বিশেষ ঈদ আয়োজন (২)
আম্মু
বিশ্বজিৎ দাস
🕐 ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ, মে ১০, ২০২১
মেয়েটি হাসছিল। হেসে কুটিকুটি হচ্ছিল। চোখে মুখে ছিল খুশির ঝিলিক। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল সুভার উপর। কৌতূহলী হলাম।
‘সুভা, কে ও?’
‘স্যার, আপনার নতুন ছাত্রী। আজ থেকে আপনার কাছে প্রাইভেট পড়বে।’
‘নাম কী?’
‘ওর নাম কি আমি বলব স্যার? এই মেয়ে, তুই তোর নাম স্যারকে বল।’ মেয়েটিকে চিমটি দিয়েছিল সুভা।
মেয়েটি হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়েছিল, ‘স্যার, আমার নাম বন্যা।’
‘পুরো নাম বলতে হয়, ঠিক না?’ হাসতে হাসতে বলেছিলাম।
দাঁত দিয়ে জিব কেটেছিল বন্যা।
‘ওমা! ঠিকই তো। স্যার, আমার পুরো নাম সুমনা শারমিন বন্যা। নীলফামারীতে আমাদের বাড়ি।’
এভাবেই বন্যার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। প্রতিবছর আমার কাছে বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রী ফিজিক্স বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে আসে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য। কেউ দু’মাস, কেউ চার মাস, কেউবা দু’বছরও প্রাইভেট পড়ে।
ফিজিক্স কঠিন সাবজেক্ট। এটা বুঝে পড়তে অনেক ছাত্রছাত্রীরই যে কষ্ট হয় সেটা বেশ বুঝতে পারি।
বাবা-মায়ের চাপে বা আগ্রহে অনেকে সায়েন্স পড়ে। ছেলেমেয়ের আগ্রহ আছে কিনা এটা এখানে দেখার বিষয় না। সবার কথা একটাই- ছেলেমেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানো চাই-ই চাই। ফিজিক্স না হয় একটু কমই ঢুকল ছাত্রছাত্রীদের মাথায়। ছাত্রজীবনে বাবা-মা নিজেও হয়তো ভালো করে ফিজিক্স বোঝেননি। নাম্বার পেতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। তবু জোর গলায় ছেলেমেয়েকে বলবেনই, এ-প্লাস কিন্তু পেতেই হবে।
ছাত্রছাত্রীদের অবস্থাও শোচনীয়। ক্যারিয়ারের পেছনে শুধু দৌড়াও আর দৌড়াও। না হয় একটু কমই বুঝলাম ফিজিক্স।
এত কথা বললাম এজন্য, বন্যাকে দেখেছিলাম- ফিজিক্সের বিষয়ে বেশ আগ্রহী। মাঝে মাঝে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে আমাকে চমকে দিত। সুভা নিজেও কম ভালো ছাত্রী ছিল না। কিন্তু বন্যার করা ছোট ছোট প্রশ্নগুলো শিক্ষক হিসেবে আমাকে তার প্রতি আলাদা মনোযোগ এনে দিয়েছিল।
যেমন- একদিন বন্যা আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করেছিল, ‘স্যার, সবকিছুই তো মাধ্যাকর্ষণের জন্য নিচের দিকে পড়ে যায়। তাহলে গাছের শিকড় বেয়ে পানি উপর দিকে ওঠে কেন?’
