পরীমনি বনাম সাধারণমনি!
সাজ্জাদ হোসেন
🕐 ১২:৩৯ অপরাহ্ণ, জুন ১৮, ২০২১
শিরোনাম দেখে অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, এতদিন পরীমনির নাম শুনে এসেছিÑ তবে সাধারণমনি আবার কে! অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন স্ট্যাাঁসের ক্যাপশনের সঙ্গে যুক্ত ছবির তেমন কোনো মিল পাওয়া যায় না। সেটা কেবলই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবার উদ্দেশ্যে আপলোড করা হয়। আমার এই শিরোনাম সব পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে নয় বরং যার দৃষ্টি আকর্ষিত হলে- সত্যিকারের অর্থে কাজে দেবে শুধু তাদের জন্য। সাধারণমনি শব্দটি রূপক আশ্রয়ে ব্যবহার করেছি যাতে বাংলাদেশের সাধারণ মেয়েদের বোঝানো হয়েছে। এতদিন জনসাধারণ জানতেনÑ দেশে ন্যায্য বিচার নেই। এখন যতটুকু ন্যায়বিচার হচ্ছে, সেটির মধ্যেও বৈষম্য ঢুকে গিয়েছে। সম্প্রতি জনপ্রিয় তারকা পরীমনি আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাকে ধর্ষণচেষ্টার ব্যাপারটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তার একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে। এমনকি, একদিন পার হতে না হতেই অভিযুক্ত আসামিদের পুলিশ আঁক করে। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হবে এটাই স্বাভাবিক। নামকরা এই সেলিব্রেটিকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এই প্রসঙ্গ তোলার কারণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। দেশের এমন হাজারো নির্যাতিতা, ধর্ষিতা নারী আছেন- থানা-আদালত ঘুরতে ঘুরতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, তবুও বিচার আদায় করতে পারেন না নানান জটিলতার কারণে। কোথায় গেলে সুবিচার পাবেন, এটি জানতে জানতে মামলা খারিজ হয়ে যায়।
আবার এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে ভিকটিম অভিযোগ পর্যন্ত থানায় দাঁড় করাতে পারেন না। ২০১৭ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে হজরত আলী নামের এক বাবা তার পালিতা শিশুকন্যা আয়েশাসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আয়েশা ধর্ষিত হয় এবং সেই বিষয়ে মামলা করতে গেলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। সেই এক বুক হতাশা নিয়েই আলী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়Ñ বাংলাদেশে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করাটাই জটিল, বিচার পাওয়া দূরের কথা!
কিছু কিছু মামলা যুগ পেরিয়ে গেলেও নিষ্পত্তি মেলে না। এর কারণ উচ্চ আদালতের আপিল। অর্থাৎ নিম্ন আদালতে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ হলেও- উচ্চ আদালতে আপিলের নামে সময় পার হয়ে যায়। এতে করে অপরাধীরা আরামে এলাকায় শিনা টান করে চলাফেরা করে। হুমকির মুখে পড়ে ভুক্তভোগীরা। অনেকে ভয়ে মামলা তুলে নেয়। কেউ কেউ মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মিটমাট করে ফেলে। কিছুদিন আগে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় স্বামীর সামনে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। ১২ জুন পত্রিকার মারফতে জানতে পারি- ঘটনার ৯ দিন পার হয়ে গেলেও কোনো আসামিকে গ্রেফতার করেননি পুলিশ। অথচ আসামিরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে! শুধু তাই নয় মামলা নথিভুক্ত করার জন্য ধর্ষিতার স্বামীর কাছ থেকে টাকাও দাবি করে অফিসার ইনচার্জ। আমরা জানি, আইন কোনো বৈষম্য করে না। সেটি সবার জন্য সমান। আজ একজন জনপ্রিয় নায়িকার সুবিচার পেতে বিলম্ব হচ্ছে না, কিন্তু সাধারণ নারীর বেলায় এমনটা হয় কেন!
পরীমনিকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন দ্রুত তৎপরতার কারণ তার সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে। আমাদের দেশের কত নির্যাতিত, ধর্ষিত মেয়ে যে পরী না হওয়ার কারণে ন্যায়বিচার পান না- পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়।
কেন অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, এ যাবতকালে আইন বিশ্লেষণকারীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক তথ্য দিয়েছেন। গোলটেবিলের টকশোতে এ নিয়েও তর্কবিতর্ক কম হয়নি। হুমকি, যথাযথ শাস্তি প্রয়োগের অভাব, মামলা দীর্ঘ সময় ধরে চলাসহ নানান কারণ তারা দেখিয়েছেন। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রে এসব ভয়ঙ্কর মামলাকে মামুলি হিসেবে দেখা হয়। এর পিছনে যে কারণ কাজ করে, তা এখন অবধি কেউ মৌলিক কারণগুলোর তালিকায় রাখেননি। যেমন, কোনো ধর্ষিতা কিংবা নির্যাতিত নারী বিভিন্ন প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য যখন আকুতি করে; প্রথমেই তার দিকে আমরা এমনভাবে দৃষ্টি দিই; যেন তিনি মিথ্যা বলছেন, ছলনা করছেন। তাকে বিশ্বাসেই করতে পারি না যে- সে এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে উঠে এসে সেসব ঘটনা বর্ণনা করছেন। অনেক ভিকটিমের মনোবল দুর্বল হয়ে যায় ঠিক এখানে। ভাবে হয়তো কখনোই সে ন্যায়বিচার পাবে না; পেলেও তাকে নানা হয়রানির শিকার হতে হবে। যেখানে প্রশাসন নির্যাতিতের আশ্বাস দেন না, সেখানে অপরাধীর বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি কীভাবে পাবে!
পরীমনি পুলিশ প্রশাসনের প্রতি যেভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন- সাধারণ নারীরা সেই আস্থা এখন পর্যন্ত কেন কুড়াতে পারছেন না, এটা নিয়ে জোরালোভাবে ভাবতে হবে। যখন একজন নিপীড়িত নারী ভরসা পাবেন, তার পিছনে প্রশাসন রয়েছে, মিডিয়া রয়েছে, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ রয়েছেন- তার কাছে তখন এক যুগ কোনো কিছুই মনে হবে না। কয়েক যুগ পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাবেন। অপরাধীর অপরাধের শেষ দেখে তবেই ছাড়বেন। উপরিউক্ত, তারকা পরীমনি যাদের নিয়ে অভিযোগ করেছেন তারা দোষী কী নির্দোষ সেটি আদালতের বিচারের ব্যাপার।
সাজ্জাদ হোসেন : শিক্ষার্থী, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া