ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রূপদক্ষ শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’

ড. আব্দুল মজিদ
🕐 ১২:৩৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৬, ২০২১

রূপদক্ষ শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’

মজিদ মাহমুদ কবি এই হিসেবে তার সঙ্গে আমাদের চেনাজানা আছে। জানা আছে চেনার বিষয়টা আপেক্ষিক। আমি তার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করেছি। বিশেষ করে মাহফুজামঙ্গল, আপেল কাহিনি, বল উপাখ্যান। সেখানে বিভিন্ন তথ্য সামাজিক বিভিন্ন অভিযোগ আমরা পাঠ করেছি। কবিতার মধ্যে যে শক্তি একটা জীবনের দায়ভার নিয়ে কবি মানুষের কাছে যেতে পারে আমরা নির্মূলভাবে তার কবিতা থেকে ম্যাসেজগুলো পেয়েছি। তিনি একটা পাঠক গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছেন। তাদের ধারণা, কথিত সত্য তার অবয়মান সাহিত্যচেতনা বেশ একটা বিশিষ্ট জায়গা স্থান করে নিয়েছে। এই জন্য তার মননের কাছে পাঠককে বারবার ফিরে আসতে হয়। তার মেধার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় এবং সবচেয়ে তার বড় গুণ তার যে শৈল্পিক চাতুর্য অর্থাৎ চতুর্দিক। কিন্তু শিল্প আছে সে শিল্পকে শৈল্পিক করার যদি তৃষ্ণা থাকে এই অন্তর হতে তৃষ্ণা আহরণ করে তার রূপ অন্তর্গত করা কঠিন কাজ। ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি এবং বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি তার কাহিনি বলে নয়। শিল্পের যে তর্ক বা চোট, শিল্পের যে একটা আত্মচিৎকার এই চিৎকারের ধ্বনিটা মজিদ মাহমুদ কীভাবে তুললেন। একটা ট্র্যাজিক- হাসানকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে অন্তরজাতক সহজাতক প্রবৃত্তি যেটা ট্র্যাজিক। এটা লোকায়িত। মানুষ এমন একটি প্রাণী- সৃষ্টির আগমন ঘটে তখন জন্মেরও প্রবণ ঘটে। অর্থাৎ জীবনের অনুপস্থিতিই মৃত্যু। এখন এই মৃত্যুরও তো একটা ব্যাখ্যা আছে। যেহেতু মৃত্যুর ব্যাখ্যা আছে, সেহেতু জন্মেরও ব্যাখ্যা আছে। প্রথমেই সৃষ্টিকুলের যোনিজলের কথা বলা হয়েছে এটা একটা মিথ। মৃত্যু মানুষের রক্ত, মৃত্যু মানুষের চর্ম, মৃত্যু মানুষের চক্ষু, মানুষের কঠোর চারিত্র্যের নির্দিষ্ট আঙ্গিক সবই মিথ দিয়ে তৈরি। শরীর মৃত্যু যে পলায়ন এটাও সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ।

সে বলছে জলযোনির কথা কিন্তু উপরান্ত মিথের শক্তিতে বলা হচ্ছে যোনি এবং জলের কথা তাহলে প্রথমেই লেখক একটা পরিপক্ক শব্দ দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। এখানে শিল্পের একটা খেলা। হাসান একটি চরিত্র কিন্তু আস্তে আস্তে অন্তর্দ্বন্দ্বে জীবনের জায়গাতে সে মিশে যেতে চায়। কিন্তু লুকানো আছে কিছু প্যাথেটিক বিষয় বা সমবিষয়ের ভাবাতীর্থ সেটা ভাবশৌর্যে পরিণত হয়েছে। বিলু নামের একটি মেয়ের সঙ্গে সে পড়ালেখা করেছে। একই বিষয়ে কর্মযাপন করছে। কিন্তু কত ফাঁক জীবনঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে তার সেই ইজম বা কলা তৈরির- ইজমের কথা, ভালোবাসার কথা ভালোলাগার কথা, চেতনার কথা, আবেগের কথা জীবনের কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে। কিন্তু তার জিজ্ঞাসু মন আছেÑ সেই করার্ত চিৎকারের বারবার হুঙ্কার করছে।