তার প্রশ্ন আমাকে চমকে দিয়েছিল। পানির পৃষ্ঠটান ধর্মের কারণে এমনটা ঘটে, সেটা তাকে বুঝিয়েছিলাম।
বন্যা আমার কাছে উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিল। দিনে দিনে টের পেয়েছিলাম, সে শুধু ভালো ছাত্রীই নয়, একই সঙ্গে সংস্কৃতিমনাও। বেশ ভালো গাইতে পারে মেয়েটি। স্কুলের বিভিন্ন ফাংশনে নিয়মিত গেয়ে এসেছে। পেয়েছে অনেক পুরস্কার।
মাথায় কোঁকড়ানো চুল আর চোখে বুদ্ধির ঝিলিক দেওয়া মেয়েটি এসব বিষয় কখনো আমাকে বলত না। বলত ওর বান্ধবী সুভা। দু’জনেই ছিল হরিহর আত্মা।
ওদের প্রাইভেটের ব্যাচ শুরু হতো সকালে। সুভা আগে আসত। বন্যা পরে আসত। সেই সময়টুকুতেই সুভা তার বান্ধবীর যাবতীয় গুণের বিবরণ আমাদের সামনে তুলে ধরত। বান্ধবীকে নিয়ে তার অনেক গর্ব ছিল। ব্যাচের অন্য ছাত্রীরা এ নিয়ে কিছুটা ঈর্ষাও বোধ করত মনে হয়।
একদিন ক্লাসে ঢুকেই দেখেছিলাম, বন্যার মুখে বেদনার ছাপ। পাশে বসা সুভা নিচু গলায় কী যেন বলছিল ওকে। পড়ানো শুরু করার আগে বন্যার মন খারাপের বিষয়টি খেয়াল করেছিলাম।
‘কী হয়েছে, বন্যা?’
‘ওর আম্মু ওকে বকেছে।’ সুভা জবাব দিয়েছিল।
‘কেন?’
‘আমি নাকি ঠিকমতো পড়তে বসছি না। পড়াশোনা কম করছি। আমার সাথে রাগ করে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে কাল রাত থেকে।’ অশ্রু ছলছল চোখে বলেছিল বন্যা।
মা-মেয়ের এমন মান-অভিমানের পালাতে আমার মতো প্রাইভেট টিউটরের কিছু করার থাকে না। তবু সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।
‘আম্মু তো বকবেই। এখন আম্মুর বকাবকি শুনে মন খারাপ করছ। কয়েকদিন পরেই তো চলে যাবে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে পড়তে। তখন এই আম্মুর কথাই বেশি বেশি মনে পড়বে।’
আমার কথা শুনে বন্যার চোখ থেকে পানি পড়তে শুরু করেছিল। বিব্রতবোধ করেছিলাম। সেদিন প্রাইভেট পড়ানোটা আর জমে উঠেনি। বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলাম। পরদিন মনে করিয়ে দিয়েছিল সুভা। বন্যা তখনো আসেনি।
সুভা আমাকে একা পেয়ে বলেছিল, ‘স্যার, আপনি কেন অমন করে বললেন?’
‘কী বললাম?’
‘আপনি যে বন্যাকে ওর আম্মুর কথা বললেন। বেচারি!’
‘আহা! আমি আবার কী দোষ করলাম। আম্মুরা কি মেয়েদের বকে না? তোমার আম্মু কি তোমাকে কখনো বকা দেয়নি?’
‘দিয়েছে। কিন্তু ওর ব্যাপারটা আলাদা, স্যার।’
‘আলাদা? আলাদা কেন?’
‘স্যার!’ ইতস্তত করেছিল সুভা।
‘বল।’
‘স্যার, ওকে বলবেন না তো-আমি বলেছি। শুনলে খুব রাগ করবে বন্যা।’
‘বলব না। তুমি বল।’
‘স্যার, বন্যার আম্মু তো বছর দুয়েক হলো মারা গেছে।’
চমকে উঠেছিলাম।
‘মানে?’
