ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিপরীত সম্পর্ক

শফিক নহোর
🕐 ২:৫৯ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২১

বিপরীত সম্পর্ক

সুমন নামের ছেলেটির সঙ্গে কিছুদিন আগে এই চায়ের দোকানে কথা হয়েছিল; কথা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে হয়ে থাকলেও সবকথাই মনের গভীরে দাগ কাটে না। ছেলেটির কথায় আন্তরিকতা ছিল। বিনয় সুরে কথা বলেছিল, সেই কথাগুলো টুংটাং শব্দ হয়ে মনে হচ্ছে ছেলেটি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কানের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছে, তার পরের দৃশ্য ছেলেটি একটা সিগারেট জ¦ালিয়ে আবার কথা শুরু করল। আমি তার বিমুগ্ধ পাঠক হয়ে তার কথার জাদুবানে হারিয়ে গেলাম।

এই চায়ের দোকানে প্রতিদিন শতশত মানুষ চা, সিগারেট, পান খায়। অল্প টাকার ব্যবসার ভিতর এ ব্যবসাটা বেশ লাভজনক অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ। তার উপরে নগদ বিক্রি। তৈল পাম্পের পাশে এমন একটি দোকান পাওয়া এখন সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। একজন আসছে, দুজন বের হচ্ছে, আবার চারজন এসে হাজির। চলমান রাস্তার পাশের এ দৃশ্য অতি পরিচিত। কারও কারও চোখে তা হয়তো সহ্য হয়নি এখানে যখন সে প্রথম ব্যবসা শুরু করে। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।

বড় পর্দায় বাংলা সিনেমা চলছে, ডিস লাইনের সিডি চ্যানেলে। দর্শক রিকশাচালক থেকে শুরু করে ইটভাটার লেবার আর চলতি পথের পথিক। কেউ কেউ কেমন মেকি হাসি দিয়ে দুঃখ করে বলছে, এই সিনেমা আগে হলে গিয়ে দেখেছিলাম। তাও কত কষ্ট করে টিকিট কাটতে হয়েছিল। বাংলা সিনেমা এখন কেউ দেখতেই চায় না। দুই একটা ভালো সিনেমা তৈরি হলেও থানা শহরের হল মালিক না আনতে নারাজ। এদিকে সত্যিকার ভালো সিনেমার দর্শক হারাতে বসেছে।

এখন আর সেই পরিবেশ নেই। পরিবেশ ঠিকই আছে তবে পরিবেশন ঠিক আগের মতো নেই।

এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। ডাটা অন করলে পৃথিবীর সব নাম করা নায়ক গায়ক একসঙ্গে মোবাইলের উপরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। মানুষ সিনেমা হলে যাবে কোন দুঃখে। সিগারেট শেষ না হতেই গাড়ি থেকে একটি মেয়ে নেমে এলো। টেবিলের ওপর থেকে জগ থেকে পানি ঢেলে খেতে বসতেই গ্লাস কাত হয়ে পড়ে গেল। পানির স্পর্শ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশে বসে থাকা ছেলেটির হাতের সিগারেট নিভে গেল। ছেলেটি মুখের কাছে সিগারেট আবার টান দিতেই বুঝতে পারল তাতে আগুন নেই, কোনো ধোঁয়া বের হলো না। তক্ষুনি মেয়েটির মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই মেয়েটি মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে। মুখ না দেখে কাউকে কিছু বলাটা ঠিক না, এ কথা ভেবে মুখ থেকে ছেলেটির হয়তো কথা বের হয়নি।