চৈতন্যপ্রবাহের কাছে হাসান বারবার ফেল হচ্ছে। কিন্তু শিল্পী নৈবেদ্যে সবচেয়ে দ্বন্দ্ব আমার কাছে মনে হয়েছে এটা। হাসানের মধ্যে হাহাকার দেখছি। একটা ট্র্যাজিক সত্যের কাছে সে বারবার বাড়ি খাচ্ছে আর শিল্পী আনন্দ উপভোগ করছে। চৈতন্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে তিনি একটা প্রাকৃতিক প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। মানুষ মাত্রই তো প্রকৃতি। সত্যের আবিষ্কারে কেউ কেউ বলেছেন- প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মানব। এই উপন্যাসে লেখক প্রকৃতির দাস বলেছেন। প্রথমে দেখি ‘বেথেলহেমের পথে পথে’ এসেই মজিদ মাহমুদ টার্ন নিচ্ছেন এখানে তিনি সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে একাকার করে ফেলেছেন। ‘বেথেলহেমের পথে পথে’ আমরা দেখলাম চরিত্রগুলোতে রূপকবৃত্ত শব্দ যা মানুষের জীবনে দ্বন্দ্ব এই দ্বন্দ্ব ঈশ্বরের পাতানো। ঈশ্বরের পাতানো এই জন্য- তিনি পাটনীযুগের কথা বলেছেন ঈশ্বরকে দিয়ে মানুষের সমস্ত শক্তি। মানুষের জন্মের এবং মৃত্যুর সবচেয়ে বিচ্ছেদ এবং বৃদান্তরূপের যে ঘটনা সেটি ঠিক থাকবে পৃথিবী যত দিন বেঁচে থাকবে। এই সত্য কোনোদিন বিগ্রহ করতে পারবে না। ইডিপাস সফোক্লিসের নাম সারা বিশ্বে জাগ্রত থাকবে এই জন্য এমন সত্য কেউ উপহার দিয়েছেন যে সত্যের কাছে আমরা কোনো কিছু করতে পারছি না। ইডিপাস বারবার চেষ্টা করেছে সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য কিন্তু বারবার নিয়তির নির্ধারিত ডাকে সে পরাস্ত হয়েছে। এক শর্তে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছেন।

মজিদ মাহমুদ সমকালমুখী হতে চেয়েছেন একটা নিয়তকে কেন্দ্র করে। স্বাভাবিক মানবজীবনের মধ্যে যে প্রভাবতা জীবন জগৎ প্রকৃতি চরিত্র সাক্ষাৎ পেয়েছে। যার প্রয়োজনীয় ধারণা এটা যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- রমেশ একটা চরিত্র দেখলাম রমেশ খেজুর গাছে উঠে খেজুর রস খাওয়ার একটা কাহিনি এবং সেখানে একটা চিত্রধর্মী বর্ণনা করেছেন এবং সুখ আর দুঃখ ভাবধারণার সেখানে তিনি উপস্থাপন করেছেন। খেজুরের রস পেড়ে নিয়ে আসে এবং ওইখানে একটা চরিত্র আছে ম্যাজিশিয়ান রূপে প্রেক্ষণগুলো অন্য দিকে চালিত করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে খেজুরের রস সাপ খায় সাপ যে রস খায় সাধারণ মানুষ সে রস পান করে অর্থাৎ সাধারণ উপায়ে এই ভয়টা মজিদ মাহমুদ সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন। গ্রামে আমরা দেখি বিশেষ করে ফোক চেতনায় যারা বিশ্বাসী তাদের ভিতরে কুসংস্কার থাকে এবং বিশেষ করে পশ্চাৎকাম থাকে সেগুলো অতিক্রম করে মানুষ সামনের দিকে আগাতে চাই। মজিদ মাহমুদ ওইখানে থেকেই হাঁটে অর্থাৎ বিচিত্র সৃষ্টি প্রকৃতি এদের মধ্যে যে বিভেদ কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। কেননা তার ইচ্ছা হয়েছে সমকালমুখী হওয়ার জন্য।