‘স্যার, গত পরশু বন্যা আপনাকে যে আম্মুর বকাবকির কথা বলল, তিনি ওর আপন মা নন। সৎ মা।’
‘কিন্তু বন্যার কথা শুনে তো মনে হলো...।’
বিস্ময় যেন বাঁধ মানছিল না আমার।
‘ও তো এই আম্মুকেও খুব ভালোবাসে। খুব মানে উনার কথা। উনি একটু বকলেই ভীষণ মন খারাপ করে।’
‘সৎ মা তো। একটু আধটু খারাপ হবেই।’
‘না স্যার। ভদ্রমহিলা খুব ভালো। বন্যা আর তার ছোটভাইকে খুব ভালোবাসে। একেবারে নিজের ছেলেমেয়ের মতো।’
‘দারুণ তো। বন্যার বর্তমান আম্মুর কি ছেলেমেয়ে হয়নি?’
‘হয়নি বা নেয়নি কিছু একটা হবে। তবে ওদের মা-মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো।’
‘সত্যিই চমৎকার। আজকের দুনিয়ায় এমন খুবই কমই দেখা যায়।’ মুগ্ধ হয়ে বলেছিলাম।
‘আপনি আরও অবাক হবেন যখন জানবেনÑ বন্যা তার আম্মুকে নিজে পছন্দ করে ঘরে এনেছে।’
‘মানে?’
‘বন্যা নিজেই তার আব্বুর জন্য পাত্রী মানে ওর বর্তমান আম্মুকে পছন্দ করে ঘরে এনেছে।’
‘দারুণ তো। ইন্টারেস্টিং! মেয়ে হয়ে বাবার বিয়ে দেওয়াÑ তাও আবার এই বয়সে!’ অবাক হয়েছিলাম শুনে।
পরে একদিন বন্যার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘তুমি নাকি নিজেই আব্বুকে বিয়ে দিয়েছ। নতুন আম্মু আসার পর তোমরা ভাইবোন কি কষ্ট পাওনি?’
চমক পাওয়া তখনো আমার বাকি ছিল।
‘কষ্ট পাব কেন! আমি নিজেই তো আব্বুর জন্য খুঁজে খুঁজে এই আম্মুকে পছন্দ করে এনেছি।’
‘কেন? একবারও কি তোমার মনে হয়নি, নতুন আম্মু তোমার আসল আম্মুর জায়গা নিতে পারবে না?’
‘সেসব ভাবিনি। আসলে আব্বুর তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল। আব্বু তো প্রেসারের রোগী। তাই সময়মতো ওষুধ না খেলে চলে না। আমি আর আমার ছোটভাই সোহেল স্কুলেই থাকতাম। তাই আব্বুর দেখাশোনার জন্যই আম্মুকে ঘরে এনেছি।’
‘কোনো অসুবিধা হয় না তোমাদের?’
‘নাহ্! কীসের অসুবিধা। আমরা তো মিলেমিশে ভালোই আছি। আম্মু খুব সুন্দর রান্না করতে পারে। আপনাকে একদিন দাওয়াত দিয়ে খাওয়াব।’
সেই দাওয়াত আমার কপালে জোটেনি। তবে ব্যাচে হঠাৎ একদিন মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হয়েছিল বন্যা।
‘স্যার, একটা খুশির সংবাদ আছে।’
‘তাই না কি? কী সুসংবাদ? নিশ্চয়ই পরিবারে নতুন ভাই বা বোন এসেছে?’ হাসতে হাসতে জানতে চেয়েছিলাম।
একরাশ বিষণ্নতা চেপে বসেছিল মেয়েটির সুন্দর মুখে।
দ্রুত সামলে উঠে বলেছিল, ‘স্যার, আমার ছোট ভাই সোহেল জেলা স্কুলে চান্স পেয়েছে।’
আমি বিব্রত হয়েছিলাম। দ্রুত একটা মিষ্টি প্যাকেট থেকে নিয়ে খেতে শুরু করেছিলাম।
‘সোহেল, কোন কোচিং থেকে চান্স পেয়েছে?’
