ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সাংবাদিকতার সস্তাকরণই বিড়ম্বনার কারণ!

রনি রেজা
🕐 ১২:১১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০২১

সাংবাদিকতার সস্তাকরণই বিড়ম্বনার কারণ!

সাংবাদিকতা পেশাটাই তো বিড়ম্বনার। ডাক্তার, উকিল, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি কিংবা সাধারণ জনগণ; সব শ্রেণিই যেন এক বাক্যে সাংবাদিকদের শত্রু জ্ঞান করে। পেছনের কারণ অনেক। কিছু কারণ বিপক্ষে যায়। ব্যথিত হই। আবার কিছু কারণ গর্বেরও। অনুসন্ধানী অনেক প্রতিবেদন অনেকের বিপক্ষে যায়। তারা সাংবাদিকদের শত্রুই ভাববে। তাতে কিছু যায় আসে না। দেশের কল্যাণ হয়। এতে একজন সাংবাদিক হিসেবে পেশার প্রতি ভালোলাগা বাড়ে। গর্ববোধ করি। পেশাটার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। এতটুকু বিড়ম্বনা, এতটুকু রিস্ক জেনেই তো এ পেশায় নাম লিখিয়েছি। কিন্তু কিছু বিড়ম্বনা হৃদক্ষরণ বাড়ায়। হাপিত্যেস করি। পরক্ষণে থেমে যাই। পেছনের কারণ খুঁজে হতাশ হই। পেশাটার মস্ত বড় ছিদ্র রয়ে গেছে। বন্ধ করা দূরে থাকুক আমরাই যেন তা পুষছি। একটু সহজ করে যদি বলিÑ পেশাটা খুবই সস্তা হয়ে গেছে। এর কারণেই আজ বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে যেখানে সেখানে। যখন তখন। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা আরও ভাবিয়েছে বিষয়টি। গত বৃহস্পতিবার নিউজফিডজুড়ে ছিল পেশাগত দায়িত্বে বের হওয়া সাংবাদিকদের পুলিশ কর্তৃক হয়রানির শিকার হওয়ার খবর। গণম্যাধমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী লকডাউনের প্রথম দুই দিনে রাজধানীতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে মামলা, আটকে রাখা এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়াসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

কয়েকটি উল্লেখ করা যাক- নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে দৈনিক ঢাকা টাইমসের নিজস্ব প্রতিবেদক আলামিন রাজুকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। এসময় তাকে দীর্ঘক্ষণ পুলিশের জেরার মুখে ফাঁড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। পরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তাকে মুক্ত করা হয়।

এ বিষয়ে আলামিন রাজু বলেন, গতকাল আমি পুলিশের চেকপোস্ট এলাকায় তাদের দায়িত্ব পালনের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করছিলাম অফিসে পাঠানোর জন্য। কিন্তু সেখানে দায়িত্বে থাকা তিনজন কনস্টেবল এতে বাধা দেন। সেই সঙ্গে আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে আমি মোবাইল ফোন না দেওয়ায় আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। এসময় আমার জুতাও ছিঁড়ে ফেলে। পরে তারা আমাকে টেনেহিঁচড়ে ঢাকা উদ্যানের পুলিশ ফাঁড়িতে ঘণ্টাখানেক অবরুদ্ধ করে রাখে। একই অভিযোগ করেন মানবজমিন পত্রিকার চিত্রসাংবাদিক জীবন আহমেদ। তিনি বলেন, গতকাল আগারগাঁও এলাকায় পুলিশের দায়িত্ব পালনের ছবি তুলছিলাম। এজন্য সেখানে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরা আমার গাড়ি আটকায় এবং গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে মামলা দেয়। তারা আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স না পাওয়ায় মামলা দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি মানছি আমার সঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্স তাৎক্ষণিক ছিল না। কিন্তু তাই বলে ৪ হাজার টাকা মামলা দিতে হবে আমাকে? আমি তো পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম একটা জরুরি অবস্থায়।