আমাদের দেশ- স্বাধীনতা আগের ঘটনা পরের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের দেশাত্ম রূপ এবং মুক্তিযুদ্ধের যে কলাকৌশলের মধ্যে আমি দেখলাম সেকিছু বিষয় রমায়িত করার চেষ্টা করেছে। কেননা কবি এবং শিল্পী হাতে মারে না এবং কোনো সমস্যা হলে সমাধান করে ফেলে। সমস্যার কথা তিনি বলেছেন আমাদের দেশে নারীদের প্রতি প্রকৃতি রাজনীতি সুভাষলিপ্ত ভাব বৈশিষ্ট্য শ্রেণির সাহিত্য কীভাবে চর্চা করে সেভাবে কথা পেপার পত্রিকা কভার করতে চেষ্টা করেছেন অর্থাৎ চলমান জীবন আমাদের বিজ্ঞানে যেটা আমরা বলেছি সাহিত্য হওয়ার একটা সত্য হচ্ছে সমকালকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে সরবরাহ করা।

মজিদ মাহমুদ মনে মগজে সেটা বিশ্বাস করে আমাদের এই বার্তা দিতে চেয়েছেন। ফলে অন্তরজাতকটা সত্তা শুধু সৃষ্টির ক্ষেত্রে শোভনটা কাজ করেনি। এই বার্তা স্বাভাবিক আকারে মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটা বার্তা হিসেবে এই উপন্যাসটা অনন্য। ফলে সৃষ্টির যে নিরুদ্ধ রূপ এবং স্রষ্টার যে প্রবৃত্তিগত সত্তা সব মিলিয়ে প্রকৃতি হয়েছে প্রাণচঞ্চল। মানুষের কাছে মানুষ যে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপাদান দার্শনিক রূপকে প্রকৃতি সমগোত্রীয় সত্তার সঙ্গে শিকার করা হয়েছে। তার পরেও মানুষ অনন্য।

মজিদ মাহমুদের এই উপন্যাস সময় উপযোগী। যুগের সঙ্গে আমাদের যে প্রজন্মের ধারণগত প্রকাশ এই প্রকাশের সঙ্গে কবি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন- তার মননের মধ্যে যে গমন এই গমনের ভিতরে যে আত্মচিন্তা তা আমাদের ভাবিত করেছে এবং লেখক সার্থক এই জন্য পাঠককে সে আন্দোলিত করতে পেরেছে। কামে প্রেমে ভাবে তাড়নায় সংগ্রাম সম্প্রীতিতে পাঠককে বিভিন্নভাবে নাচিয়েছে। আর সেই নাচনের পিছনে কিছু খচিত রূপ তুলে ধরেছেন। ফলে মানুষ মাত্রই ট্র্যাজিক রূপের ও ট্র্যাজিক সত্যের এটা ধারণাগত সত্তা। জীবরূপে তার অবস্থান ফলে মানুষের মুক্তি নেই। মানুষের হাহাকার থেকে মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করেছে- পারছে না। যেভাবে হাসান বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন আমরাও চেষ্টা করে বের হতে পারছি না। আমাদের যে যথাযথ সংসার আমাদের যে জীব ও বৈচিত্র্যের মিলবন্ধন পদলত মুক্তি পাচ্ছি না। ফলে নিদেন থেকে বা মোটা দাগে পাঠ করলে আনন্দের জায়গা পাওয়া যাবে চেতনার ক্ষেত্রে ভাবের ক্ষেত্রে ভাবকে ভাব ঐশ্বর্য পদার্পণ করলে আত্মতৃপ্তি একটা সংঘাত সৃষ্টি হয়। আমরা দেখেছি শেষপর্যন্তÍ রিয়ার একটা প্রেমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং সে প্রেমে বারবার কিছু সংলাপ করা হয়েছে সেই সংলাপের মধ্যে বেঁচে থাকার তাগিদ এবং মুগ্ধভাবে বেঁচে থাকার যে তাগিদ সমস্ত অসম্ভব দূর করে। ভাবের ক্ষেত্রে প্রেমের ক্ষেত্রে যে আবর্জনা আছে সেটা দূর করে একটা অমৃতরসে ভাবঐশ্ব র্য চেতনার সন্ধিপানে নিজেকে আবিষ্কার করার একটা আত্মপ্রত্যয় আছে। এই উপন্যাসে কবি মজিদ মাহমুদ সত্যিই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।

ড. আব্দুল মজিদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 
Electronic Paper