‘ও কোথাও কোচিং করেনি। সব আমার আম্মুর অবদান। আম্মু ওকে পড়িয়েছে; পরীক্ষা নিয়েছে।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’ বন্যার নতুন আম্মুর কথা যতই শুনছিলাম, ততই অবাক হচ্ছিলাম। দ্বিতীয় বিয়ে সুখের হয় না বলেই জানতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখছি উল্টোটা।
বন্যার নতুন আম্মুকে একবার দেখার আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। সে আগ্রহ মিটিয়েছিল অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা।
কিছুদিন থেকেই বন্যা প্রাইভেট পড়তে আসছিল না। সুভার কাছে জানতে চেয়েছিলাম।
ও বলেছিল, ‘স্যার, আমি জানি না। আমার সঙ্গে বন্যার দেখা হচ্ছে না।’
‘তুমি ওর বাসায় যেতে পারতে।’
‘গিয়েছিলাম স্যার। ওরা ভাইবোন দুজনেই বাবার বাসা ছেড়ে নানির বাসায় গিয়ে উঠেছে।’
‘ও, তাহলে এই ব্যাপার। নানি বাড়ি বেড়াতে গেছে দুজনে।’
‘না স্যার। ওরা দুজনে বাবার বাসা ছেড়ে নানির বাসায় গিয়ে একেবারে উঠেছে।’
চমকে উঠেছিলাম। এমন তো হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি আম্মুর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে ভাইবোনে নানিবাড়িতে চলে গেছে। সৎমা কি তাহলে শেষপর্যন্ত তার আসল রূপ দেখাতে শুরু করেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর অপ্রত্যাশিতভাবে একেবারে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছিল। ভাবিইনি এভাবে উত্তর নিজেই চলে আসবে সামনে।
মনে আছে, রোজকার মতো সন্ধ্যাবেলা হাঁটাহাটি করার জন্য রেডি হয়েছিলাম সেদিনও। গেট খুলতেই দেখি, একটা নারীমূর্তি আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটখাটো। বেশি মোটা নন মহিলা। আলোর বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছেন বলে তার মুখ দেখতে পেলাম না।
‘কাকে চাই?’ জিজ্ঞেস করেছিলাম।
‘আপনিই কি স্যার? এখানে প্রাইভেট পড়ান?’
‘জি, বলুন।’
‘আমি বন্যা-সোহেলের আম্মু।’
সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হয়েছিলাম।
‘আদাব আপা। ভিতরে আসুন।’
‘আজ আর ভেতরে বসব না ভাই। অন্যদিন আসব। একটা কথা জানতে এসেছি।’
‘জি, বলুন।’
‘বন্যা কি এখনো আপনার কাছে পড়তে আসে?’
‘না আপা। কয়েকদিন ধরে বন্যা তো পড়তে আসছে না।’
দীর্ঘশ্বাস চেপেছিলেন মহিলা।
‘ওর মামারা জোর করে ওদের নিয়ে গেছে নিজের কাছে। আমাদের কাছে রাখবে না।’
‘বন্যারা কিছু বলেনি?’
