কবির কফিনের ওজন আর ভাষার ভার
শহীদ ইকবাল
🕐 ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ, মে ১১, ২০১৮
শিরোনামটা নিয়েছি পশ্চিমবঙ্গের কবি শ্রীজাত-এর কাছ থেকে, বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুর পর। ‘কবির মৃত্যু’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- কোনো এক সময়ে। সেখানে শেকল দিয়ে বাঁধা এক নিষ্পাপ কবিকে দেখা যায়। রাষ্ট্র তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কবি বর্ণনার মধ্য দিয়ে তার নৃশংসতা ও বীভৎসতার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন।
তবে শেষ পর্যন্ত, কবির মৃত্যু হয়। কবি রেখে যান, এক বুক ভালোবাসা আর মূল্যবোধ, সব মানুষের জন্যই শুধু। নিজে মৃত্যুবরণ করেন কবি, বিনাশী হন, সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্যই শুধু। এই তো কবি। কবির কাজও তাই বটে। কিন্তু সমাজে কবি কারা! শুধু কবিতা লিখলেই কি কবি হওয়া যায়!
বেলাল চৌধুরী বেশ রোগ-শোক বহন করেই মারা গেলেন। কিন্তু একদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা, বই বিছিয়ে রাতভর শুয়ে থাকা, স্বপ্নমাখা কোর্তেজার কতসব গল্প, জীবনের গল্প, বাঁচার গল্প- প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঊর্ধ্বে জীবনের গল্প, জীবনবাদিতার গল্প- এই তো আমাদের কবি।
কবি বেলাল চৌধুরী শুধু কবিতাই লেখেননি, কবিতাকে ব্যবহার করেছেন- মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য, জীবনের বার্তা বহনের জন্য। প্রগতিশীল আন্দোলনগুলোর সঙ্গে থেকেছেন তিনি, পাশে থেকেছেন সবরকম মানুষের সঙ্গে, সংস্কৃতির জন্য কাজ করেছেন, সংস্কৃতিবান প্রজন্মের জন্য কাজ করেছেন। সেজন্য ভাষাকে কাজে লাগিয়েছেন কবি বেলাল চৌধুরী। ভাষাকে চেতনার মধ্যে সেঁধিয়ে দিয়েছেন যেন। দ্রুতলয়ে কাজের মানুষদের এড়িয়ে সৃজনশীলতায় অধীনহীন আশ্বস্ত স্বাধীন মানুষের বীজ বপনের চেষ্টা করেছেন নিরন্তর। এই তো কবির ধর্ম! কবিধর্মও তাই বটে।
বেলাল চৌধুরীর মৃত্যু শুধু নয়, একদিন কাকডাকা ভোরে সকালে শুনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেছেন। আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথায় পড়ি, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে-র কবি মারা গেলে- সেদিন সকাতরে স্কুলের পাঠ বন্ধ। মন খারাপ করে কেউ আর স্কুলে যেতে পারেননি। কষ্টটা খুব বড় হয়, যখন শুনি শক্তি চট্টোপাধ্যায় মারা গেছেন কিংবা শামসুর রাহমান বা সৈয়দ হক যখন মারা যান।
এই কবিদের মৃত্যু হয়তো স্বাভাবিক বা আর দশটা মানুষের মতো নয়- কারণ, তাঁরা কৃষ্টি তৈরি করেছেন, শ্রেষ্ঠত্ব কী সেটা জানিয়েছেন- কিন্তু তার বাইরে এ সমাজে-রাষ্ট্রে তাদের কি-ইবা গুরুত্ব আছে! ওই মৃত্যুর পর কে-বা ওসব মনে রাখে। কেনই বা মনে রাখবে! কবিকে ‘বাঁচানোর’ এ সমাজে আদৌ কি কারও দায়িত্ব আছে! জীবনানন্দ দাশ থেকে পড়ি ‘আসল প্রশ্ন হচ্ছে ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তিত হওয়া দরকার; কিন্তু সেই পরিবর্তন আনবে কে? সেই পরিবর্তন হবে কি কোনোদিন? যাতে তিন হাজার বছর আগের জনসাধারণ কিংবা আজকের এই বিলোল ভিড়ের মতো জনসাধারণ থাকবে না আর? যাতে এলিজাবেথের সময়ের ইংল্যান্ডে কিংবা ধরা যাক ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাঙলাদেশে যে সব শ্রেষ্ঠ কাব্য রচিত হয়েছে গণ-পাঠক সে সবের গভীর বুদ্ধি হয়ে দাঁড়াবে? ভাবতে গেলেও হাসি পায়।