দুই.
চায়ের দোকানি পুনরায় গ্লাস ভরে মেয়েটির হাতে দিতেই বলল, ধন্যবাদ আপনাকে।
আমাকে একটি পানির বোতল দিন। দোকানি প্রথমে একটু শঙ্কিত হয়ে জানতে চাইলেন- ম্যাম, এক লিটার নাকি হাফ লিটার?
হাফ লিটার দেন।
বিশ টাকার একটা নোট বের করে দিলেন। দোকানি পাঁচ টাকার একটি কয়েন ফেরত দিলেন।
ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতরে রাখবে ঠিক তখন একজন মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। বাচ্চা কোলে নিয়ে দেশে ভিক্ষা করা এখন কিছু মানুষের কাছে এখন পেশা; মেয়েটি তাকে পাঁচ টাকার কয়েনটি দিয়ে গাড়ির দিকে রওনা দিল দ্রুত।
দোকানি আবার একটা চা বানিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, চা-টা খেয়ে নিন। এটার টাকা দিতে হবে না।
আপনার কথা আমার ভালো লাগছে তাই আমার পক্ষ থেকে আপনকে চা খেতে দিলাম। না করবেন না প্লিজ!
পৃথিবীতে এখনো হয়তো অনেক ভালো মানুষ আছে কেউ কেউ আমাদের চোখে পড়ে কেউ পড়ে না। চা দোকানি যথেষ্ট সহজ-সরল। স্বচক্ষে আমি যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে মানবিক। তিনটা কুত্তাকে সকালে দুপুরে পাউরুটি খেতে দেয়। অন্য দোকানির থেকে চায়ের দাম এক টাকা কম। মান যদিও সবার থেকে ভালো। যদিও এই সময়ে সবাই কমার্শিয়াল চিন্তাভাবনা করে কাজ করেন। বেশি বিক্রি করে অল্প লাভ করেও ভালো ব্যবসা করা সম্ভব। শুধু আমাদের দেশের এলিট শ্রেণির ব্যবসায়ীরা কখনো তা মানতে চাইবে না। চাহিদা একটু বেড়ে গেলেই দাম বেড়ে যাবে। কে মরল আর কে বাঁচল তা নিয়ে কেউ কখনো ভাববে না। সবাই মহাব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। তবে যা দেখেছি, সত্যিই একা কখনো ভালো থাকা যায় না।
চাচা, আমার কত হলো?
ত্রিশ টাকা।
চাচা আপনার তো মনে হয় ভুল হচ্ছে। আমার হিসাবে সাতচল্লিশ টাকা হয়। কম বলছেন কেন?
বেশি হলে হয়েছে, আমি এর বেশি রাখব না। দোকানে সবাই কি কাস্টমার? কেউ কেউ লক্ষ্মী হয়েও আসে।
ও তাই, জানতাম না তো!
ছেলেটির হাত থেকে টাকা ধরতেই ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