‘বন্যা, সোহেল যাবেই না। তবু ওদের মামারা জোর করে নিয়ে গেল। আমি নাকি সৎমা। বলেন তো ভাই, সৎ মানে কি ভালো না খারাপ?’ ফুঁপিয়ে উঠেছিলেন মহিলা।
আমি চুপ করেছিলাম।
‘ওদের নিজের ছেলেমেয়ের মতোই ভাবি। কখনো ওদেরকে বকাবকি পর্যন্ত করি না। অন্যের আমানত ভেবে সযতেœ আগলে রাখি।’ চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন মহিলা।
চুপ করে শুনছিলাম।
‘আজকের দুনিয়ায় বন্যার মতো লক্ষ্মী মেয়ে আর হয় না। নয়তো নিজের বাবার জন্য দ্বিতীয় মাকে কেউ পছন্দ করে ঘরে আনে! আমার আগের স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি তো অসহায় অবস্থায় ছিলাম। বন্যাই তো আমাকে উদ্ধার করল। আজ যদি বিয়ে ওর বাবার সাথে না হতো, কোথায় থাকতাম আমি!’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছিলেন মহিলা।
‘বন্যা যদি পড়তে আসে, আমি ওকে বোঝাব আপা। আপনি বাসায় যান।’
ভদ্রমহিলা চলে গিয়েছিলেন। তখন আমার মনে পড়েছিল, আরে! মহিলার নামই তা জানা হলো না।
বন্যা এরপর বহুদিন আমার কাছে পড়তে আসেনি। সুভাও আমার কাছে প্রাইভেট পড়া ছেড়ে দিয়েছিল। তাই আর জানা হয়নিÑ বন্যা মামার বাসায় কেমন আছে।
দেখতে দেখতে ভুলেই গিয়েছিলাম বন্যা-সুভার কথা।
সে বছর এইচএসসি পরীক্ষার শুরুতে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হয়েছিল বন্যা।
‘স্যার, কেমন আছেন?’ তার হাসি তেমনই আছে।
‘তুমি পড়তে পড়তে হঠাৎ প্রাইভেট ছেড়ে দিলে যে?’
‘কী করব স্যার, মামারা জোর করে ওদের ওখানে নিয়ে গেল। ওখান থেকে তো আর পড়তে আসতে পারি না।’
‘কোথায় তোমার মামাবাড়ি?’
‘ফুলবাড়ী উপজেলায় স্যার। এখান থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে।’
‘তাই তো! অতদূর থেকে তুমি আসবে কীভাবে?’
‘স্যার, দিনাজপুরে এলে আপনার সাথে দেখা করতে আসব। আজ যেমন এসেছি।’
‘জেলা শহর ছেড়ে উপজেলায় থাকতে তোমার ভালো লাগছে?’
‘কী করব স্যার! মামারা যে আমাকে ওখানে রাখবেই না। নানিরও সেটাই ইচ্ছে।’
‘তোমার ইচ্ছে কী?’
‘আম্মুর সাথে আমার কোন সমস্যা নেই।’
‘তাহলে?’
‘মামারাই প্রবলেম করতে বেশি। ওরা বলছে, তোর মা মারা গেছে। তোর বাবার সাথে আর আমাদের সম্পর্ক নেই।’
‘কেন? এমন করে কেন বলে?’
‘মামারা কেন জানি আব্বুকে দেখতে পারে না।’
‘তোমার আব্বু কি কিছুই বলে না?’
‘বোঝেন না স্যার, নানি হলো আব্বুর শাশুড়ি। আব্বু কখনো নানির কথার উপর কথা বলবে না।’
‘তোমরা যে নানি বাড়িতে থাকবে- খরচ কে দেবে?’
‘আব্বু তো দিতেই চায়। কিন্তু মামাদের খুব ইগো। তারা কিছুতেই খরচ নেবে না।’
‘তোমার আম্মু এসেছিলেন একদিন তোমাকে খুঁজতে।’
আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গিয়েছিল বন্যা।
কিছুদিন পরে বন্যা একবার দেখা করতে এসেছিল। সামনেই তার এইচএসসি পরীক্ষা। দোয়া চাইতে এসেছিল।
জানতে চেয়েছিলাম, ‘পরীক্ষা কোথা থেকে দেবে?’
‘কোনো একটা বাসা ভাড়া নিয়ে দেবে মামারা। ওখানেই উঠব।’
‘নিজের আব্বার বাসা থাকতে, অন্য জায়গায় উঠবে কেন?’
‘ওই যে বলেছিলাম আপনাকে, মামাদের আব্বার উপর খুব রাগ। উনাদের কথা হচ্ছে, তোমার আব্বা আবার বিয়ে করেছে, তার সাথে আমাদের সম্পর্ক শেষ।’
দীর্ঘশ্বাস চেপেছিলাম। বন্যার ঘটনাটা হয়তো বড় কিছু ছিল না। কিন্তু কেমন কেমন করে যেন আমি বন্যার জীবনের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
এইচএসসির রেজাল্টের পর বাসায় এসেছিল বন্যা। হাতে মিষ্টির প্যাকেট।
‘স্যার, এ প্লাস পেয়েছি।’
‘দারুণ! তোমার আব্বু আম্মুকে জানিয়েছ?’
