সহিংসতার নেপথ্যে কী
শেখ আনোয়ার
🕐 ১২:২৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০২১
ব্যক্তি-স্বার্থ, গোষ্ঠী-স্বার্থ এবং সামষ্টিক-স্বার্থে, পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধের বাইরে সাধারণের ওপর আঘাত হানার ঘৃণ্য কাজের নাম সহিংসতা। দেশ-বিদেশে ব্যক্তি-স্বার্থ, গোষ্ঠী-স্বার্থ এবং সামষ্টিক-স্বার্থে, পরিকল্পিতভাবে শক্তি প্রয়োগ ও সংঘাতের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমষ্টির ওপর আঘাত হেনে সাধারণ জনগণের মনে ভীতির আবহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব কাজের জন্য প্রকাশ্য ও গোপনে লাদেন বা জঙ্গি সংগঠন আইসিসের আদলে গড়ে উঠেছে নানান ধর্মীয় নামে কিছু সহিংসতাকারী বর্বর জঙ্গি সংগঠন। তাদের সহিংসতার পিছনে থাকে ভয়াবহ আবেগ, ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা এবং অনেক ক্ষেত্রে সীমাহীন লোভ। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক সহিংস কর্মকাণ্ডের পিছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসহ ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত অসহিষ্ণুতার প্রভাব থাকে সুগভীরভাবে।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তেমনি একদল ধর্মীয় লেবাসধারী তথাকথিত নীতিবান তেজি মানুষ আবির্ভূত হয়েছে। এদের মুখে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছে অমৃতবাণীযুক্ত রাজনীতির কথা। মুখে বলে ইসলাম শান্তির ধর্ম। বাস্তবে তারা যেসব নীতিহীন কর্ম করে বেড়ায় তাতে শান্তির লেশমাত্র নেই। আজও তারা পাকিস্তানি সংস্কৃতির মতো ভিন্ন দর্শনে বিশ্বাসী। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও এরা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গায় না! এরা ভাব দেখায় তারা বেশ ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু। কারণটা হচ্ছে, এসব সাধারণ মানুষ ভীষণ খায়। অহরহ ধর্মের কথা বলা মানেই মানুষটা দয়ালু। দাঁত নেই, নখ নেই, হিংসা নেই। রয়েছে শুধু দয়া-মায়া আর ভালোবাসা। এরা ধর্মের নামে সাধারণ মানুষের ভিতর ঢুকে মধ্যযুগীয় অপবিজ্ঞানের চাষ করে চলেছে। হেফাজতে ইসলাম নামে উগ্রপন্থী সংগঠন ধর্মের নামে উগ্রতা ছড়াচ্ছে। এ সময়ে এরা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে, রাজনৈতিক দল না হয়েও ধর্মীয় সংগঠনের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক কর্মকা- চালাচ্ছে। ধর্মের নাম করে জঙ্গি কর্মকা-ের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই গোষ্ঠী কয়দিন আগে দেশব্যাপী উন্মাদনা ও তা-ব চালিয়েছে। ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতার মতো অপরাধের সঙ্গে এরা করে চলেছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। রেল স্টেশন, সরকারি নানান অফিস, থানা অগ্নিদগ্ধ করে বল্গাহীন স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। এরা সমাবেশ করে নাসিরনগরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি পুড়িয়েছে ও লুটপাট করেছে। শাল্লায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিয়েছে। হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংস করেছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিসহ সব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও কীর্তিসমূহ তছনছ করে দিয়েছে। ধর্মের নিটোল ভানকারী মিথ্যাবাদী মানুষগুলো এখন রাষ্ট্রকে ধমকাতেও কসুর করে না। তারাও মানুষের পাশে থাকতে চায়। মানুষের কাজ করতে চায়। বারবার বিনা উসকানিতে দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা ঘটায়। সহিংসতা করে রাষ্ট্রের সঙ্গে ভয়ানক দাবা খেলায় মেতে ওঠে। এই উগ্রপন্থী গোষ্ঠী আঘাত হেনে সরকার ও জনগণের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে ফায়দা লাভের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।
