রমজানে সিয়াম সাধনায় সুস্বাস্থ্য জরুরি
ডা. মাজেদ হোসাইন
🕐 ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০২১
মুসলমানদের পাঁচটি ধর্মীয় ভিত্তির মধ্যে রমজান অন্যতম। ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মাসে রোজা রেখে, ইবাদত বন্দেগি করে, তারাবির নামাজ পড়ে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত কামনা করেন। এ মাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিশেষ রজনী হচ্ছে পবিত্র লাইলাতুল কদর, যে রাতে পবিত্র কোরআন শরিফ নাজিল হয়েছে। সুতরাং এ মাসের পরিপূর্ণ সিয়াম সাধানার জন্য সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
রোজা রাখলে আমাদের শরীরের সঞ্চিত শক্তি ক্ষয় হয়ে চর্বি ভাঙতে থাকে। এজন্য রমজানে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত কীভাবে স্বাস্থ্য ঠিক রেখে রোজা পালন করা যায় সে দিকে গুরুত্ব দেওয়া। বিশেষ করে রোগীদের জন্য মাসে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। প্রাত্যহিক রুটিনের হেরফের হবে এই সময়ে। ডায়াবেটিসের রোগীরা কি রোজা রাখতে পারবে? ডায়াবেটিস একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। সীমিত খাবার গ্রহণ, মুখে খাবার ডায়াবেটিস বড়ি এবং ইনসুলিন সময়মতো গ্রহণ করা এবং শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম বেশি করা, মিষ্টি, শর্করা এবং চর্বিজাতীয় খাদ্য কম গ্রহণ বা পরিহার করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কাজেই বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখার ব্যাপারে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ইনসুলিন ৩০ শক্তি ডোজ বা মাত্রা এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো সময় নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে ইফতারির সময়, সেহরির সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ নির্ণয় করে ওষুধ অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে। যেসব ডায়াবেটিক রোগীর জটিলতা বা কপ্লিকেশন আছে যেমন হার্টের অসুখ, কিডনি ফেইলর আছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শমতো এবং রোগের ধরন ও গভীরতা থেকে নির্ধারণ করতে হবে যে সে রোজা রাখতে পারবে কিনা।
ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট, যে কোনো সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা ও পুরুষ এবং পেপটিক আলসার ডিজিজ, ডায়াবেটিক রোগীর রোজা রাখার কোনো বাধা নিষেধ নেই। শুধু সঠিক এবং সুষম খাবার গ্রহণ, প্রচুর পানীয় এবং তাজা ফলের রস গ্রহণ, ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া, ফাস্টফুড, জাংকফুড কম খাওয়া, তামাক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার করা, সাধারণত সেহরি ও ইফতারের পর চা কফি খাওয়া অনুচিত। কারণ চা-কফির ক্যাফেইন অনেক সময় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। নিয়ম মেনে রোজা রাখার পরেও এসব সমস্যা হতে থাকলে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সেবন করলে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব মাথাব্যথা, দুর্বলতা ও ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে প্রায় সবারই মাথাব্যথা, দুর্বলতা, ক্লান্তি চলে আসে। অনেকেরই আবার ব্লাড প্রেসার কমে যায় এবং কেউ কেউ অজ্ঞানও হয়ে যায়। এর অন্যতম কারণ হলো, সেহরি ও ইফতারে তরল এনার্জেটিক খাবার গ্রহণ না করা এবং কিছু উত্তেজক খাবার ও পানীয় গ্রহণ। তরল খাবারের মধ্যে দুধ, স্যুপ, ফলের জুস, লেবুর শরবত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। খাবারের লবণের পরিমাণ কমে গেলেও দুর্বলতা, ক্লান্তিভাব ও প্রেসার কমে যেতে পারে। তবে অবশ্যই চা কফি, মসলাযুক্ত ও টকজাতীয় খাবার গ্রহণ না করা বাঞ্ছনীয়। কারণ সেহরিতে চা কফি খাওয়ার ফলে এর ক্যাফেইন সারাদিন পিপাসা লাগার অন্যতম কারণ।
অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ গ্রহণ করে যে কেউই রোজা রাখতে সক্ষম। খুব বেশি অসুস্থ, গর্ভবতী মা ও দুগ্ধ প্রদানকারী মা, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, মানসিক রোগী এদের রোজা না রাখাই ভালো। এছাড়াও হার্টের সমস্যা ও হাইপারটেনশন অনেকেই ভাবেন হার্টের সমস্যায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের জেনে রাখা ভালো হার্টের যেকোনো রোগ হলেই রোজা রাখা যাবে না এমনটি ধারণা করা সম্পূর্ণ ভুল। নিউইয়র্ক হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনারি আর্টারি ডিজিজে রোজা রাখলে রোগীদের কোনো সমস্যাই হয় না। তারা ৮৬ জন রোগীর মধ্যে এই পরীক্ষা করেন। সেখানে বলা হয়েছে ৮৬ শতাংশ রোগীর সারা মাস রোজা রাখার ফলে কোনো সমস্যাই হয়নি। হাইপারটেনশন, এট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন, ভালভিউলার ডিজিজ, এনজাইনা পেকটোরিস, হার্ট ব্লক রোগীদের ক্ষেত্রে তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন ২৮৮ জন রোগী এসব রোগ নিয়ে রোজা রেখেও উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যায় পড়েননি। এসব ক্ষেত্রে সফলতার হার ৯১.২ শতাংশ। তবে হার্টের রোগীদের অবশ্যই ভালোভাবে রোজা রাখার জন্য মানসিক চিন্তা, অ্যানজাইটি, উদ্বিগ্নতা, অত্যধিক ইমোশন ত্যাগ করতে হবে। নিয়ম মানার পরেও যদি সমস্যা হতে থাকে এবং সমস্যাটি দীর্ঘদিনের হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো হোমিওপ্যাথের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। কারণ হোমিওপ্যাথে এমন কিছু ওষুধ রয়েছে যা অনেক জটিল হার্টের রোগীকেও সুস্থ করতে পারে। এদের মধ্যে একোনাইট, অরামমেট, ক্যাকটাস, ক্র্যাটিগাস, ল্যাকেসিস, ডিজিটালিস, ফসফরাস, ন্যাজা ইত্যাদি ওষুধ উল্লেখযোগ্য।
বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের ক্ষেত্রে রোজা অনেকেই ভাবেন বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় রোজা রাখা যাবে না কারণ দুধ শুকিয়ে যাবে। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। তবে স্তনদানকারী মাকে অবশ্যই সহজে হজম হয় এমন খাবার প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। এভাবে রোজা রাখার পরও যদি সমস্যা হয় তাহলে তারা হোমিওপ্যাথের শরণাপন্ন হতে পারেন। কারণ হোমিওপ্যাথিতে বুকের দুধ বাড়ানো ও কমানো উভয়েরই মানসম্পন্ন ওষুধ রয়েছে।
রিওমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীরাও চিন্তামুক্ত হয়ে রোজা রাখতে পারেন। কারণ সম্প্রতি ইরানিয়ান একটি রিসার্চে বের হয়েছে ৪৬-৫০ বছরের আর্থ্রাইটিসের রোগীরা রোজা রাখলে ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি লাভ করে। রিসার্চে বলা হয়েছে ৫৭.২ শতাংশ রোগীরা একটু সতর্কতার সঙ্গে তারাবির সালাত আদায় করলে ও ডায়েটের দিকে গুরুত্ব দিলে সহজেই রোজা পালন করতে পারেন। রিওমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ব্রায়োনিয়া, রাসটক্স লিডাম, কলচিকাম, লাইকো, ক্যালকার্ব, কস্টিকাম, ক্যালফস ইত্যাদি ওষুধ রোগীকে রিলিভ দিতে পারে। স্ট্রেস, ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি রিলিভার সম্প্রতি ইরানিয়ান ও সুইডিশ গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন ২৯-৩০ দিনের রোজা এবং প্রতিমাসে ২-৩টি রোজা পালন করলে স্ট্রেস, ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি অনেকাংশে কমে যায়।
মহান আল্লাহ রোজা রাখার বিধান দিয়েছেন তার বান্দাদের কল্যাণের জন্য। সারাদিন না খেয়ে থাকার নামই রোজা নয়। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে।’ সুতরাং নিয়মশৃঙ্খলার সঙ্গে রোজা পালনই এর মূল ভিত্তি। তথাপি বর্তমানে নিয়ম মানার পরেও অনেকেই বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন, অনেকেই আবার রোগ নিয়ে কীভাবে রোজা রাখবেন সেই চিন্তায় আছেন। এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক ও খাদ্যের সচেতনতা। এসব সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যার জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে অনেক সমস্যারই সমাধান সুন্দরভাবে করা সম্ভব। কারণ মনে রাখতে হবে সুস্থতাই জীবন। শৃঙ্খল জীবনযাপনই সুস্থতার মূল ভিত্তি। আর শৃঙ্খলার জন্যই রোজা এবং রোজাই আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সুস্থ অবস্থায় রোজা রাখার তওফিক দান করুন। আমিন।
ডা. মাজেদ হোসাইন : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য