বিষণ্নতা ভর করেছিল মেয়েটির মুখে।
‘স্যার, আমি যাই। বাইরে ছোটমামা মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দোয়া করবেন স্যার।’
‘অবশ্যই।’
‘স্যার, একটা কথা বলবো। কিছু মনে করবেন না তো?’
‘বলো।’
‘স্যার, মামারা তো আব্বু-আম্মুর সাথে আমাকে কথা পর্যন্ত বলতে দেয় না। আপনি যদি উনাদের রেজাল্টটা একটু জানাতেন।’
‘মোবাইল ফোনে জানিয়ে দাও।’
আমার কথা শুনে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল বন্যা।
‘আমি চেষ্টা করব।’
‘আপনি কি আমাদের বাসা চেনেন?’
‘না। কোথায় থাকেন তোমার আব্বু-আম্মু?’
বন্যা ঠিকানা দিয়েছিল। তাই রেজাল্ট পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি একদিন এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছিলাম বন্যার আব্বু-আম্মুর সামনে।
‘স্যার, কেমন আছেন?’ বন্যার আম্মু বলেছিলেন।
ভেতরে বসতে বললেন তিনি। বন্যার বাবা টিভি দেখছিলেন। আমার পরিচয় পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন।
সেদিন অনেকক্ষণ ছিলাম তাদের সঙ্গে। বন্যার বাবা মেয়ের মেধা নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করেছিলেন। বন্যার আম্মু বেশ আপ্যায়ন করেছিলেন।
আমি সেদিন বন্যার আম্মুকে ভালো করে দেখেছিলাম। সাদাসিধে শাড়ি পরেছিলেন তিনি। কোনো বাহুল্য ছিল না।
‘বাসায় আর কেউ নেই?’ হঠাৎ প্রশ্ন করেছিলাম।
‘না ভাই। শুধু বুড়োবুড়ি বাড়ি পাহারা দিচ্ছি। এই আশায় আছি একদিন ঘরের ছেলেমেয়ে ঘরে ফিরে আসবে।’
আমি ভেবেছিলাম, পরিবারে বাচ্চা হয়তো এসেছে এতদিনে। হয়নি দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। সন্তান থাকতেও যে সংসারে থাকে না, তার মতো মরুভূমি বুঝি আর হয় না।
বন্যার আম্মু আমাকে বিদায় দিতে এসেছিলেন গেট পর্যন্ত। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘ভাই, নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হয়।’
‘কেন আপা?’
