লকডাউন ভঙ্গকারীদের উৎসাহের উৎস কোথায়
শেখ আব্দুল্লাহ আল মুকিত
🕐 ১২:১৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০২১
২১ নভেম্বর, ১৯১৮।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। সানফ্রান্সিসকো শহরের কেন্দ্রে জমায়েত উত্তেজিত জনতা তাদের মাস্ক আকাশে ছুড়ে দিল। তূর্যধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। মাস্কের দিন শেষ। আনন্দে উদ্ভাসিত সবাই। মাস্ক আর নিয়মবিধি তাদের জীবন বিষিয়ে তুলেছে। সেপ্টেম্বর থেকে পুরো আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু। তখন থেকে এই ঘ্যান ঘ্যান- স্বাস্থ্যবিধি। দোকানপাট বন্ধ, ব্যবসা নেই। রুখে দাঁড়াল জনতা। বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সরকারের ‘নির্যাতনের’ বিরুদ্ধে স্লোগান দিল জনতা। গঠিত হলো এন্টি মাস্ক লীগ (অহঃর সধংশ ষবধমঁব)। তাদের চাপে অবশেষে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো মার্কিন সরকার। তুলে নিল শাটডাউন। নগর কর্তৃপক্ষ সেদিন হয়তো বুঝতেও পারেনি তাদের সমস্যা শুরু মাত্র। এই নভেম্বর পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ন্ত্রিত থাকলেও পরবর্তী এক বছরে সেখানে ৩০০০ মানুষ মারা যায়।
পরিচিত চিত্রই মনে হচ্ছে। ২১ নভেম্বর থেকে আমেরিকা শিক্ষা নেয়নি। আমরাও না। এদেশে বেশ কয়েকবার লকডাউন দেওয়া হয়েছে। ১৪ এপ্রিল থেকে ‘কঠোর লকডাউন’। তারপরও স্বাস্থ্যবিধির প্রতি মানুষের মৌলিক আচরণের কোনো পরিবর্তন আছে কি?
উত্তর : না বোধক।
এর কয়েকটি কারণ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি।
সবচেয়ে প্রথমে দায়ী করব আমাদের এক ধরনের সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্সকে। অর্থাৎ আমি বা আমার দেশ বাকিরা বা বাকি দেশের থেকে ভালো। তাই করোনা আমার কিছুই করতে পারবে না। এদেশে গ্রামের মানুষের মুখে শোনা যায় ‘করোনা থাকে ওই শহুরে ভদ্রপল্লিতে’। আর শহরের মানুষ বলে করোনা আমেরিকা ইউরোপের মতো পাপাচারী দেশের সমস্যা। আমাদের তেমন প্রভাব নাই।
অজ্ঞতা একটি বড় কারণ। কোয়ারান্টিন বা আইসোলেশন কী? এই সোশ্যালাইজেশনের যুগে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কী? করেইবা কীভাবে? এদেশের মানুষ এগুলো এর আগে কখনো না শুনেছে না কখনো নিজের প্র্যাকটিকাল লাইফে অ্যাপ্লাই করেছে।
লকডাউন খুলে দেওয়ার কারণ বলা হচ্ছে ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানিব্যাগের স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্য থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এখন বিপণিবিতানগুলো খুলে দেওয়া মানে লোকজনের সমাগম। সেই জটলা থেকে অনেকের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে আরও মানুষকে সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি আমরা।
এছাড়াও এদেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে অনেক বেশি মানুষের নির্ভরশীলতা। এ দেশের অনেক মানুষের স্থির কোনো জীবিকার ব্যবস্থা নাই। ‘দিন আনে দিন খায়’ মানুষের হার অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। উপার্জন না হলে বউ-বাচ্চা সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। তাই পেটের তাগিদেও তাদের আইসোলেশন, কোয়ারান্টিনের মতো বইপুস্তকের শব্দ ভেঙে বাইরে বের হয়ে আসতে হয়েছে।
মানুষের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এখানে সামনে আনা উচিত যেটাকে বলা যায় psychological reactance বা ‘মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া’, যা সাধারণত reverse psychology হিসেবেও পরিচিত। এই তত্ত্ব বলছে মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের নির্দিষ্ট আচরণগত স্বাধীনতা রয়েছে এবং যখন এই স্বাধীনতাকে হুমকি দেওয়া বা নির্মূল করা হয়, তখন তারা আবার তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ হয়। অন্য কথায়, যখন কেউ আপনাকে কিছু করতে বলে, আপনি বিপরীতটি করেন। নিয়ম অমান্য করায় একটা মানসিক প্রশান্তি আছে। করোনাভাইরাস এবং এর অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে দুর্বল মানুষগুলোকে রক্ষা করতে যে ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করার প্রয়োজন সেই উচ্চতর মানসিকতার অভাব আমাদের মধ্যে প্রকট।
করোনাভাইরাসের রাজনীতিকরণ। প্রায়ই দেখা যায় সরকার এবং বিরোধী দল করোনার ব্যাপক বিস্তারের জন্য একে অপরকে দুষছে। অথচ করোনা ছড়ানোতে উভয় দলের কর্মকা- সমান দায়ী। সরকারি পলিসির বিরোধিতার জন্য অনেক সময় মানুষ নিয়ম মানছে না। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি এটা সরকারি বিধি না এটা স্বাস্থ্যবিধি। অবশ্যই জনগণের আচরণের পরিবর্তনের জন্য অর্থবহ কিছু নীতি সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে, দোদুল্যমানতার স্থান নেই। অবশ্য জনসাধারণেরও আস্থা রাখতে হবে। আরেকটি কারণ মানুষ ভাবছে বয়সে তরুণ এবং যাদের আগে থেকে কোনো রোগ নেই তাদের মৃত্যুঝুঁকি কম। অথচ রিসেন্ট ভ্যারিয়েন্টে দেখা যাচ্ছে এতে তরুণরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।
এই একশ’ বছরে আমাদের পরিবর্তন শূন্য। সেটা যুক্তরাষ্ট্রে তো বটেই আমাদের দেশেও। একশ’ বছর আগের একই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চাপে দেশের সরকার। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করছে। ধর্মীয় গ্রুপগুলোও বসে নেই। ইতিহাস ঘেটে দেখা যাবে ১৯১৮ আর ২০২০-এর রোগতাত্ত্বিক প্লট একই।
গত বছর আমরা একেবারেই আনকোরা ছিলাম। পিছন থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এ বছর যদি না শোধরাই লাশের সারি গুনতে হবে। যতটুকুই করি ভালোভাবে করি। আশা করি এই কালো দিন কেটে যাবে।
শেখ আব্দুল্লাহ আল মুকিত : চিকিৎসক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়