ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিশেষ ঈদ আয়োজন (১)

ভেলা

ইমরুল কায়েস
🕐 ১:২৩ অপরাহ্ণ, মে ০৯, ২০২১

ভেলা

দক্ষিণ দুয়ারি ঘরটার পিছনে সারি সারি নারিকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে ভরা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে...।
বাড়ির আঙিনার মাঝে, ঠিক একদম মধ্যখানে, বিশ বছরের বেশি বয়সী পুরনো শীতলপাটি বিছিয়ে বুড়ো সোলেমান শেখ শুয়ে আছে। তেল চিটচিটে বালিশে মাথা রেখে চিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সোলেমান শেখ নির্নিমেষ চোখে দেখছে- আকাশের নীলাভ সমুদ্রের সঙ্গে ভরা পূর্ণিমার আলোর মিল মিশিতে এক অদ্ভুত দুধসাদা রং তৈরি হয়েছে। আজকে তার সব কথা যেন রাতের আকাশের শুভ্রতার সঙ্গে...।

মাথার নিচে কভার ছাড়া বালিশ। তুলোর ঢাকনাটা বেশিই পুরনো হয়েছে। যেন, মাথার তেল আর ময়লা মিলেমিশে ভাগ করে নিয়ে পুরো বালিশে একটি তৈলচিত্রের ক্যানভাস আঁকছে। সোলেমান শেখের বুঝ বয়েস থেকে ভীষণ এক বাতিক- সে ছিল, মা ভক্ত কেউটে বাচ্চা। এখনো মায়ের হাতের জিনিস যত নোংরা আর পুরনো হোক তা তার কাছে পৃথিবীর সপ্তাচার্যের চেয়েও শতগুণ দামি। তাই, এই তেল চিটেবালিশ আর গায়ের নিচের শীতলপাটি শত শত ফুটো হওয়া সত্ত্বেও তার এই চাই...ই। বড় ছেলের বউ খোদেজা বিবি কতদিন বালিশটি বদলানোর কথা বলেছে, আজকেও তাই সে বলছে- ও আব্বাজান? ও আব্বা, জানেন! আপনার ছেলে খালি প্যাঁচাল পারে আর মোক কয়, ওই খোদে? আব্বার ময়লা বালিশটা বদলে দেইস না কেন রে? (মূলত এটা খোদেজারই মনের কথা। সরাসরি না বলে, তার স্বামী খবির শেখের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলে। কারণ ছেলের বউ হলেও কারও সাহসে কুলোবে না পঁচাত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ শ^শুরকে বোঝাতে। ছেলের কথায় সোলেমান শেখ কখনো রাগ করে না।)

খোদেজার কথায় বলে- ও বড় বউ, তোমাক মুই কত দিন কইম যে, এই বালিশে মাথা দিলে মোর মনে হয়, মুই মায়ের কোলত শুয়ে আছোম। তোমরা এইগলা বুঝবার নন বাহে।

তারপর থেকে শ্বশুর সোলেমান শেখকে আর কোনোদিন এই ময়লা বালিশ আর ছেঁড়া শীতলপাটি বদলানোর কথা বলেনি খোদেজা। তেলচিটে ময়লা বালিশে শুয়ে বুড়ো সোলেমান শেখ মাথা থেকে দু’কোনা চৌকো নৌকার আকৃতির মতো মাথার কুচকুচে কালো হওয়া টুপিটা খুলে ভাঁজে ভাঁজ মিলিয়ে বালিশের নিচে রেখে দেয়।
একটু পরে ডাকা শুরু করে- ওই ছহি বু... বুবু... লো।
-ছহি বুবু মোর কই গেলু? কই রো...?
-এটে কোনা একনা আয় তো বুবু...।

একটু পরে মা খোদেজার কাছ থেকে বাইরে ছুটে আসে ছহিতন। দাদার মাথার কাছ থেকে সরে পায়ের দিকে দাঁড়ায়। ময়লা বালিশের গন্ধে ছোট ছহিতনের বমি আসে, পেট ফুলে যায়। সে দাদা সোলেমান শেখের পা সোজা মুখ বরাবর দাঁড়ায়। সোলেমান শেখ আবার বলে- কী লো বুবু? এই খানত আয় তো মোর সামনোত।