এ তো গেল বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার উদাহরণ! সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, এমন সহিংসতা নতুন কিছু নয়। প্রাচীন যুগে শক্তিধর গোষ্ঠীসহ নানান দেশের নিষ্ঠুর উপজাতি তথা নৃপতিগণ ভয়াবহ নিষ্ঠুর হত্যাকা- ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে সহিংসতা সৃষ্টি করে বিশেষ জাতি ও গোষ্ঠীর মর্যাদা ও মনোবল ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করেছে। ভিন্নমত, সংস্কৃতি ও দর্শনে বিশ্বাসী তথা ভিন্ন জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠী উগ্র আঘাত হেনে সরকার ও জনগণের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে ফায়দা লাভের প্রচেষ্টা করছে। গবেষকরা বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কোনো ব্যক্তি এমন ধরনের আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হন, যা তাকে মধ্যপন্থী, মূলধারার চিন্তাধারা থেকে চরমপন্থী চিন্তার দিকে সরে যেতে সাহায্য করে। চলমান ভয়াবহ করোনা মহামারীকালেও বিশ্বজুড়ে এমন সহিংস ঘটনা অহরহ ঘটায় নীতিনির্ধারক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সহিংসতা দমনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তো বটেই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরাও আঞ্চলিক সহিংসতা বিষয়ে কম-বেশি সব সময়ই চিন্তাভাবনা করছেন। তারা সবাই এর একটা সন্তোষজনক উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করছেন। সহিংসতা দমন বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের মনেও নিত্যনতুন প্রশ্ন জেগেছে। ব্যক্তি বিশেষে, এলাকা বিশেষে, ধর্ম বিশেষে যে নানাবিধ সহিংসতা ঘটে এর পিছনে আসলে পরিবেশ ও সমাজ দায়ী নাকি নির্দিষ্ট কোনো বায়োলজিক্যাল জিন দায়ী? সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে সহিংসতার পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে দু’টো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রথমত, ব্যক্তিজীবনের কোনো সংকট বা ঘটনা যা অনুঘটক (বা ক্যাটালিস্ট) হিসেবে কাজ করে। এই সংকট বা ঘটনা যে ওই ব্যক্তির নিজের জীবনেই ঘটতে হবে তা কিন্তু নয়। তার পরিবারে, অন্যের জীবনে বা সমাজে সংঘটিত কোনো ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করাও অনুঘটকের কাজ করতে পারে। আপন সত্তার সঙ্গে নিজের এবং নিজের সঙ্গে পরিবারের ও সমাজের অমোচনীয় দ্বন্দ্বই সহিংসতার অন্যতম কারণ।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, জন্ম থেকে কোনো শিশু বর্বর হয়ে জন্মায় না। পরিবেশ ও সমাজের প্রভাবেই মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে পরিবেশের পক্ষে নৃ-বিজ্ঞানীরা কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এসলে মন্টেগু তাদের একজন। এই নৃ-বিজ্ঞানী বলেন, মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় একটি শিশুর লাখ লাখ কোষ যখন তৈরি হয়, তখন সেই কোষ শুধু শিশুর বৃদ্ধির গঠন প্রক্রিয়ার কাজ করে। একমাত্র জন্মানোর পরেই এ কোষগুলোকে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। এছাড়া বিবর্তনবাদী জন টবি যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা হচ্ছে, একটি শিশু জন্মানোর আগে তার মস্তিষ্কে এ ব্যাপার স্থির করা হয় না যে, জন্মের পরে শিশুটি কোন ভাষায় কথা বলবে। একমাত্র পরিবেশ ও সমাজই স্থির করে দেয় শিশুটি কোন ভাষায় কথা বলবে। সুতরাং এ থেকে আমরা বলতে পারি, ব্যক্তি বিশেষে বা গোষ্ঠী বিশেষে যে কোনো ব্যক্তির সহিংস হওয়ার পিছনে সেই ব্যক্তির বাড়িঘর, আশপাশের মানুষ বা সামাজিক পরিবেশ দায়ী। সহিংসতার কারণ গবেষণায় বিশ্বের সমাজবিজ্ঞানীগণ অনেক দূর এগিয়ে রয়েছেন। জানা যায়, একমাত্র ইকুয়েডরের আকুয়ার ইন্ডিয়ানদের মধ্যে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাত্রায় সহিংস ঘটনা ঘটে। কিন্তু কেন সহিংসতা বেশি হয় তা জানতে এখন দেখা যাক, ইকুয়েডরে কী ধরনের সামাজিক পরিবেশ থেকে এ ধরনের সহিংসতা হয়ে থাাকে।