তিন.
মেয়েটি আবার পানি নিতে এসে পাঁচশ’ টাকার নোট দেখিয়ে পানির বোতল নিয়ে চলে গেল।
মেয়েটি গাড়ির কন্ডাক্টরকে খোঁজ করেছে; ভাংতি টাকার জন্য। ইতোমধ্যে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। দৌড়ে এসে কন্ডাক্টর গাড়িতে উঠল।
ওস্তাদ, এই লন, আপনার পান আর সিগারেট।
কন্ডাক্টরকে কিছু একটা বলতে চেয়ে মেয়েটির ঠোঁটের কার্নিশে কথা আটকে গেল।
গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে; টিভির পর্দায় যেমন মুখ ভেসে ওঠে তেমনি দোকানির চেহারা ভেসে ওঠা শুরু করল। চোখ বন্ধ করলে হয়তো তাকে দেখা যাবে না। কিন্তু না, কী এক আজব ভাবনা চোখ বন্ধ করে রাখলেও রঙিন টেলিভিশনের চেয়ে চকচকে মুখাবয়ব ভেসে উঠতে লাগল তার দু’চোখে।
নেলী, মোবাইল ফোন বের করে ফটোগ্যালারিতে চোখ বোলাতে লাগল।
‘হ্যাঁ’।
এই তো সেই দোকান।
যে দোকান থেকে আমি পানির বোতল নিয়েছিলাম।
দোকানিকে টাকা দেওয়া হয়নি।
নিজের মোবাইল ফোনের ফটোগ্যালারিতে ফটো দেখতে দেখতে একটা সময় নজর আটকে যায় চা স্টলের সাইনবোর্ডের মোবাইল ফোন নম্বরে!
নম্বরটি ডায়াল করতেই ওপর পাশ থেকে উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ ভেসে এলো।
হ্যালো, আমাকে কি শুনতে পাচ্ছেন। নেলী বলছি। আপনার দোকান থেকে পানির বোতল নিয়েছিলাম। টাকা দেওয়া হয়নি তাই ভেবেছি কীভাবে পাঠাব।
আপনি যে নম্বরে কল করেছেন; এটা একটা জাতীয় দৈনিকের ফটো সাংবাদিকের নম্বর। সুমন সাহেবের বাবা আজ মারা গিয়েছেন। তাই অনেক মানুষের কান্নাকাটির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। আপনি কে বলছেন?
আমি নেলী। ঢাকা থেকে আসার পথে আপনার দোকান থেকে পানি নিয়েছিলাম। দাম পরিশোধ করা হয়নি।
আপনি হয়তো ভুল নম্বরে ডায়াল করেছেন।
দুঃখিত, এটা কোনো চা স্টলের নম্বর নয়।
ভুলবশত হয়তো এমন হতে পারে। পুনরায় নম্বরটা মেলাতে চেষ্টা করল। নম্বর ঠিক আছে কিন্তু...! এই ফটো সাংবাদিক কে?