-দাদাজান, তুমরা কী কইবেন ওই পাশত থাকি কন তো। মুই সামনোত যাবার নোম।
-তোর মায়ের কাছত থাকি একনা পান-গুয়া আর হামু দিস্তাটা আনতো। আনেক যা...। মোক খুউউব পানের নেশা নাগসে বইন।
ছহিতন বলে- ও দাদা, তোমার পাও খান তো পাটির ফুটা দিয়া মাটিত নাগছে, নাভ কি ওটাতে শুয়ে?
-তুই যা তো বুবু যা, আনেক আগে। দিগদারি করিস না তো এখন।

সোলেমান শেখ প্রতিদিন ঘাটপাড়ের মসজিদে এশার নামাজ পড়ে। তারপর বাড়ি আসে। আজকেও তাই করেছে। নামাজ পড়ে সোজা বাড়ি চলে আসে। সে জানে, আজ ভরা পূর্ণিমা। প্রত্যেক মাসের এই দিনটা সোলেমান শেখ গুনে গুনে হিসাব করে রাখে। এমন ভরা পূর্ণিমার রাতে আকাশে আলোর খেলা দেখতে খুউব ভালো লাগে। তাই সে আজকে তাড়াতাড়ি খোদেজার কাছ থেকে খাবার চেয়ে নেয়। খাবার খেয়ে মায়ের রেখে যাওয়া শীতলপাটি আর এই বালিশ নিয়ে খোলা আঙিনার মাঝে শুয়ে আকাশে চাঁদের আলোর খেলা দেখছে।

আসমানের বুক জুড়ে চাঁদের আলোর কী সুন্দর সামিয়ানা!

সে এই আলোতে চাঁদের বুড়িকে খোঁজে বৃদ্ধ। সারা জীবন এমনি করে কত রাত চাঁদ দেখতে দেখতে কাটল কিন্তু বুড়ির তো দেখা মিলল না। এই এক আফসোস বুড়ো সোলেমান শেখের। সে দম ফেলে আর নিঃশ্বাস নেয়... আহ!

সোলেমান শেখের দুই ছেলে খবির শেখ ও গলু শেখ। খবির শেখ বেশ বুঝদার ও গলু শেখের চেয়ে দুই বছরের বড়। গলু শেখ, তার কোনো বোধ বুদ্ধি নাই। সে সংসার কী জিনিস বোঝে না। খায় দায়, কাজ করে আর ঘুমায়। সোলেমান শেখ তাই গলু শেখকে বিয়ে-শাদি করায়নি। সোলেমান শেখের সাহসে কুলোয়নি। শুয়ে শুয়ে আজ আকাশপানে চেয়ে চেয়ে নানান ভাবনা ভাবছে...।

চর কুকড়িতে আসার কত দিন হয়ে গেল...।

এই চরে বাড়ি করার জন্য কত কষ্ট তাকে করতে হয়েছে। আবার মনে হয়, এই তো সেদিন, এই তো সেদিনকার ঘটনা। বউ খাইরুন, বৃদ্ধ মা আর সঙ্গে ছোট বোনকে নিয়ে তিলে তিলে সংসার গোছানো। একা পুরুষ মানুষ, খেটে খেটে নিজের পিঠের সোজা হার বাঁকা হয়ে গেছে। এই নির্জন চরে এসে আর দুই চার পরিবারের সঙ্গে মিলে এখানে বসতি গড়ে সংসার পাতছে। এই চর আর সেই দিনের চর কত তফাত...।

সোলেমান শেখের সেই দিনগুলোর কথা আজ বারবার মনে আসতেছে। বউ খাইরুন বেওয়ার কথা মনে পড়ছে...। বউটা কেমন আষ্টেপৃষ্টে তার সঙ্গে সংসার করছে। পয়লা ছাওয়াল বিয়ানোর এক দুই দিন আগে তার কি যে আকুতি ছিল। বউয়ের সেই দিনের ভয় আর চিন্তাযুক্ত মুখ চোখের সামনে ভাসছে...।

একদিন বিকেলে ঘরের দাওয়ায় বসে বাঁশের চাচারি তুলছে সোলেমান শেখ। খাইরুন বেওয়া স্বামীকে কাছে ডেকে নিয়ে বলে- ক্যে গো? মুই মরলে, তোমরা কি আর একটা নিকা করবেন?