শান্তা বারবারার কলোর্যাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞানী জন কিউ প্যাটন সহিংসতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে ইকুয়েডরের কনাম্বো গ্রামের আকুয়ার লোকদের সহিংস কর্মকা-ের অনেক তথ্য উদ্ধার করেছেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, সাধারণ মানুষকে যেমন বিপজ্জনক কোনো ঘটনা বা কোনো প্রাণীর আক্রমণ নিয়ে নার্ভাস হতে দেখা যায়, সে ধরনের কোনো নার্ভাস অনুভূতি আকুয়ার লোকদের মধ্যে নেই। তারা নার্ভাস শুধু তাদের নিজেদের নিয়ে। এক জরিপে জানা যায়, তাদের পুর্ব-পুরুষদের শতকরা ৬০ ভাগই মারা গেছে বোমা বিস্ফোরণে। বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যুই হচ্ছে তাদের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যু। বুড়ো হয়ে মৃত্যু কিংবা অসুখে মৃত্যুই তাদের কাছে অস্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু কেন সহিংসতা আকুয়ার লোকদের কাছে এত প্রিয়? নৃ-বিজ্ঞানী প্যাটন কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি উল্লেখ করে বলেন, প্রাচীন মানবসমাজে যুদ্ধ ও হত্যার বিবর্তন থেকেই আজকের সমাজে এসব সহিংসতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তা-ব কা- ঘটাতে দেখা যায়। কারণ আদি পূর্ব-পুরুষরা খাবারের সন্ধানের জন্য শিকার করে বেড়িয়েছে। আকুয়ার উপজাতীয় লোকদের মধ্যে সহিংসতার আরেকটি কারণ হলো প্রোটিন স্বল্পতা। এই উপজাতীয়রা পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হয় নতুন এলাকা দখল করার জন্য। কারণ তাদের নিজেদের এলাকায় যথেষ্ট খাবার নেই। এক তথ্যে জানা যায়, যেখানে একজন আকুয়ার লোকের দৈনিক ১০৪ গ্রাম প্রোটিন দরকার, সেখানে তারা পায় জনপ্রতি শুধু ৩০ গ্রাম। সুতরাং খাবারের জন্য সহিংসতা করা তাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার।
প্যাটন ও তার উপদেষ্টা নেপোলিয়ান চ্যাঞ্চন- ‘আনকাই’ নামের এক বিশেষ শ্রেণির হত্যাকারী আকুয়ার লোকদের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করেছেন। দেখা গেছে, বর্বরদের সাধারণের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ স্ত্রী ও তিন জনের অধিক ছেলেমেয়ে থাকে। আর হত্যাকারী ‘আনকাই’রা হয়ে থাকে সমাজের নেতা। সমাজের নেতা উপাধিটি তাদের দেওয়া হয়ে থাকে সাধারণত প্রথমে প্রজনন ক্ষমতার কারণে এবং তারপর সহিংসতায় জয়ী হওয়ার কারণে। অর্থাৎ আকুয়ার লোকদের সামাজিক মর্যাদা নির্ণয় করা হয় সহিংসতার দক্ষতা অনুসারে। যে যত ভালো বর্বর হতে পারবে সে তত বেশি উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা অর্জন করবে। নৃ-বিজ্ঞানী প্যাটন সহিংস-বর্বর মানুষদের ভাবমূর্তি পর্যবেক্ষণ করে জানান, একজন আকুয়ার লোকের ৭৮ ভাগ সামাজিক মর্যাদাই নির্ণয় করা হয় তাদের সহিংস কর্মকা-ের দক্ষতা দিয়ে। প্যাটন আকুয়ার লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, তাদের সমাজে একজন দক্ষ বর্বর সন্ত্রাসীকে সবচেয়ে বেশি সমীহ করা হয়। জ্ঞানী ভাবা হয়। একজন তা-ব সৃষ্টিকারী জানে কখন কার সঙ্গে সহিংস কাজে লিপ্ত হওয়া দরকার।
শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক