স্বাস্থ্যবিধি মেনেই হোক কোরবানি
কাজী সুলতানুল আরেফিন
🕐 ২:২৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০২১
করোনা মহামারী নিয়ে আতঙ্কে দেশ। আতঙ্কে আছে দেশের জনসাধারণ। নিত্যনতুন ধরন শনাক্ত হচ্ছে করোনার। দেশের আনাচেকানাচে আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখন মৃত্যুর সংখ্যাও আচমকা বেড়ে যায়। কিন্তু মৃত্যু থেমে নেই। প্রথম প্রথম মানুষ এতটা আমলে না নিলেও এখন একটু একটু করে ভাবতে শুরু করেছে। সরকার কঠোর লকডাউন দিয়েছে। নানাভাবে দেশকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মানুষের মাঝেও চরম হাহাকার। সবকিছু মিলিয়ে এক অশান্তি বিরাজমান দেশে।
বাংলাদেশ এখনো চরম ঝুঁকির মধ্যেই আছে। এদিকে টিকার চালানও এসেছে। বাজার এবং পথে-ঘাটে এখনো অবাদে মানুষের ভিড় লক্ষিত হচ্ছে। অনেক অসচেতনতা দেখা যাচ্ছে। বাজারে মানুষ নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে ভিড় করলেও অনেক জায়গায় এখনো সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। এদিকে চীনের গবেষক দল বলেছে, ‘বাংলাদেশ এখনো করোনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেনি’! আবার কেউ কেউ বলছে বাংলাদেশে এখন করোনার ‘পিক টাইম’ চলছে। যেটিই হউক আমাদের সচেতন থাকতে হবে। তাদের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে বাংলাদেশে এখনো চরম বিপর্যয় সংগঠিত হয়নি।
সামনে কোরবানির ঈদ। মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। তাই ঈদকে সামনে রেখে নীতিনির্ধারকদের এখনই কিছু জরুরি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। কোরবানির ঈদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পশুর হাট। প্রতি বছর বিভাগীয় শহর এবং দেশের আনাচেকানাচে পশুর হাট জমে ওঠে। এবারের চিত্র যেহেতু ভিন্নতর তাই পশুর হাট জমলেও তা সীমিত পরিসরে হবে কিনা? কিংবা কোন উপায়ে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হবে, কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে? এসব বিষয় নিয়ে এখনই নীতিনির্ধারণ করা না হলে আমাদের চরম বিপদে পড়তে হবে। এর মধ্যে কয়েকটি পশুর হাটের অনুমতি দেওয়া হয়ে গেছে। পশু ক্রয়-বিক্রয়ে আর্থিক লেনদেন নিয়েও চিন্তা করতে হবে। পশু কোরবানির ক্ষেত্রে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রচার এখন থেকে করা উচিত। পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জোগান স্থিতিশীল রাখা এবং সরবরাহ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। ঈদের আগে এবং ঈদের পরে কী কী পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে তা আগে থেকেই ভেবে রাখতে হবে।
যদি অনুমতি মেলে তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুর হাট বসতে পারে। আবার এই পশু কেনা-বেচাকে কেন্দ্র করে কতগুলো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম হয়। তবে এসব ঘটনা শহর অঞ্চলে বেশি সংঘটিত হয়। প্রথমত জাল নোটের কাজ কারবার বেড়ে যায়। এমন জাল নোটের কারবারিরা এই সময়ে তৎপর হয়ে ওঠে। তাই লেনদেনের সময় ক্রেতা আর বিক্রেতা উভয়কেই খুব সাবধান থাকতে হবে। এ ছাড়াও কিছু প্রতারক আর মলম পার্টিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদের মূল টার্গেট থাকে পশু বিক্রেতারা। দূর-দূরান্ত থেকে আগত পশু বিক্রেতাদের অপরিচিত মানুষের দেওয়া কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব মলম পার্টি থেকে ক্রেতারাও নিস্তার পায় না। তাই ক্রেতারা পশু কেনার টাকা নিরাপদে রাখবেন আর বাজারে যাওয়ার সময় একা না যাওয়াই উত্তম। সঙ্গে কেউ থাকলে সবসময় একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করতে হবে। অপ্রীতিকর কিছু ঘটলেই পার্শ্ববর্তী পুলিশ বক্স বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকলে তাদের জানাতে হবে। নিজেরা কোনো হট্টগোল বাঁধালে চলবে না। পশুর হাটে সাবধানে থাকতে হবে। নিরাপদে থাকতে হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