‘আমার জন্যই আজ ওরা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। মনে হয়, আমিই এরজন্য দায়ী।’
‘এভাবে ভাববেন না আপা। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কী আর ঠিক হবে। আমাদের দুজনেরই বয়স হয়েছে। এক পা কবরে দিয়ে রেখেছি। ছেলেমেয়ে সাথে থাকলে মানুষ দুটো ভালো-মন্দ রান্না করে খায়। আমাদের তো সেসব ইচ্ছে কবেই উবে গেছে।’
‘ওদের জন্য দোয়া করবেন আপা।’
‘সে তো সবসময়ই করি ভাই। যেখানেই থাকুক, ওরা ভালো থাকুক।’
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর কী মনে করে পেছনে ফিরে চেয়েছিলাম। আধো অন্ধকারে ঘোমটা মাথায় দিয়ে ছোটখাটো মহিলাটি তখনও দাঁড়িয়েছিলেন। মনে হয়েছিল, অনন্তকাল ধরে তিনি অপেক্ষা করছেন। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তার অপেক্ষার পালা একদিন শেষ করবেন।
অপেক্ষা আমিও করছিলাম। মনে মনে ভাবতাম, কবে সন্তানদের সাথে তাদের বাবা মায়ের পুনর্মিলন ঘটবে।
বন্যা মাঝে মাঝে কল করত। ভর্তি কোচিং করতে সে ঢাকায় ভর্তি হয়েছে। পরে ঢাকা ভার্সিটিতে পরিসংখ্যানে পড়ার সুযোগ হয়েছেÑ এসবই আমি বন্যার কাছ থেকেই শুনেছি। কখনো তার বাবা-মা সম্পর্কে আমি আগ বাড়িয়ে জানতে চাইনি। বন্যাও বলেনি।
তবে এর মাঝে দিনাজপুরে আসেনি সে। এলে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে দেখা করে যেত।
‘তোমার ছোটভাই কোথায়?’ একদিন জানতে চেয়েছিলাম।
‘ও তো স্যার দিনাজপুরেই আছে। আপনার কলেজেই ভর্তি হয়েছে।’
‘তাই নাকি! কই কখনো বলোনি তো। আমি কি চিনি?’
‘স্যার, ওকে চিনবেন কীভাবে? আপনি তো সায়েন্সের শিক্ষক আর ও ভর্তি হয়েছে আর্টসে। খুব দুর্বল ছাত্র।’
‘আমার তো মনে হয় না। যদি তোমার আব্বুর কাছে থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই ওর রেজাল্ট আরও ভালো করত ও।’
‘কী জানি। হবে হয়তো। তবে ও আব্বু-আম্মুকে ততটা ফিল কখনো করেছে বলে মনে হয়নি। নানি ওকে খুব আদর করত।’
‘তোমার নানি বেঁচে আছেন এখনো?’
‘না স্যার। গতবছর মারা গেছেন।’
‘মামারা তোমাদের খরচ ঠিকমতো দেন তো?’
‘সেই অসুবিধা নেই স্যার। মামারা বেশ বড়লোক তো।’
‘তোমার ভাই দিনাজপুরে থাকে কোথায়?’
‘মেসে থাকে।’
‘তোমার আব্বু-আম্মুর কাছেই তো থাকতে পারে।’
‘রাসেলের আব্বুর প্রতি তেমন টান নেই স্যার। বলে কোনো লাভ নেই।’
দীর্ঘশ্বাস চেপেছিলাম। এই নগরীর এক নিভৃত কোণে বয়স্ক পিতামাতা সন্তান থাকতেও একাকী জীবনযাপন করছে, ভাবতেই নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হলো। পুত্রসন্তান একই শহরে মেসে কষ্ট করে খায় অথচ আপন না হলেও সৎমা তার জন্য কতকিছু বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন।
মাঝে মাঝে ভাবি, ঈশ্বর কোথায় থাকেন। কার কথা শোনেন? অপেক্ষায় থাকি এই আশায়; নিশ্চয়ই বন্যা একদিন লেখাপড়া শেষ করবে, চাকরি করবে, তারপর নিজের কাছে বুড়ো বাবা-মাকে নিয়ে রাখবে। এমন একটা খবর শোনার প্রত্যাশায় থাকে মন। জানি না কবে সেটা ঘটবে। কিন্তু আমার মন বলছিল, ঠিক এমনটাই ঘটবে। কিন্তু আমরা ভাবি এক ঈশ্বর ভাবেন আরেক। হঠাৎ করেই গোটা বিশ্বটা যেন পাল্টে গেল। দেশে করোনার লকডাউন শুরু হলো। আগে মানুষ কথায় কথায় বিদেশ যেত। সেটা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরবন্দি হতে হলো। আগে রেস্টুরেন্টে বসে গ্রিল-নান খেত। এখন বাসায় তৈরি খাবার খায়। আগে মানুষ জন্মদিনের পার্টি, বিয়ে, চাকরি, বছর পূর্তি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকত। এখন বাসার ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়।
কলেজ বন্ধ।
ছাত্র পড়ানো বন্ধ।
বাইরে ঘোরাঘুরি বন্ধ।
টিভিতে খবর দেখতে বোর হয়ে একদিন ভাবলাম, মোবাইল ফোনে পরিচিত সবার একটু খোঁজখবর নিই।
খুঁজে খুঁজে মামা, চাচা, খালা, ভাগ্নে-ভাগ্নি, বান্ধবীসহ সবার খোঁজ নিলাম একে একে। আর কাকে কল করা যায়। ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল বন্যার কথা। ওর খোঁজ নেওয়া দরকার মনে করলাম। বন্যার নম্বর খুঁজতে শুরু করলাম। কী আশ্চর্য! তখনই রিংটোন বেজে উঠল।
বন্যা!