কিন্তু তামাশার জিনিস নয় হয়তো। যখন দেখি শুধু তৃতীয় শ্রেণীর সঙ্গীতশিল্পীও চিত্রশিল্পীই শুধু নয়, এদিককার উচ্চতর শিল্পীরাও দিকে দিকে স্বীকৃত হচ্ছে তখন জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয় প্রথম শ্রেণীর কবি নির্বাসিত হয়ে রয়েছে কেন? কিন্তু যখন দেখি তথাকথিত সভ্যতা কোনো এক দারুণ হস্তীজননীর মতো যেন বুদ্ধিস্খলিত দাঁতাল সন্তানদের প্রসবে প্রসবে পৃথিবীর ফুটপাথ ও ময়দান ভরে ফেলেছে তখন মনে হয় যে কোনো সূক্ষ্মতা, পুরনো মেদ ও ইন্দ্রলুপ্তির বিরুদ্ধে যা, পুরনো প্রদীপকে যে-অদৃশ্য হাত নতুন সংস্থানের ভেতর নিয়ে গিয়ে প্রদীপকেই যেন পরিবর্তন করে ফেলে; তার এই সাময়িকতা ও সময়হীনতার গভীর ব্যবহার যেন মুষ্টিমেয় দীক্ষিতের জন্য শুধু সকলের জন্যে নয়- অনেকের জন্যে নয়।’ এই মূল্যবোধের কিনারে দাঁড়িয়ে একজন ‘বেলাল চৌধুরী’র (কিংবা অন্য যে কোনো কবি এখানে যা প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত) চলে যাওয়াকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব! বিষয়টি খুবই গুরুত্ববহ।
একজন কবি আসলে সমাজের জন্য কী করেন? তার লেখা কতজন পড়েন? এই দরিদ্র দেশে একজন কবির কাজ কী? কে তাকে পড়ে বা প্রয়োজনীয় মনে করে! কিন্তু যে মূল্যবোধ কবি সৃষ্টি করেন তা কি কারও সমতুল্য? এটি অসম্ভব।
কেননা কবি সমাজে বাস করেন, অতুল ঐশ্বর্য তার প্রতিটি মুহূর্ত, জীবনের প্রতিটি মাহেন্দ্রক্ষণই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এজন্য তিনি ত্রিকালের দার্শনিক, প্রভূত-পথের পথিকৃৎ- সবকিছু মিলে তার কিছুই নেই কিন্তু আছে সবকিছু। এবং এই সমাজের জন্যও তিনি অনিবার্য। তিনিই সমাজের মুখ্য ব্যক্তি। পরোক্ষভাবে প্রজন্মও সৃষ্টি করেন তিনি। জন্ম দেন নতুন চিন্তা ও মূল্যবোধের। সৃষ্টি করেন অমোঘ কিছু। আলু-পটল কিংবা শেভিং ব্লেডের মতো তিনি নন। কোনো মাপ তার খাটে না। সেখানেই সমাজের আর দশটা মানুষের সঙ্গে তার পার্থক্য।
জীবনানন্দের উদ্ধৃতিতে হয়তো তার মুশকিল সময়ের কথা আছে, তীব্র সত্যের ভেতর দিয়ে কবির-নির্মাণের সন্ধানসূত্র বপনের ক্ষেদ আছে কিন্তু এটিও তো সত্য যে কবিকেও পরিশুদ্ধ হতে হয়। সম্মুখে এগুতে হয়। সমস্ত সুখ-সুবিধাকে বাতিল করতে হয়। আর এসব বাতিলের ভেতরেই তার নতুন আবাহন রচিত হয়। কৃষ্টির জগতে তিনি চিরতরুণের মহিমা পান। বর্ণ-গন্ধে-রঙে আনেন নতুন কোনো দিকসঞ্চারী ঠিকানা।
