না। কতজন হাতেনাতে লজ্জা পায়। আবারো অন্যকে ফাঁসানোর তাদের পরিকল্পনা নতুন করে নিয়ে আসে। এতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি নতুন করে আবার পথ চলি। কেউ যদি সেই মিথ্যাগুলোকে সত্য মনে করে আমার কিছু যায়-আসে না। আমার সামনে যদি পছন্দের মানুষকে নিয়ে মনগড়া কথা বলবে, তাকে খুন করে ফেলতে পারব; এতে অমানুষ হলে হব। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না।
নারীকে নিয়ে ভাবতে যদি আমরা সেই গতানুগতিক ছকে বাঁধার চেষ্টা করি মনে হয় ভুল হবে। নারীকে বিজয়ী দেখতে চাই। ছলনাময়ী, প্রেমময়ী, প্রেরণাদানকারী হিসেবে নয়। মানুষ হিসেবে সে যেন নিজের অবস্থান সঠিকভাবে অনুসন্ধান করতে শেখে।

পাঁচ.
স্ত্রীকে ভালো রাখার মানেই খাবার আর বাসস্থান নয়। তার আত্মিক শান্তিটা খুবই জরুরি। সবাই বিলাসিতায় সুখী হয় না। একজন স্বামী মানে যার হাত ধরে তার স্ত্রী সব ছেড়ে আজীবন কাটিয়ে দেবে, যার ফলে তার সর্বগুণ থাকা প্রয়োজন। অথচ পরিবার সমাজ স্ত্রীর পেছনে লেগে থাকে, তাকে জাজ করতে। আপনি মেনে নিতে চান না স্ত্রীর ত্যাগের গল্প, আপনার চোখে সে সর্বসুখী। এরকম হলে সমস্যা আপনার চোখের, সঙ্গে অন্তরেরও। তাকে উপলব্ধি করতে পারেন না।
একজন স্বামী শুধু জীবনসঙ্গীই নয়, বরং বাবা-মায়ের স্নেহেরও অংশীদার, স্ত্রীর উত্তম বন্ধু। অথচ আপনার মধ্যে ইগো কাজ করে। ধর্মীয় বিধানমতে স্ত্রীর ওপর যেমন স্বামীর কর্তৃৃত্ব রয়েছে তদ্রƒপ স্বামীর ওপরও স্ত্রীর পূর্ণ হক রয়েছে। সংসার জীবনে কলহ আসবেই, কিন্তু সেই কলহে জবান দিয়ে যেন এমন কিছু বের না হয় যেটা সাংসারিক জীবনটা বিষাদ করে দেয়।
একটু ভাবুন, স্ত্রীর বাপের বাড়ির পরিবার থেকে কেউ আপনার বিরুদ্ধে কিছু বললে মারাত্মক চটে যাবেন। হয়তো কোনোদিন শ্বশুরবাড়িতে পা রাখবেন না। অথচ প্রতিনিয়ত স্ত্রীর সঙ্গে এটাই হয়ে চলে। যেখানে আপনিই পারেন না ফ্যামিলি ছাড়া কাউকে আপন করতে, সেখানে তার ওপর কীভাবে চাপিয়ে দেন? কোন আইনে লেখা একটা মেয়েকে এসব সহ্য করতেই হবে! না রাষ্ট্রীয় আইন আর না ইসলামিক শরিয়াহ্। শরিয়তের দৃষ্টিতে নারীরা করলে করতে পারে। না করলে বাধ্য নয়। স্ত্রীকে সম্মান দিতে শিখুন। কেননা ‘আল্লাহ্র কাছে ওই ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম’। এটা হাদিসের কথা।

ছয়.
জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কত মানুষ তোমাকে কতভাবে অপমান করেছিল। মানুষগুলোর কোনো একটা ঝাঁঝাল কথা তোমার ভিতরটায় চরমভাবে আঘাত করেছিল। সেই মুহূর্তটায় তোমার ইচ্ছে হচ্ছিল মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। তুমি চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে সেই কথার ছুরির আঘাত সহ্য করে চোখ বুজে দুঃসহ একটা সময় পার করেছিলে!