সোলেমান শেখ অবাক হয়। ভাবে, কী বলি এখন? সে চুপ করে থাকে।

খাইরুন বেওয়া আবার বলে, কী হইল! কথা কন না ক্যে? মোর ছইলকে সত মায়ের ভাত খাওয়াবার দিবার নোম মুই; তোমরা মোক যাই কন এলা, মোক তোমরা এলায় কথা দেও।

বলতে বলতে খাইরুন বেওয়া হঠাৎ করে সোলেমানের ডান হাত টেনে ধরে কবজির নিচে তালুর নরম জায়গাতে জোরে কামড় বসিয়ে দেয়। আর একটু হলে রক্ত বেরিয়ে আসত। কামড়ে চামড়ার নিচে কালচে দাগ হয়।

সোলেমান শেখ চিৎকার করে- এই হে, এই কি করিস তুই? মনু গো মা...।
-এই যে, ব্যথা দিনু আইজ, মনত পরবে তুমার কাইল। নিকা করার কথা মনত পড়লে মোর কামড়ের ব্যথা ভাসবে।

বুড়ো সোলেমান শেখ মনে মনে ব্যথা অনুভব করে। ডান হাতটি তুলে পূর্ণিমার আলোয় মেলে ধরে আর মনে মনে বলে, খাইরুন, ও বউ! দেখে যা আইসেক, তোর সেই ছাওয়ালের মেয়েকে আর কয়দিন পর মুই বিয়া দেইম। তোর নাতির দামান আসবে... তুই আইজকা বাঁচি থাকলে খুব খুশি হতু রে বউ। নিজের মনের এই কথায় নিমিষেই তার চোখ বুজে আসে।

সোলেমান শেখ গভীর ঘোরে মনে মনে ভাবে, এখন বউ খাইরুন তার পাশে বসেই আছে। খাইরুন মনত পড়ে তোর? এই তো সেদিন সত্তুর সালের বানের পানিতে চারদিক ডুবে থইথই। এক রাইতোতে তিস্তা আর ব্রহ্মপুত্রের পানির জোরোতে নদীর কূলের সব ঘর বাড়ি কেমন করে ডুবে গেইছে। নদীর পানির লম্বা লম্বা ঢেউয়ের জিবা তীরের গাছ-গাছাড়ি, বন জঙ্গল, বাড়ির আঙিনা, সব একে একে গিলে খাইল...।

কী যে বিপদের দিন গেইছে! বউ তোর মনত পড়ে না? সেই বানের পানির শব্দ। হামার বাড়ির পাশত ঘরের সঙ্গে যার ঘর-রমিজ মাঝির এক ঘরের ছইয়ের পানি হামার ঘরের ছইয়ে পড়ত। সেই পাড়া প্রতিবেশীগুলা মোর কে কোন দিক চলে গেল, কে কোথায় ঠাঁই নিবে। বাল্যবন্ধু আমজাদ শেখ, রহিম, কদু মোল্লা, মুন্সী, সোহরাব ব্যাপারী, তেলী, গণেশ নাপিত এইগলা সবাই মিলে কি সুখ-দুখের বসত করছিনু।