চার.
চাচা, ডবল লিকারের এককাপ চা দিন।
চা মুখে দিতেই কথার ডালি খুলে বসলেন ফটো সাংবাদিক সুমন।
সবাই তো করোনার টিকা নিচ্ছে, আপনি কবে নেবেন?
আমাগো কি টিকা দিব, শুনছি ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সাংবাদিক, সরকারি চাকরিজীবী তাগো সবার আগে দিব। আমরা চায়ের দোকানদার, আমাগো নিয়ে ভাববার সময় আছে কার গো বাজান।
স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলে কি পোলাপান লেখাপড়া করতে চায়। সারাদিন মোবাইল ফোনে গেমিং আর ফেসবুক নাকি টিকটক বানাইব। পোলাপান সময় পেয়ে কাজে না লাগিয়ে নষ্ট করছে বেশি। পোলাপানরে টিকা দিয়া স্কুল খুলে দিলেও তো লেখাপড়া করতে পারত, তা বাজান তুমি কি টিকা নেবে?
জি চাচা। আমার আগামীকাল টিকা নেওয়ার ডেট পড়েছে। তাই ঢাকায় যাওয়া।
আপনি চা দোকানি হলেও সমাজ-সংসার নিয়ে বেশ ভালোই ভাবেন। আপনাকে ভালো লাগে তাই এখানে চা খেতে আসি। আপনার সংসারে আর কে কে আছেন?
কেউ নাই বাজান। আমি একাই।
আপনার দোকান তো ভালোই চলে মনে হয়। টাকাপয়সা কী করেন? দুঃখিত, আপনাকে ব্যক্তিগণ প্রশ্ন করে বসলাম।
আপনি তাও জানতে চেয়েছেন; আজকাল তো কেউ জানতেই চায় না। টাকাকড়ি কী আর করব জমা করি। তবে নিজের জন্য না।
কার জন্য জমা করছেন?
আমার খোকার জন্য। এবার ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে দেখা করে যাইবেন। আমার খোকার একখান ফটো আছে ছোটকালের, আপনারে দেখামু। আপনি পত্রিকায় দিলে যাতে আমার খোকারে খুঁইজা পাই।
আজ তাহলে যাই। দোয়া করবেন।
কথা দিলেন আসবেন কিন্তু।
কথা দিলেই কাজ কেমন হালকা হয়ে যায়। আমার কাছে মনে হয় কথা দেওয়ার আগেই সম্পর্ক বেশি ভালো থাকে।
সংসারের অভাবের কারণেই খোকার মা সেই যে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। আর কখনো ফিরে এলো না। স্বামী হিসেবে দোষ যে আমার ছিল না তা ঠিক না। তবে এমন অভিমানী মেয়ে আমি কখনো দেখিনি। পোলাটার জন্য আজও অন্তর কান্দে। জানি না আমার খোকা আজ কত বড় হয়েছে। সত্যিকার মানুষ হয়েছে কিনা। শুনেছি, বাবা না থাকলেও মেয়েরা কষ্ট করে হলেও নিজের বাচ্চা মানুষ করে। জানি না হাজেরা আমার খোকাকে মানুষ করেছে কিনা। মানুষটা এত অভিমানী সত্যিই সেদিন বুঝতে পারিনি। তারপর থেকেই আমি সংসারহারা। নিজের বলে সেদিন থেকে আর কিছু নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি; কিন্তু সন্ধান মেলেনি। আমিও গ্রাম ছেড়ে এই ইটের শহরে ঠাঁই নিয়েছি। কত মানুষ প্রতিদিন এ রাস্তা দিয়ে যায়। চোখ তুলে তাকিয়ে থাকি হাজেরাকে হয়তো খুঁজে পাব। সাতাশটা বছর হাজেরার প্রতীক্ষায় কেটে গেল। এই রাস্তার পাশে চা বিক্রি করতে করতে কত গাড়ি, কত মানুষ যায় শুধু আমার প্রিয় মানুষগুলো এই চেনা পথ ধরে হাঁটে না হয়তো কখনো।
দুপুর হয়ে গেছে করোনার টিকা নিতে। মহাখালীতে থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই সুমনের খালার বাসা। সুমনের বাবার মৃত্যুর পর থেকে সুমনের খালা একপ্রকার জোর করে বোনকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। বাসার ভিতর ঢুকতেই সোফা সেটের সামনে টি টেবিলের ওপর ক্যামেরা রেখে কাপড় পাল্টায়। শাওয়ার নিতে ঢুকে পড়ে এরপর। ক্যামেরা হাতে নিতেই সেই অপ্রত্যাশিত মানুষটির ছবি ভেসে উঠল সুমনের ক্যামেরার পর্দায়। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল হাজেরা বেগমের।
শাওয়ার শেষ করে বের হতেই সুমনের দৃষ্টি চলে গেল মায়ের দিকে। একটু এগিয়ে আসতেই সংগোপনে চোখের জল আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সুমন কিছু একটা বুঝতে পেরে মাকে কোনো প্রশ্ন করল না।
রাতে খাবার টেবিলে তার মা প্রশ্ন করল। ছবির মানুষটাকে কোথায় পেলে?
কেন মা, তুমি কি তাকে চেনো। খুব ভালো মানুষ। একটা চায়ের দোকান আছে তার। আমি অনেকবার গিয়েছি সেখানে।
হ্যাঁ, তাকে চিনি। তাকেই তো আমি সাতাশ বছর ধরে খুঁজছি।
কী বলো মা!
হ্যাঁ, ঠিক বলছি।
উনি তোর...!
পরের দিন সকালে রওনা দিলাম সেই চায়ের দোকানে। গাড়ি থেকে নামতেই কেমন বোকা হয়ে গেল সুমন। অনেক মানুষের ভিড়। সামনে একটু এগিয়ে যেতেই লোকজন বলা-কওয়া করছে, মানুষটা ভালো ছিল। তার নাকি একটা ছেলে আছে। মানুষের কাছে খুব গল্প করত।
পিছনে তাকিয়ে দেখি সেই মানুষটির লাশ নেই। চারদিকে শূন্য মাঠ রাস্তা দিয়ে বিমানগতিতে গাড়ি চলছে। কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করছে না। আমি ছাড়া।

শফিক নহোর : সাহিত্যকর্মী

 
Electronic Paper