এ সময় তো তারা এটা না করলেও পারতেন। কিন্তু আমি যা বুঝেছি তা হলো আমি সাংবাদিক বলেই এই মামলা দেওয়া হয়েছে। জীবন আহমেদ বলেন, দুঃখজনক বিষয় হলো, করোনাকালে পুলিশ যে ছবির কারণে মানবিকভাবে আলোচনায় এসেছিলো সে ছবিটাও আমার তোলা। অথচ আমিই পুলিশের হয়রানির শিকার। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মিরপুর-১ এলাকায় হয়রানির শিকার হন ঢাকা পোস্ট ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ রিপন। তিনি বলেন, সকালে পুলিশের চেকপোস্ট এলাকায় কী রকম দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে সেটির ভিডিও নিচ্ছিলাম ফোনে। এ সময় মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাহাতাব উদ্দিন আমার মুঠোফোনটি কেড়ে নিয়ে গাড়িতে চড়ে চলে যান। এর দু’ঘণ্টা পর উনার কার্যালয়ে গিয়ে মুঠোফোনটা আনি। তিনি বলেন, ডিসি যখন আমার মোবাইলটা কেড়ে নেন হাত থেকে তখন আমার গলায় অফিসের কার্ড ঝুলছে। এসময় তার সঙ্গে থাকা অফিসাররা তাকে বারবার বলছিলেন- স্যার, উনি সাংবাদিক। তবুও তিনি এমনটা করেছেন। উল্টো বলেছেন, কীসের সাংবাদিক! প্রেসক্লাবের অনুমতি আছে? একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন অর্থসূচক পত্রিকার সংবাদকর্মী মো. হৃদয় আলম। তিনি জানান, সকালে কারওয়ান বাজার এলাকায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতির লাইভ দিচ্ছিলেন। এসময় পুলিশ সদস্যরা এসে তাকেও নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন।’ গণমাধ্যমে আসা খবরের মধ্য থেকে অল্প কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করলাম। এর বাইরেও অরেক রয়েছে।

যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতিকে সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে তাদের তো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগিতা করার কথা। তবে হয়রানি করছে কেন? বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়- সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও মামলা দিয়েছে পুলিশ। মুভমেন্ট পাস চেয়েছে। যদিও সাংবাদিকদের মুভমেন্ট পাস প্রয়োজন নেই। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ১৮ পেশার মানুষের মুভমেন্ট পাস লাগবে না, সাংবাদিকও সে ক্যাটাগরিতে আছে। তাহলে ওই পুলিশ মুভমেন্ট পাস চাইবে কেন? তা না থাকায় মামলাই বা কেন দেবে? রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে প্রতিিিষ্ঠত এমন একটি পেশার মানুষের সঙ্গে পুলিশ বাহিনী এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করার সাহস কেন পায়? আমরাই দিচ্ছি না তো? এই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে অনেকই এমন খবর পেয়েছি। এ নিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি। সাংবাদিকদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দেখিনি এসব নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বসতে। বা প্রতিবাদে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। বরং পরক্ষণেই পুলিশের ডাকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখেছি তথাকথিত অনেক বড় সাংবাদিককে। পুলিশের গুণকীর্তন গেয়ে শুধু তাদের খুশি করতে অপ্রয়োজনীয় অনেক খবরও প্রকাশ হতে দেখি এখনো। আমি আবার উল্লেখ করছি- ‘অপ্রয়োজনীয় অনেক খবর।’ প্রয়োজনীয় প্রমোশনাল সংবাদের কথা বলছি না। যখন শুধু খাতির জমানোর উদ্দেশ্যে বা খুশি করতে পুলিশের সন্তুষ্টিমূলক সংবাদ প্রকাশ করা হয় তখন তিনি আপনার পেশাটাকে সস্তা হিসেবেই গণ্য করেন। ফলে এই পেশার মানুষের প্রতি তাদের ধারণা ওই সস্তাশ্রেণিরই হয়। আচরণও এমনই হবে; এটাই স্বাভাবিক। এবার আরেকটি কারণ নিয়ে আলোচনা করি। এবার লকডাউন শুরুর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ একই সঙ্গে রমজানের প্রথম দিন একটা বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হয় আমার। দূরসম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের ফোনে ঘুম ভাঙে। শেষ কবে কী প্রয়োজনে ফোন করেছেন তা-ও মনে নেই। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় খোঁজ নিতে বা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে তিনি ফোন করেননি। উদ্বিগ্ন হয়ে কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেনÑ খুবই বিপদে পড়ে আমাকে ফোন করেছেন। একমাত্র আমিই নাকি উদ্ধার করতে পারি। কৌতূহল আরও বাড়ল। শেষে জানালেন তার একটি সাংবাদিকতার কার্ড দরকার। ‘এবারের লকডাউন খুবই কড়া। মুভমেন্ট পাস নিতেও ঝামেলা। ওয়েবসাইটে অনেক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। কাজ হয়নি। শেষে আমার পাশের বাসার এক ভাই এই বুদ্ধি দিলেন। সাংবাদিকের কার্ড থাকলে নাকি পুলিশ কিছু বলে না। সে-ও (ওই পাশের বাসার ভদ্রলোক) নাকি একটা কার্ড ম্যানেজ করেছে। ৫০০ টাকা লেগেছে তার। লাগলে আমিও দেব। তুমি আমাকে একটা কার্ডের ব্যবস্থা করে দাও বাজান।’

একদমে কথাগুলো বলে ফেললেন ওই পরিচিতজন। শোনার পর আমি অবাক হওয়ার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছি। এমন অভিজ্ঞতা তো এই প্রথম নয়। নানা সময়ে নানাজন সাংবাদিকতার কার্ড আবদার করেন। তাদের নানাভাবে বুঝিয়ে বিদেয় করি। অনেককে বোঝাতেও ব্যর্থ হই, এটা অনৈতিক। এতে দুটি পেশাকেই ছোট করা হয়। এক. আপার নিজ পেশায় আপনি সন্তুষ্ট নন। দুই. সাংবাদিকতা এক সস্তা পেশা। চাইলেই যে কেউ হতে পারে। কোনো নিয়ম নীতি নেই। সত্যি আছে কি? থাকলে কী সেই নিয়ম। যা জানিয়ে এদের থামাতে পারব? বা কতক্ষণ থামিয়ে রাখতে পারব? আমি বিদেয় করার পর ঠিকই তিনি ‘পিআরইএসএস’ লেখা চকচকে প্লাস্টিক কার্ড নিয়ে হাজির হন। সঙ্গে শুনিয়ে যান দু’চারটি বেশি কথা। আমি তার মঙ্গল চাই না, এ কারণে কার্ড দিইনি। কিন্তু তিনি ঠিকই অন্য কোনো সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কার্ডটি সংগ্রহ করতে পেরেছেন। অর্থাৎ কোনো না কোনো সাংবাদিকই চাচ্ছে যে পেশাটাকে সস্তা করতে। এত সহজে যে পেশার কার্ড মেলে সেই পেশাকে আলাদা করে সম্মান দেখানোর কোনো যৌক্তিকতা আছে কী? কিংবা ওই দায়িত্বরত পুলিশের কথা চিন্তা করুন, ইতিপূর্বে ১০টি অমন ভুয়া কার্ডধারী সাংবাদিককে ধরতে পেরেছেন। তিনি তো পরবর্তীকালে পেশাদার সাংবাদিককেও একইভাবে বিবেচনা করবেন।

সাংবাদিক হয়রানি বা পেশাগত দায়িত্ব পালনে বিড়ম্বনার খবর মোটেও ভালো লাগে না। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু সমাধান খুঁজেও পাই না। এভাবে চললে সমাধান হওয়াও সম্ভব নয়। সাংবাদিক হওয়ার ন্যূনতম নিয়মনীতি নির্ধারণ করতে হবে। পেশার গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এমনিতেই সবাই গুরুত্ব দেবে। দিতে বাধ্য হবে।

রনি রেজা : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক

 
Electronic Paper