মানুষকে বাসা-বাড়িতে রেখে অনেক কিছু সহজে পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। ঈদ উপলক্ষে কাপড় দোকান এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রচুর ব্যবসা করে থাকেন। এবার যেহেতু রমজানের ঈদে মানুষ কেনাকাটা করতে পারেনি তাই কিছু মানুষ মার্কেটমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ ঈদেও ব্যবসায়ীদের লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা বেশি। এসব ব্যবসায়ীর জন্য প্রণোদনা সহজ করা দরকার।
আসন্ন কোরবানির ঈদে চিকিৎসাসেবা নিয়েও ভাবতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকদের নিয়েও ভাবতে হবে। যে সকল চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী এমন ঝুঁকি মোকাবিলা করছেন তাদের উৎসাহের সঙ্গে আলাদা বোনাস দেওয়া হোক। সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালের সেবাদানের সময়সূচি নিয়ে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি ঈদে চাকরিজীবী এবং শ্রমিকদের নিয়েও ভাবতে হবে। অফিস, আদালত এবং গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি কীভাবে চলবে বা না চললে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা এবং ঈদ বোনাসের কী হবে! একদিকে যেমন শ্রমিক কর্মচারীদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে তেমনি অন্যদিকে মালিক পক্ষকেও লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ভাবতে হবে যারা দিনে আনে দিনে খায় তাদের নিয়ে। অনেকেই ইতোমধ্যে আবার নিজেদের কাজ হারিয়েছেন। অনেকের আবার উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করেছে।
ঈদ পরিকল্পনা প্রণয়নে কোনো বিলম্ব করা উচিত নয়। সব কিছুতে একটু বিলম্ব করার অভ্যাসের কারণে আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়! অন্তত উন্নত দেশগুলোর ভয়াল চিত্র আর দৈন্যদশা দেখে আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার! দেশের সকল স্তরের জ্ঞানী গুণীদের এক কাতারে দেখতে চাই। দেশে লকডাউন আর বাড়ানো হবে কিনা? বাড়ালেও তা কতদিনের হবে তা এখনই ঠিক করতে হবে।
মানুষ নিজের আপনজনদের সঙ্গে ঈদ উদাযাপন পশু কোরবানিতে আগ্রহী থাকে। বিশেষ করে ঈদে ঘরমুখো মানুষকে আটকানো খুব অসম্ভব একটি বিষয়! সে ক্ষেত্রে পরিবহন সেক্টর ও যাতায়াতের ওপর নতুন পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা দলমত নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করে। কিন্তু দেশে আরও অনেক দায়িত্বশীল মানুষ নিষ্ক্রিয় আছেন। কিংবা শুধু নিজের অবস্থা নিয়েই পড়ে আছেন। এ সমস্ত দায়িত্বশীল মানুষদের কাছ থেকে মানুষ কিছু আশা করে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। দেশের এ পরিস্থিতিতে মতভেদ সৃষ্টি করে রাজনীতি করা উচিত নয়। দেশের বিপদেও যদি নেতারা শুধু রাজনীতির কথা ভাবেন তবে সে রাজনীতি দেশের কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। মানুষ এমনিতেও কিছু নেতার এমন কর্মে চরম বিরক্ত! মানুষ দেশের কল্যাণে সবার ভূমিকা দেখতে চায়। রমজানের ঈদের পরে কোরবানির ঈদ নিয়ে সুন্দর একটা পরিকল্পনা আমাদের মহামারী থেকে পরিত্রাণ এবং সুন্দর সময় উপহার দিক।
কাজী সুলতানুল আরেফিন : কলাম লেখক, ফেনী