বুকের ভিতর সবচেয়ে বাজে অনুভূতি সৃষ্টি হয়, যখন প্রচ- রাগ আর তীব্র কষ্ট একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কথা দিয়ে কেউ আঘাত করলে, প্রচ- অপমান করলে এই বাজে অনুভূতিটার স্বাদ পাওয়া যায়। স্বাদটা ভীষণ তেতো। সেই মুহূর্তে তোমার বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিল না; একদম বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিল না!
অথচ দেখো, তুমি এখন বেঁচে আছ। সময়ের সঙ্গে সেই অপমানের ক্ষত শুকিয়ে গেছে। তুমি এখন স্বাভাবিক আছ। তোমাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। গুটিগুটি পায়ে গন্তব্যের দিকে আগাতে হবে।
মাঝে মাঝেই তোমার সেই অপমানের কথা মনে পড়বে। কাঁটার বিপরীতে কাঁটা দিয়ে জবাব দিয়ে নিচে নামার প্রয়োজন নাই। কাঁটার বিপরীতে ফুল দিয়ে জবাব দিয়েও অতটা মহৎ হওয়ার প্রয়োজন নাই। বরং শান্ত থাকো। বুকের ভিতরের সমন্ত রাগ আর কষ্টের সমুদ্রে এক চিমটি ধৈর্য আর এক মুঠো জিদ মিশিয়ে তুমি শুধু অপেক্ষা করো।

সাত.
শহরে ভাইয়ের বিরাট বড় অট্টালিকা। আয় রোজগার ভালো। সমাজ সেবায় অনেক নাম কুড়িয়েছেন। গ্রামে বিধবা বোন। সন্তানরা উপযুক্ত নয়। একবেলা খেলে দু’বেলা খাবার ব্যবস্থা করতে পারে না। ভাই ওই বোনটির প্রতি তাকিয়ে দেখার সময় পান না। সাহায্য তো দূরের কথা। এইরকম কত কত বোনের কান্না ভাইয়েরা শুনতে পায় না।
আবার আমারই পরিচিত একজনের কথা জানি, ভাই অবস্থাসম্পন্ন। ঢাকা শহরে থাকেন। নিজের বোন অসহায়। তিনি তারই মতো ফ্ল্যাট বানিয়ে দিয়েছেন বোনের জন্য। তার দেওয়ার মতো মন আছে, তাই বোনের কান্না তার কানে এসে পৌঁছাতে পেরেছে। রক্তের বন্ধনকে অস্বীকার করতে পারেননি। গরিব আত্মীয়স্বজনদের ঘরবাড়ি বানিয়ে দেন। হয়তো তিনি তার মা-বাবার যোগ্য সন্তান।
ভালোবাসা স্বর্গীয়। শান্তিময়। সুখ ও সমৃদ্ধির সোপান। আর ভালোবাসার সূতিকাগার পরিবার। যাদের ভালোবাসায় আমাদের সৃষ্টি সেই বাবা-মা কত আদর-যতেœ আমাদের প্রতিপালন করেন। অতুলনীয় তাদের ভালোবাসা। ভালোবাসার এ ঋণ আজীবন অপরিশোধ্য। যে সন্তান বাবা-মাকে ভালোবাসে না সে অন্যকেও ভালোবাসতে শেখে না। তার ভালোবাসায় অপূর্ণতা থাকতে বাধ্য। নিখাদ ভালোবাসার স্বরূপ সে অনুধাবনে ব্যর্থ। যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে বাবা-মা সন্তান প্রতিপালন করেন, সন্তানের উচিত তার যথাযথ সম্মান দেওয়া। যে সন্তান তার বাবা-মার হৃদয়ের ভাষা উপলব্ধি করতে পারে না, অন্যের হৃদয়ে সে প্রবেশ করতে পারে না। কৃত্রিমতার আবরণে তার হৃদয়ে ঢাকা থাকে। কোনো বাবা-মা চান না তাদের সন্তান খারাপ থাকুক। যথাসাধ্য তারা তাদের সন্তানের মঙ্গল কামনায় সচেষ্ট থাকেন। পারিপার্শ্বিকতা ও সামর্থ্যরে ভিন্নতার কারণে অনেকেই হয়তো সন্তানের আশা-আকাক্সক্ষার রূপায়নে পেরে ওঠেন না।
সন্তানকে তা উপলব্ধি করতে হবে। বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। বাবা-মার সুখ-দুঃখকে ভাগ করে নিতে হবে। এতে বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের প্রকৃত ভালোবাসা বিকশিত হবে। বাস্তব বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে। অপরের সুখ-দুঃখ উপলব্ধির অনুশীলন হবে। সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও ভেদবুদ্ধির সৃষ্টি হবে না। ঘাত-প্রতিঘাত ও দুঃখ-কষ্ট মোকাবিলা করার মানসিকতা গড়ে উঠবে। পরিবারে ভাই-বোন থাকলে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হবে। সকলেই একই পরিবারে একই বাবা-মার