সেটা কবি ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। কারণ, সবাই প্রয়োজনের অনুষঙ্গ মাপে বড়, কেউ অপ্রয়োজনেরটা মাপে নয়। একজন আমলা, একজন মিলিটারি, একজন ব্যবসায়ী সকলেই নির্ধারিত-মাপে তৈরি। আমরা সমাজের অনেকেই ওই ‘নির্ধারিত’ মাপেই চলি। কিন্তু কবির কোনো মাপ নেই। এই মাপ না থাকা মানুষকে পরিশ্রম করতে হয়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বহুদূর যেতে হয়। বিরামহীন তার জগৎ। এবং এই জগতের তাবৎ রস আহরণ করেই তিনি শ্রেষ্ঠ। আর সাধারণ মানুষ যখন সৎ কবির সঙ্গে চলেন, তখন তিনিও মাপহীন থাকেন। এজন্য তাকে অনেক কিছু আহরণ করতে হয়। চিন্তার চর্চা করতে হয়। মণিমুক্তো আহরণও জরুরি হয়ে পড়ে। তা না হলে সে নিজেও ব্যর্থ।
তাই এই নির্ধারিত মাপের বাইরে মানুষ সৃজনের অমোঘ কাজটি করেন ‘কবি’। তাই তিনিই টিকিয়ে রাখেন জনসমাজ। তিনিই পরিবর্তন-আবর্তন-প্রগতির নিয়ামক হন। এই নিয়ামকই জীবনের পূর্ণতর সাক্ষী। অগ্রসর হওয়ার পথ। তাই যে কোনো কবির মৃত্যু সহজ নয়। আমরা অনেককেই হারিয়েছি, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমরা তাদের জন্য কিছু করতে পারিনি। এই না-পারাটার কারণ, আমাদের কৃষ্টির উচ্চতার সংকট।
মানুষ সৃজনের কাজটি যেখানে সবচেয়ে অবহেলিত। সকলেই শুধু নির্ধারিত মাপের মানুষ চায়। ফলে, সমাজে ঝাঁ-চকচক অনেক কিছু আছে কিন্তু মন নেই; মানস নেই। আছে শুধু বিকার। এই বিকারে প্রগল্ভতা বাড়ছে। ফলে সমাজের কোনো গুণ-মান থাকছে না। সমাজ আছে, চলমান, বিবর্তনও হয়তো হচ্ছে কিন্তু মন নেই, মৌলপন্থা দুর্বল। দুর্বহতায় ভরা। কারণ, সকলেই প্রয়োজনের পথ খোঁজে। কেউ অপ্রয়োজনের নয়, তাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কেউ হারতে চায় না, পেতে চায় অমরত্ব আর অসীম অহংকার। সুতরাং কবিদের নির্বাসিত হতে দেওয়া যাবে না। সমাজের প্রয়োজনেই তাদের বেঁচে থাকতে হবে। বাঁচাতে হবে। নইলে কবিকে বাঁচানোও যাবে না।
এখন পুঁজিবাদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সময় চলছে। এখন সবাই ‘নির্ধারিত মাপে’র মানুষ। প্রয়োজনের মানুষ। ফলে সমাজে নেমে এসেছে অন্ধকার। এই অন্ধকার তাড়াবেন কে? আমাদের সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অভিভাবক কবি। একমাত্র কবিই তা পারবেন নামাতে। ফলে এই পারঙ্গমতার সূত্রে কবিদের নির্বাসিত হতে হয় নানাভাবে। কিংবা মৃত্যুর পরও হারিয়ে যান, কাক্সিক্ষত ফললাভ হয় না। সেজন্য বেলাল চৌধুরীর আনুষ্ঠানিকতা সাময়িক। অনানুষ্ঠানিক কিছু নেই। তুলনাহীনের তুলনা যেমন নেই।
ফলে কবিকে যেতে হয়। স্বাভাবিক নিয়মেই উপায়হীনরূপে যানও তিনি, কিন্তু তাঁর জন্য অস্বাভাবিক কিছু হয় না। অস্বাভাবিক হয়ে যদি সমাজের ঘানি টানেন তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাভাবিকরা তার পেছনে লাগে। তাকে বরদাস্ত করে না। ফলে এক অর্থে এই দেশে কবিরা নির্বাসিত। এই নির্বাসন থেকে কি ফিরিয়ে আনা যায় না? যায়। কারণ, মানুষ পেছনে যেতে চায় না, সামনেই যাবে, বরাবরের মতো। তবেই স্বাভাবিক জয় আমাদের অনিবার্য।...
শহীদ ইকবাল : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]