বউ, তোর কি মনত আছে? বানের তিন দিন আগে হামার ছকিনার বিয়ে ঠিক করে আনু। সেই চেঙড়ামারির চরে। পরের দিন বিয়ার বর আসবে। বাড়ির সামোনের সড়কে সবাই মিলে বড় বড় চাইরটা কলা গাছ কাটিয়া গেট বানানু। মুই কলা গাছ চাইরটা কত সাবধানে কাটি আননু। কলা গাছের গোড়ার দিকের পুরানা ঢোংলা কাটি ফালানু। কত, কত সোন্দর থাক থাক করি কাটি সব চায়া লম্বা বড় পাতাটি রাখি দিনু। অইন্য পাতা গুলাক একটু ছোট ছোট করে কাটি দিনু। চাইরটা কলা গাছ রাস্তার দু পাশে হাত দুই গর্ত করে মাটি দিয়ে পুতে লম্বা পাতা চাইরটা একটা আর একটার সঙ্গে গেরো দিয়ে রাখনু। দুইটা বাঁশের কাবারি দিয়ে গরুর গাড়ির নাইয়ুরির আনা-নেওয়ার সমোয় যে বাঁশের টপ থাকে তার মতো করে টেনে গেট টানা হইল। কলাগাছ চাইরট্যার গায়ে সইস্যার তেল মাখিয়ে কত সুন্দর পিছলা ও তেলতেলে করে তার সঙ্গে পাটের দড়ি পাকেয়া লাল, নীল, কাগজ নকশা করি কাটি ময়দার আটা বালতির মধ্যে নিয়ে ছোট ছোট বেটা ছইল ও মাইয়াগুলা নাগাইল। কত সোন্দর গেট হইল। মোক কাছত ডাকি তুই কইলু- হামার ছকিনার কপালোত সুখ আছে গো...।

আহা রে বউ! মোর বইন ছকিনার আর বিয়ে হইল না। সকালে উঠি দেখম, গোটা রাস্তা নদীর বানের পানির তলে ভাংগি গেইছে। আর গেটের কলাগাছ চাইরটা একটার সঙ্গে আর একটা বাঁধা- যেন চাইর ভাইবোন কোলাকুলি করি বানের পানিতে ভাসতে ভাসতে হামার ঘরের দরজায় আসি আটকি গেইছে।

আর, আর এক দু’ঘণ্টার মধ্যে হামার ঘরসুদ্ধা এই বাড়ি ভিটা বানের পানির নিচে তলি যাইবে...। তোর কি চিল্লাচিল্লি আল্লাহ। তুই প্রথম পোয়াতি। মোর বুড়া মা আর বিয়ে ভাংগা বোন ছকিনা। মুই তাড়াতাড়ি আর দুইটা পানিতে উপরে পড়া কলা গাছ খুঁজে আননু। গেটের চাইরটা কলাগাছের সঙ্গে জোড়া দিয়া ভেলা বানা শুরু করনু...।

সোলেমানের বাড়ির দক্ষিণ পাশের বাঁশঝাড়ের উঁচু টিলার মতো জায়গাটি এখনো পানির নিচে যেতে দেরি আছে। সে তার পোয়াতি বউ, বৃদ্ধ মা, একটি গরু, ছাগল, ৫টি মুরগি, ১০টি হাঁস আর চাষের লাঙ্গল, জোয়াল, মই নিয়েছে। আলগা চুলাটি পুরনো তেলের টিনের মধ্যে বসিয়ে নিয়ে, হাঁস মুরগির পা গুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে টিলার উপরে রাখে।

ওই দিকে রহমত, গণেশ আরও অন্যরা যে যার মতো করে ছোট বড় ভেলা নিয়ে চেনা অচেনা কোনো চরের পানে চলে গেল...। কারও সঙ্গে, কারও দেখা করার সময়ও হুঁশ নেই। যে যার মতো যাচ্ছে... আর মনের ভাব এমন আগে বউ বাচ্চা নিয়া বাঁচি। বাঁচি থাকলে তো দেখা একদিন না একদিন হবে। সোলেমান শেখ দেখে... ওর বাড়ি থেকে দূরে গভীর পানির বুকে কয়েকটি কুকুর, বিড়াল, ছাগল ও ভেড়া যে যার মতো মাথা পানিতে ডোবাচ্ছে আবার মাথা বাঁকা করে ঝেড়ে তুলে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার প্রাণপণে সাঁতরে যাচ্ছে...। কুকুর কয়েকটা মুখ আর নাক ভাসিয়ে একটু করে যাচ্ছে আবার পানির ঢেউয়ে ধাক্কা খেয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। গরু ভেসে যাচ্ছে, বসতবাড়ির খড়কুটো, পুরনো নতুন কাপড়-চোপড়, পুরনো খড়ি, জমানো পাটখড়ি কত কী যে ভাসছে আর ভাসছে...। চারদিকে পানির হুড়–ম গুড়–ম শব্দ। স্রোতের ভয়ানক আওয়াজ। সবার সব শেষ! বিকেল ঘনিয়ে আকাশ কাক কালো অন্ধকার করে আসছে।

সোলেমান শেখ পরনের লুঙ্গিটাকে কাচমেরে নেয়। কাঁধের গামছাটা কোমড়ে শক্ত করে বাঁধে। ছয়টি কলাগাছ, একটির গোড়া আর একটির মাথা এমন করে পাশাপাশি সাজায়। আর ভাবে, এই ভেলা তার মজবুত করে বানাতে হবে। সঙ্গে পোয়াতি বউ আর বৃদ্ধ মা তার। আহারে... তার অনাগত সন্তান। সে কলা গাছ ছয়টি সাজিয়ে বাঁশের শক্ত বড় গিট ধরে ধরে পাঁচ থেকে সাত হাত করে কেটে নেয়। যেন প্রত্যেকটি বাঁশের খুটির মাথায় গিট থাকে। সে আর তার বোন ছকিনা- যার বিয়ের গেটের এই কলা গাছগুলো দিয়ে ভেলা! ছকিনা হাত দিয়ে বাঁশের ধারালো মাথাটি কলা গাছের পেটে ঠেসে ধরে থাকে। সোলেমান শেখ গিটওয়ালা মাথায় মোটা বাঁশের অর্ধেকের ছোট গোড়ালি দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ছয়টি বাঁশের খুটি কলা গাছের পেটের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। দড়ি দিয়ে একটা কলা গাছের সঙ্গে বেণি পাকানোর মতো করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সে এক মাথা থেকে অন্য মাথায় বাঁধে। বাঁধা শেষে, পানির ওপর ভেসে থাকা ঘরের বিছানার নিচের কয়েকটি চাটাই ভেলার ওপরে বিছিয়ে দেয়। যাতে নিচ থেকে পানি আর ওপরে না আসে। বাড়ির দুটি চৌকি ভেলার ওপরে তুলে ভেলার নিচ দিয়ে আর ওপর দিয়ে দুটি করে বাঁশ দেয়। এই বাঁশের সঙ্গে চৌকির আটটি পায়া শক্ত করে বাঁধে যাতে নড়ে চড়ে পানিতে না পড়ে।

বাঁশঝাড়ের ঢিবির ওপর রাখা অনেকগুলো আউশের শুকনো খড় ভালো করে ভেলার মধ্যে নেয়। গরু আর ছাগলটিকে কোলে করে নিয়ে আসে। এই খড়ের মধ্যে বসিয়ে রাখে। দুটি হারিকেন নেয়। কেরোসিনের কাচের শিশির মুখে ভালো করে পলিথিন দিয়ে মুখ আটকে নেয়। খাইরুন বিবি নিজে নড়তে না পারলেও কিছু হাঁড়ি পাতিল, পলিথিনের বস্তার মধ্যে চারটি বালিশ, কাঁথা আর বিছানার জিনিসপত্র ভালো করে গুছিয়ে নিয়েছে। তার নিজ হাতে সেলাই করা ছোট নকশিকাঁথা আর একটা আলাদা ছোট পলিথিনের ব্যাগে খুব যত্ন করে গুছিয়ে নিয়েছে। পেটের আগত সন্তানের জন্য। ছোট বাচ্চার জন্য অনেক ন্যাকড়া ও কাঁথার দরকার হয়। নতুন কোথায়, না কোন জায়গায় যাবে, কই পাবে তখন! কত দিন ধরে এই কাঁথাগুলো সে বুনেছে। সব সঙ্গে নিয়ে খাইরুন বেওয়া ভেলায় ওঠে। তার ছাওয়াল ব্যবহার করবে! এই কথা ভাবতেই এরকম বিপদের দিনেও সোলেমান বউয়ের চোখে মুখে একধরনের ভালোলাগার আভা দেখতে পায়।

সবাইকে ভেলায় তুলে দিয়ে সোলেমান শেখ একটু দৌড়ে তার বাড়ির পেছনের সবচেয়ে উঁচু ঢিবিটার কাছে যায়। পাশেই তার আব্বার কবরের একটু মাটি দেখা যায়। সে ওই মাটিতে সালাম করে কোমড় থেকে লুঙ্গির কোচ খুলে দিয়ে ভেজা লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপরে দিয়ে পাশের বানের পানিতে হাত দুটি ধুয়ে নিয়ে মোনাজাত করে। আর মোনাজাত শেষে একটু মাটি গামছার মাথায় বেঁধে নেয়।

ভেলা ছাড়লে সবার চোখে মুখে কি যেন ছেড়ে আসার এক অমোঘ দুঃখের ছাপ। কত সহস্র স্মৃতি আর মায়া। ক্রমে ভেলা সোলেমান শেখের লগির ধাক্কায় এগিয়ে যাচ্ছে আর পেছনে সাদা জলের উচ্ছল ছপাত ছপাত ঢেউ খেলা করে। কেউ কারও মুখের দিকে, চোখের দিকে তাকায় না। সবাই সবার সীমাহীন দুঃখ অনুভব করছে...। আর মনে মনে সবাই সবাইকে শক্ত সান্ত¡না দিচ্ছে... সকল অভাবি পরিবারগুলোর এ এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

ছকিনা ভাবছে, এই কলা গাছের সুন্দর গেট দিয়ে বের হয়ে সে নতুন জীবনে ভিড়ত। বিয়ের গেট, যে দুঃখ যাত্রার এমন শেষ সম্বল হবে তা সে কাকে বলবে এখন। এদিকে বৃদ্ধ সোলেমানের মা ক্ষয়ে যাওয়া চোখের ঝাপসা এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া স্বামীর ভিটের লম্বা তাল গাছের মাথায় একটি বাবুই পাখির বাসা, বাতাসে ঢুল খাচ্ছে... বাবুইটা মাথা বের করে মনে হয় তার জোড় বাবুইকে খুঁজছে। পুরনো আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে আর ভাবে, সামনে যতই ভালো ভিটে পাই স্বামীর কবরটা তো আর... পাব না। এ দিকে খাইরুন বেওয়া কাপড়ের নিচে হাত দিয়ে উঁচু পেটটা বারবার ছোঁয়। আর ভাবে, আমার সাধনার মানিক পয়লা ছইল না জানি কোন খোলা আকাশের নিচে হইবে। আবার কবে ঘর হবে? কী খাবে? কেমনে তার শেখ সংসার চালাবে! শত ভাবনার এক ভেলা সে মনে মনে বাইছে, তার না আছে কোনো জলের তলা না আছে লগি-বৈঠা।

সোলেমান শেখ ঘোরের মধ্যে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, এইকটা ভেলায় টানা তিনদিন তারপরে এই কুকড়ির চরে আসা বউ। এই নির্জন বালুর চরে আর গোটা দুই বানভাসি পরিবারের সাথোত ঘরবাড়ি করা শুরু করি দিনু। কয়দিন পরেই তোর বড় ছইল খবির আইল।

নাতনি ছহিতন হামান-দিস্তা পাটির পাশে রাখে। সোলেমান শেখের পা ধরে ঝাঁকায় আর ডাকে- ও দাদা, দাদা গো...। দাদাজান, কী কন ওগলা একা বিরবির করে? দাদা।

ওহু... বলে নড়ে ওঠে সোলেমান শেখ। দু’চোখের কোনায় জল গড়িয়ে নিচের ময়লা বালিশ ভেজে আর ভেজে...। ঘোরের মধ্যে সোলেমান শেখ জোরে বলে ওঠে- ও বউ! ছার মোক ছার; দেখ তো কামড়ে কেমনে দাঁত বসাইলু...।

ইমরুল কায়েস : কথাসাহিত্যিক

 
Electronic Paper