ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কবিতায় পরিত্রাণ প্রত্যাশা

শফিক হাসান
🕐 ১২:১৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০২১

কবিতায় পরিত্রাণ প্রত্যাশা

প্রতি বছর বইমেলায় প্রকাশের শীর্ষে থাকে কবিতার বই। এসব বই শেষপর্যন্ত কতটুকু আবেদন সৃষ্টি করতে পারে, কয়টি টিকে থাকে সেলফে বা কতটি পঙ্ক্তি উচ্চারিত হয় ঠোঁট থেকে ঠোঁটে সেটাও বড় প্রশ্ন। তবে স্বীকৃতি কিংবা গ্রহণযোগ্যতার তোয়াক্কা না করে গোঁয়ারের মতো চলেছেন একশ্রেণির সৃজনপ্রত্যয়ী মানুষ।

অবশ্য শিল্পী হতে চাইলে ক্ষ্যাপাই হতে হয়, নইলে সিদ্ধি মিলবে কেন! করোনাক্রান্ত এবারের বইমেলায় স্বাভাবিকভাবেই বই প্রকাশিত হয়েছে তুলনামূলক কম। এই কম সংখ্যারই একটি মুহাম্মদ ফারুক আহমদের ‘মুক্তির দূত আলোর দিশারী’ কাব্যগ্রন্থ। বইটি হাতে নিলে পাঠককে হোঁচট খেতে হবে কয়েক দফায়। প্রচ্ছদে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিনন্দন ছবি। নামের সঙ্গে ছবির ভাবার্থ মিলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বল উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন নানাভাবেই। হয়ে উঠছেন মুক্তির দূত; মুক্তির দূত বলেই আলোর দিশারী! নাম দেখে মনে হতে পারে, এটি আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর আলোকপাতধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ। এটুকু প্রাথমিকভাবে ভেবে নিলে পাঠককে ‘ঠকতে’ হতে হবে। বইটিতে স্থান পেয়েছে ৩৮টি কবিতা। এর মধ্যে নাম-কবিতাটি পাঁচ পৃষ্ঠার। বাকিগুলো বিভিন্ন বিষয়ে রচিত। প্রেম ও অপ্রেমের, যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ স্থান পেয়েছে কবিতাগুলোতে। বইয়ের নামকরণ থেকে প্রচ্ছদ পরিকল্পনা কি সংশ্লিষ্টদের দুর্বলতাই প্রকাশ করে না!

চার ফর্মার বইটিতে বাণী-মূল্যায়ন রাখা হয়েছে তিনটা। প্রথম ফ্ল্যাপ, প্রচ্ছদের শেষ পৃষ্ঠা ও ভিতরে মানিক দে’র ভূমিকাংশ- এসব একটু বেশি বেশিই মনে হয়েছে! উৎসর্গ করা হয়েছে কবির বাবা-মাকে। একজন দক্ষ প্রুফ রিডারকে দিয়ে পাণ্ডুলিপিটা দেখিয়ে নিলে কমানো যেত বানান ভুলের আধিক্য।

‘মুক্তির দূত আলোর দিশারী’ কবিতায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্রাজেডি থেকে শুরু করে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, অতঃপর উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে বাংলাদেশের পদচ্ছাপ দেখিয়েছেন কবি। শেখ হাসিনার অবদানের কথা উল্লেখ করে শেষ পরিচ্ছদে বলেন-

এই বাংলার মাটি, বাংলার জল, ফুল ও পাখিরা/ ভালোবেসে তব/ তোমার আলোয়, তোমাতে হয়েছে লীন/ দেশের মানুষ বুকের ভিতর আগলে রেখে পূজিবে তোমায়/ হে মহান নেত্রী, শুধিবে তোমার পিতার/ রক্তের ঋণ...।

প্রথম কবিতায় স্মরণ করেছেন প্রয়াত মাকে। কবির মায়ের শূন্যতার বেদনা-হাহাকার সঞ্চারিত হবে পাঠকের মনেও। রয়েছে মারণব্যাধি করোনাভাইরাস নিয়ে একাধিক কবিতা। ‘মানবতার সেবায়’ কবিতায় অশ্রু-নৈবেদ্যে সিক্ত করেছেন ডা. মঈনকে। যিনি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন, চলে গেছেন করোনার ছোবলে। পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চে মানুষ যে দুই দিনের অতিথি কবিতার ছত্রে ছত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই দেখা-অদেখা দৃশ্য। বক্তব্য প্রকাশে অনাড়ম্বর কিন্তু দীপ্তস্বর এই কবির বড় সম্পদ। অল্প কয়েকটি শব্দে সহজেই ভাবনার প্রসারণ ঘটাতে পারেন দারুণ মুন্সিয়ানায়। ‘ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ’ কবিতায়ও লক্ষ করা যায় প্রাঞ্জল শক্তিমত্তার প্রকাশ-

ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছ কেন বুকে তোমার/ অস্পষ্ট ক্যান্সারের মতো,/ প্রকাশ করো ভালোবাসা তোমার/ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো...।

দুরন্ত প্রেমিক বলেই কবির অকপটে বলে জানিয়ে দিতে পারেন ভালোবাসার প্রকাশ ও হৃদয়ের আর্তি। ফেলে আসা দিন, কিশোরী প্রেমিকার প্রতিও মোহমুগ্ধতা সজীব এখনো। চৈত্রের নিদাঘ দুপুর কিংবা বর্ষার জলজ মেঘে এসব সম্পর্ক গভীরতা পায়। আলোড়ন তোলে চৈতন্যে। জীবন থেকে আদতে কিছুই হারায় না, ফিরে আসে কোনো এক সময়ে। সময়ের ফেরে চাপা পড়লেও দমকা ঝড়ে অনুন্মোচিত থাকে না সেসব। প্রেম, ভালোলাগা, ভালোবাসার ফাল্গুধারা সতত বয়ে চলে মানুষের হৃদ-অন্দরে। বক্ষমান কবিতাগুলোতে যেমন স্থান পেয়েছে ব্যক্তিক অনুভূতি প্রেম ক্রোধ রিরংসা অপ্রাপ্তি- তেমনি বারংবার ধ্বনিত হয়েছে ’৫২ থেকে ’৭১-এর বীরত্ব ও বিষাদগাথা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ও তাদের পরিবারের নানা চিত্রেও আঁচড় কেটেছেন কবি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছবি ফুটে উঠেছে ‘অর্বাচীন’ কবিতায়-
’৭১-এ স্বাধীন ভূমি পেয়েছি ঠিকই/ ভূমির আগাছা পরিষ্কার হয়নি এখনো/ যে স্বাধীনতা পেয়ে নিজের স্বপ্নকে অঙ্কুরোদগম করেছিলাম/ যেখানে মা বোন রাতের আঁধারে নিরাপদে হেঁটে বেড়াবে/ আর হবে না খুন ছিনতাই রাহাজানি গুম হত্যা।

স্বাধীন একটি ভূখণ্ড আমরা পেয়েছি ঠিকই কিন্তু মানুষের স্বাধীনতা কতটুকু অর্জিত হয়েছে? একশ্রেণির দানব, যাদের কবি পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা হিসেবে অভিহিত করেছেন- লুটেপুটে নিচ্ছে নিরন্নের সহায়-সম্বল। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জিত হয়নি সব মানুষের। স্বাধীনতার সুফল কুক্ষিগত করেছে একশ্রেণির মানুষ। ‘সুষম বণ্টন’ হয়নি বলে এখনো কান পাতলে শোনা যায় নীরব-সরব আহাজারি। স্বদেশের অগ্রগতি ও পিছুযাত্রা যুগপৎ আনন্দিত ও ব্যথিত করেছে কবিকে। সে চিত্র- নিজের অনুভূতি আনন্দ-বেদনার নির্যাস ছড়িয়ে দিয়েছেন পাঠকের মাঝে। কবির প্রেম ও ক্রোধ তাই লহমায় ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে।

ফারুক আহমদ শুধু কবি নন, একজন কথাশিল্পীও। ইতোপূর্বে ‘দুরন্ত ট্রেন’ নামে উপন্যাস ও ‘ফাগুনের ঝরা রাতে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কথাসাহিত্যে গল্প বলার যে ধরন, সেই ধারাই প্রতিফলিত হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থেও। যে কারণে প্রতিটি কবিতার মাঝেই সন্ধান পাওয়া গিয়েছে এক বা একাধিক গল্পের স্বাদ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের যে বর্ণনা দিয়েছেন কবি, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা যায় এমন অধ্যায় কমই রয়েছে। তিনি স্বপ্ন দেখেন সমৃদ্ধ স্বদেশ ও বৈভবঋদ্ধ সমকালের- একই ভাবনা তো পাঠকেরও। নাগরিকের, সবার। তাই কবিতার পঙ্ক্তিগুলো বারবার প্রমাণ করিয়ে দিয়েছে- প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও প্রণয়গাথাকে! কবিতার ছত্রে ছত্রে ফারুক আহমদ যে মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন, এই অভিব্যক্তি ও আকাক্সক্ষার বাইরে বোধকরি এই ব-দ্বীপের কেউই নন!

মুক্তির দূত আলোর দিশারী : মুহাম্মদ ফারুক আহমদ। বইপত্র প্রকাশন।
প্রচ্ছদ : রিফাতুল ইসলাম। প্রকাশকাল : মার্চ, ২০২১। দাম : ১৫০ টাকা

শফিক হাসান : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

 
Electronic Paper