আদরের ধন। ভাই-বোনের মধ্যেও পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় ও মজবুত হওয়া প্রয়োজন। নিজের বোন, নিজের ভাই সে তো একান্ত নিজের। তার সুখে-দুঃখে অবশ্যই তার পাশে থাকতে হবে। বোনের বিপদে ভাই যদি পাশে না দাঁড়ায় তাহলে কে দাঁড়াবে? বোনও যদি অবস্থাসম্পন্ন হয় দরিদ্র ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ জন্যই তো ভাইবোন। পরিবারে সন্তান যখন উপযুক্ত হয়ে বিয়ে করে, ছেলে হলে অন্য পরিবার থেকে স্ত্রী নিয়ে আসে এবং মেয়ে হলে অন্য পরিবারে স্ত্রী হিসেবে গমন করে। চিরন্তন এই রীতি সমাজের ভিত্তিভূমি।
যখন অন্য পরিবারের আদরের কন্যাসন্তানকে স্ত্রী হিসেবে নিয়ে আসা হয়, সেও তখন এই পবিবারের আদরণীয় সদস্য হয়ে যায়। কী সামাজিকভাবে, কী আইনগতভাবে তাকে আর পর ভাবার অবকাশ বা যুক্তি নেই। সে তার অতি আদরের পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে অজানা-অচেনা পরিবেশে স্বামীর সংসারে চিরজীবনের জন্য চলে আসে। এটাই তার নিজের সংসার। এক্ষেত্রে তার ব্যথা ও কষ্ট স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সকল সদস্যকে আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাকে যেমন আপন করে নিয়ে আসা হয়েছে, ভালোবাসা দিয়ে তার অন্তরকে পূর্ণ করে দিতে হবে। সেও তখন সকলের সঙ্গে ভালোবাসার প্রতিযোগিতায় নিজেকে উজাড় করে দিতে পারবে। স্বামীসহ শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ সকলকে ভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারবে। এভাবেই পরের মেয়ের ওপর আপন সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়ে থাকে। বাড়ির বউকে পরিবারের সদস্য ভাবতে হবে। নিজের অনুভূতি দিয়ে তার সামর্থ্য ও সুখ-দুঃখ উপলব্ধি করতে হবে। ভালোবাসার বন্ধনে তাকেও আবদ্ধ করতে হবে।
বাস্তব সত্য হলো, সকলেই মানুষ, কিন্তু সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। পারস্পরিক সহযোগিতার সমন্বয়ে সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি জীবনের সর্বক্ষেত্রে উপলব্ধি করে এর প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
আরেকটি বিষয় বলে নিই। যে পরিবারে কাজের লোকের প্রতি দুর্ব্যবহার ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, সে পরিবারের সন্তানরা শৈশব থেকেই অহংকার, নীচতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতা ও মানুষকে অবজ্ঞা করার মতো ভয়ঙ্কর অমানবিক দোষগুলো নিজেদের অবচেতন মনে আয়ত্ত করতে থাকে। আর এগুলো নিজেদের পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও পরবর্তীকালে নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ সকলের প্রতি প্রয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করে না। পরিবারে যদি ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজিত থাকে, সে পরিবার সুখের আঁধার। সে পরিবারের সদস্যগণ সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে পারস্পরিক ভালোবাসার অনাবিল বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় সেখানে কোনো প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, ঘৃণা, হানাহানির মতো জঘন্য প্রবৃত্তিগুলো জন্ম নিতে পারবে না। তারা নিজেদের চরিত্র মাধুর্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সকল মানুষকে আপন করে নিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। সকল মানুষ হয়ে উঠবে তাদের আপনজন।

আট.