টেলিপ্যাথি!
‘আরে বন্যা! বললে বিশ্বাস করবে না, আমি তোমাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। ক্যামন আছ তুমি?’
আমার কথা শুনে কেঁদে উঠল মেয়েটি।
‘কী হয়েছে বন্যা? তুমি ভালো আছ তো?’
‘আমি ভালো আছি স্যার। খুব ভালো আছি।’
‘কোথায় আছ- ঢাকায় না মামার বাড়ি?’
‘না স্যার। আমি দিনাজপুরেই আছি। আব্বু-আম্মুর কাছে।’
‘স্ট্রেঞ্জ! তুমি ওখানে? আব্বু-আম্মু অসুস্থ নাকি?’
‘না স্যার। আমরা নেই বলেই তো উনারা অসুস্থ ছিলেন। এখন আমরা সাথে আছি, তাই সুস্থই আছেন ওরা।’
‘তুমি হঠাৎ এ বাসায় উঠলে যে?’
‘করোনা শুরুর পর রাসেল আমাকে ঢাকা থেকে আনতে গিয়েছিল। আসার সময় বগুড়াতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। বুঝতে পারিÑ আমি আক্রান্ত হয়েছি। বগুড়াতেই কোচ আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। মামাদের ফোন করলাম। তারা আমাদের বাসায় ঢুকতে দেবেন না। শেষে আব্বুকে কল দিলাম। আব্বু-আম্মু তখন গাড়ি নিয়ে আমাদের দুজনকে বগুড়া থেকে দিনাজপুরে নিয়ে এসেছেন।’
‘খুব ভালো। এখন ক্যামন আছ?’
‘ভালো আছি স্যার। আম্মু দিনরাত সেবা করে আমাকে সুস্থ করে তুলেছেন প্রায়। নিজে আক্রান্ত হওয়ার কথা চিন্তাও করেননি।’
‘তোমার আব্বু, আম্মু আর ভাইÑ তারা আক্রান্ত হয়নি?’
‘ওদের মৃদু উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। সেরে গেছে।’
‘খুব ভালো খবর।’
‘জি, স্যার। তার চেয়ে একটা ভালো খবর আছে স্যার।’
‘কী সেটা?’
‘এই যে আমরা ভাইবোন আমাদের আব্বু-আম্মুকে ফিরে পেয়েছি।’
আমি চুপ করে রইলাম।
‘স্যার, আম্মু কেমন ছিলেন সেটা আমি ভুলেই গিয়েছি। কিন্তু আমার সত্যিকারের আম্মু তো এমনই হতো, তাই না? নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে করোনা রোগী মেয়ের জন্য দিনরাত সেবা করা- এটা তো একজন সত্যিকারের মা-ই করতে পারে। আমরা বলি সৎমা মানে খারাপ। কিন্তু আমি বলছি স্যার, সৎমা মানে ভালো মা। এমন মা যার সংজ্ঞা কোন অভিধানে নেই।’
হু হু করে কেঁদে ফেলল বন্যা।
বিশ্বজিৎ দাস : কলেজ শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক