ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা কোথায়

ওয়াসিম ফারুক
🕐 ১২:০৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০২১

ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা কোথায়

বিগত বেশকিছু দিন যাবত অনেকেরই ব্যক্তিগত ফোনালাপের অডিও রেকর্ড ফাঁস করছে আমাদের দেশের কিছু সংবাদমাধ্যম। কারও ব্যক্তিগত ফোনালাপ বা তথ্য তার অনুমতি ছাড়া প্রকাশের অধিকার সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের অধিকার কতটুকু আছে তা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন আছে? সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে এই সকল ব্যক্তিগত ফোনালাপসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য সংবাদমাধ্যমের কর্মীসহ অন্যদের কে বা কারা সরবরাহ করছে? আমাদের দেশের স্বার্থান্বেষী কিছু সংবাদমাধ্যম তাদের ব্যক্তি হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য বিনা দ্বিধায় দেশের অনেক সম্মানিত মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে। ওই সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার কু-মতলবে লিপ্ত।

সাংবাদিকতার নীতিতে যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত বলে শুনতে পেলাম। খালেদা জিয়া এখন অন্তরীণ। বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে বাড়িতে অবস্থান করলেও কার্যত তিনি জেলেই আছেন। তাই তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তা অনেকেই মানতে চায়নি। এমনকি তার রাজনৈতিক দল বিএনপি ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিল। প্রথমে তারা স্বীকারই করতে চান যে বেগম খালেদা জিয়ার কোভিড টেস্ট করা হয়েছে। পরে অবশ্য তাদের দলের পক্ষ থেকে বেগম জিয়ার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়। তার আগেই বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে বেগম খালেদা জিয়ার আইসিডিডিআরবি-র করোনা পরীক্ষার ফলাফলের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় যা মুহূর্তেই সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন জনের দেয়ালে দৌড় শুরু করে।

অনেকেই এটা নিয়ে আবার নানান মন্তব্য ও করছেন। তবে দলমত নির্বিশেষে বেশিরভাগই তার দ্রুত রোগ মুক্তির কামনা করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার নিকট দোয়া করছি। সবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারা আমাদের দেশের রাজনীতির শীর্ষস্থানে আছেন তাদের দলের নেতাকর্মীদের অন্তরের একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছেন। তাই তাদের জন্য সাধারণ মানুষ হিসেবে সম্মান দেখানো দোয়া বা আশীর্বাদ করাটা নৈতিক দায়িত্ব। তবে আমাদের বর্তমান তথাকথিত রাজনীতি আমাদের সেই নৈতিক বোধ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছে। গত কিছুদিন আমরা দেখলাম হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়েল রিসোর্টের ঘটনার পর তার স্ত্রী ও তথাকথিত স্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন ফোনালাপের অডিও রেকর্ড আমাদের কিছু অতিউৎসাহী সংবাদমাধ্যম বিনা দ্বিধায় প্রচার করেছে। আমরা জানি না মামুনুল হকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ ওই সকল সংবাদমাধ্যমের কাছে কে বা কারা সরবরাহ করেছে।

এর আগেও ২০১২ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজামুল হক এবং ব্রাসেলসে অবস্থিত একজন বাংলাদেশি আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে স্কাইপ কথোপকথন এবং ইমেইল ফাঁস করে একাত্তরের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের কাজে বিঘিœত করতে চেয়েছিল তৎকালীন কিছু সংবাদমাধ্যম। এখনো এর ধারাবাহিকতা চলছে। বিভিন্ন সময় আমাদের কিছু সংবাদমাধ্যম দেশের খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের বিভিন্ন ফোনালাপের অডিও ক্লিপ প্রকাশ করেই চলছে। তাদের কর্মকা-ে মনে হয় তারা যেন দেশের প্রতিটি নাগরিকের ফোনেই আড়ি পেতে রেখেছে। কারও ব্যক্তিগত কথাবার্তা বা তথ্য প্রকাশের এই অধিকাক তাদের কে বা কারা দিয়েছে? কেউ যদি কারো ফোনালাপে রাষ্ট্র সমাজ বা ব্যক্তির জন্য হুমকি ক্ষতি বা বিপদ ঘটানোর কোনো পরিকল্পনা করে সেটা অবশ্যই অবশ্যই মারাত্মক অপরাধ তার জন্য অবশ্যই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছেন তারাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে কোনো সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রকাশ করা অবশ্যই দ-নীয় অপরাধ।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তির গোপনীয়তার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন নেই। বর্তমানে যেসব আইন রয়েছে এর মধ্যেই গোপনীয়তা সম্পর্কিত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে বাংলাদেশে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অ্যাক্ট’ ২০০৬-এর অধীনে যে সাইবার আইন রয়েছে সেখানে উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ইলেকট্রনিক রেকর্ড, যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা-অধিকারের মধ্যে রয়েছে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য, অসুস্থতাজনিত তথ্য, যোগাযোগ তথ্য (যেমন- ফোন, মোবাইল নম্বর, পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র) ইত্যাদি। স্বাস্থ্যসম্পর্কিত তথ্য যেমন- জিনগত পরীক্ষা এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্যও গোপনীয়তা অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যোগাযোগের গোপনীয়তার মধ্যে রয়েছে চিঠি, টেলিফোন, ই-মেইলসহ যোগাযোগের সব ধরনের মাধ্যমের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা। ব্যক্তির গোপনীয়তার ক্ষেত্রে বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র বা জনসমাগম স্থান প্রভৃতি জায়গায় অন্যের অবৈধ অনুপ্রবেশকে সীমাবদ্ধ করাও ব্যক্তির গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত। যেমন তল্লাশি, ভিডিও নজরদারি, পরিচয়পত্র যাচাই ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। এরকম হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইন সুরক্ষিত করতে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্সের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা সনদের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

বর্তমান এই ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন কারণে আমাদের বায়োমেট্রিক তথ্যসহ বিভিন্ন তথ্য অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আসছি তবে আমাদের সেই সব তথ্য তাদের কাছে কতটুকু নিরাপদে সংরক্ষিত আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ও বিভিন্ন সময় অপব্যবহার হয়েছে। যেহেতু আমাদের তথ্যঅধিকার আইনে অসুস্থতাজনিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করা অপরাধ হিসেবে গণ্য তাই যে বা যারা বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাজনিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করছে তারা সেই অপরাধে অপরাধী। এর আগেও আমরা দেখেছি একটি কুচক্রী মহল বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে তার মানহানি করার অপচেষ্টা করেছে। এটা একটা অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও অবশ্য বিএনপি বা বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করি নাই।

বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাজনিত তথ্য অর্থাৎ করোনার পজেটিভ সার্টিফিকেট কে বা কারা সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ করল তার জন্য বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আইনের মাধ্যমে তদন্ত করে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের চরিত্র হননসহ রাজনৈতিকভাবে তাদের বিভিন্ন ফোনালাপসহ বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ এটা আমাদের রাষ্ট্রেরই দুর্বলতাকে প্রকাশ করছে। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদে রাখা। তবে রাষ্ট্র আজ আর সেই কাজটি সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না বিধায় বিভিন্ন মাধ্যমে তা চলে আসছে লোকালয়ে। যাতে একজন ব্যক্তির সম্মান ক্ষুণ হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন, যারা রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করাতে পারছে না আমাদের রাষ্ট্র; সেখানে আমাদের মতো নগণ্য নাগরিক ব্যক্তি তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চয়তা কে দেবে? এখনো সময় আছে, আমাদের রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে সুরক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার।

ওয়াসিম ফারুক : কলাম লেখক

 
Electronic Paper