জীবন বড় অদ্ভুত। কখনো কতই না সুন্দর আর আনন্দময়, আর কখনো কষ্টকর! বিশেষত বাঙালি নারীর জীবনটাই যে এমন! কেউ তো জানি না আমার শেষ কোথায়, কী নিয়ে দুঃখ করব? আজ হয়তো অনেক সুখী, যদি আজই চলে যেতে হয় এই জগত ছেড়ে, তবে আমি কি প্রস্তুত যাওয়ার জন্য? আমি যতটুকু সুখে আছি, অনেকেই তো তার চেয়ে খারাপ আছেন, তাই না? জীবনটাই তো এমন! অনেক পাওয়া আর না পাওয়া দিয়ে ঘেরা, অনেক তৃপ্তি আর অতৃপ্তি মাখানো, তাকে তো আপন করে নিলে চলে না! তাকে সঙ্গে করে চলতে হতে হয়। এলোমেলো হয়ে গেলেও সকল ধর্মবিশ্বাসীদের প্রস্তুত হতে হবে শেষ বিচারের জন্য, সেটাতে ভুলে গেলে চলবেই না!
কৈশোরে পড়েছিলাম, জীবনে যা ঘটেছে, তা ভালো হয়েছে। যা হচ্ছে, তাও ভালো হচ্ছে। আর ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তাও ভালোই হবে।
ছেলেবেলায় শোনা সেই গল্পের কথা মনে পড়ে গেল; এক লোক মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখেন তার জুতো জোড়া হারিয়ে গেছে। ভীষণ মন খারাপ করে তিনি পথ চলতে শুরু করলেন খালি পায়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি দেখলেন একজন ভিক্ষুককে, যার দুটো পা-ই নেই, তখন তার নিজের জুতো হারাবার দুঃখ ঘুচে গেল, আমার তো অন্তত দুটো পা অক্ষত আছে! যাক না দু’জোড়া জুতোই, যা হারিয়ে গেছে আমার, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু আমার কাছেই আছে। অনেকের সেটুকুও নেই! এটাই হয়তো আত্মিক শান্তি অর্জনের ভাবনা হওয়া উচিত। আর সেই শান্তির খোঁজেই তো আমরা ছুটে চলেছি জগতময়! যদি মনেই শান্তি পাওয়া যায়, তবে আর ক্ষতি কী?
নিজেকে কখনো অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে বিরত থাকুন। সবকিছুকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে চেষ্টা করুন। নিজেকে নিয়ে এবং কাছের মানুষদের নিয়ে অনর্থক বেশি দুচিন্তা করবেন না। মনে রাখবেন, দুশ্চিন্তা কখনোই সমস্যার সমাধান করবে না। নিছক আড্ডা দিয়ে, মানুষের ভুল-ত্রুটি ধরে সময় অপচয় করবেন না। শত্রুতা এবং অন্যের প্রতি ঘৃণা বজায় রাখবেন না। এতে কেবল দুশ্চিন্তা বাড়ে এবং মানসিক শান্তি নষ্ট হয়, যা আপনার স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
নিজের এবং অন্যের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিন, শিক্ষাকে মনে রাখুন, ভুলকে ভুলে যান। অতীতের ভুল নিয়ে অতিরিক্ত ঘাটাঘাটি করে তিক্ততা বাড়িয়ে বর্তমানের সুন্দর সময়কে নষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন, জীবন একটি বিদ্যালয় যেখানে শিখতে এসেছেন। জীবনের যত সমস্যা তা এই বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত, তাই চিন্তা না করে বীজগণিতের মতো সমাধানের চেষ্টা করুন। প্রচুর পরিমাণে হাসুন এবং সবসময় হাসিখুশি থাকার অভ্যাস করুন। সেই সঙ্গে অন্যদেরও হাসিখুশি রাখতে চেষ্টা করুন।

লতিফা নিলুফার পাপড়ি : শিক্ষক ও লেখক

 
Electronic Paper