ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনাকালীন বইমেলার দুর্দশা

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ১০:১০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২১

করোনাকালীন বইমেলার দুর্দশা

মেলা হচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এক মহাসম্মিলনের নাম। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড়। বৈশাখ মাস এলেই বাঙালির প্রাণের মেলার ধুমধাম পড়ে যায়। সে প্রচলন এখনো কম-বেশি বিদ্যমান আছে। সামনে বৈশাখ মাসের শুরু। এ বৈশাখে করোনার কারণে হয়তো আর মেলা বসবে না। কারণ গত বছরও বৈশাখীর অনেক মেলা, এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান অষ্টমীর স্নানও হয়নি। আশা ছিল, করোনা মহামারী কমে যাবে, এবছর হয়তো মহাধুমধামে মানুষ মেলা-পার্বণ পালন করবে। সে আশায় গুড়েবালি, সাম্প্রতিক সময়ে মহামারীর তা-বে লকডাউন শুরু হয়েছে। এর শেষ কোথায়, তাও আমাদের জানার বাইরে। গোটা বিশ্বই আজ স্তম্ভিত। কী হবে মানুষের ভাগ্যে! চিরাচারিত বাঙালির ঐতিহ্যবাহী মেলার পাশাপাশি জ্ঞানার্জনের প্রতীক বই নিয়েও যে মেলা হতে পারে, যা এক সময় মানুষের ধারণার মধ্যেও ছিল না। তবে ঘটা করে সেভাবে মেলা অনুষ্ঠিত না হলেও ১৯৬৫ সালে তৎকালীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক প্রয়াত সরদার জয়েনউদ্দীনের উদ্যোগে তখনকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলায় সীমিত আকারে বইমেলার শুরু। সে বছর থেকে প্রতিবছরই বইমেলা অনুষ্ঠিত হলেও আয়োজন ছিল সীমিত। যা ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সে মেলায় বইয়ের ওপর আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ সালে সরদার জয়েনউদ্দীন তখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। তখন ইউনেসকো ওই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থ বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করল। ওই সুবাদে সরদার জয়েনউদ্দীনের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক গ্রন্থ বর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হলো। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিশাল এক জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে উপলক্ষে সাত-আটজন প্রকাশক ঘরের বাইরে বই সাজিয়ে বসে পড়লেন। সে সময় থেকে বইমেলায় বইয়ের পসরা সাজিয়ে বই বিক্রির প্রচলন শুরু হলো। যা পরিপূর্ণতা লাভ করল ১৯৮৪ সালে এসে। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে একুশে বইমেলার সূচনা হলো। সে বছর থেকে বাংলা একাডেমিতে বড় আকারে বইমেলা শুরু হয়ে আজ তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। মাসব্যাপী চলে প্রাণের এ মেলা। বলা চলে, এই মেলাকে উপলক্ষ করেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প সমৃদ্ধ হচ্ছে। এমনকি এখন প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন নতুন নতুন প্রকাশক এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। দিন দিন পাঠক সংখ্যাও বাড়ছে। মেলা বড় হতে হতে তা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। আর মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মহান একুশের চেতনায় আজও আমরা উজ্জীবিত। সে চেতনার সিঁড়ি বেয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করেছে মহান স্বাধীনতা। সেই একুশ এলেই বইমেলার আয়োজন হয়। শিশুকিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় বইমেলার প্রাঙ্গণ। বইমেলাকে ঘিরে শুধু নতুন নতুন প্রকাশকের জন্মই হচ্ছে না, জন্ম হচ্ছে নতুন নতুন লেখকের। প্রতিবছরই ইতিহাস, শিশুতোষ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস নিয়ে নতুন লেখকরা হাজির হন বইমেলায়। এ বছর ঐতিহ্যবাহী চিলমারীর ইতিহাস নিয়ে সাংবাদিক, প্রভাষক ও লেখক নাজমুল হক পারভেজের রচিত ‘হামার চিলমারী’ নামে একটি নতুন বই বের হয়েছে। বইটি এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’ গানের সঙ্গে গোটা দেশের মানুষই কম-বেশি পরিচিত। সেই গান আর চিলমারীর ঐতিহ্য, ইতিহাস, ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বই প্রকাশেরও প্রয়োজন ছিল। আগে কতজনই না ‘পা-ুলিপি’ লিখে প্রকাশকের অভাবে প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারেননি। এখন কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে হলেও অনেক প্রকাশকই বই প্রকাশ করেন। বইমেলার এই পরিসর আগামী দিনে আরও বিকশিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বছর তো চিলমারীতে প-িত মেলা নামে মিনি বইমেলার আয়োজন করা হলো। এ ধরনের আয়োজন ভবিষ্যতে যে আরও বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

যদিও এখন তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে জানার, বোঝার, জ্ঞানভা-ার অনেক বেশি প্রসারিত। ইন্টারনেটের সুবাদে মোবাইল ফোনে এখন গোটা দুনিয়ার সাহিত্য, সংস্কৃতি, গান, কবিতা, গল্প, খবরাখবর জানা যায়। তবুও মুদ্রিত বইয়ের কদর হারিয়ে যায়নি। বরং তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জানার আগ্রহ যখন বাড়ে, তখন মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করে। বিশেষ করে বইমেলায় শিশু, কিশোর, কিশোরী পাঠকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্ঞানভা-ার সমৃদ্ধের পথে বই এখনো বড় নিয়ামক। যদিও আমাদের দেশে সেভাবে গ্রন্থাগারের বিকাশ ঘটেনি। গ্রন্থাগার থাকলেও নিয়মিত পাঠকের সংখ্যা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বাড়েনি। জ্ঞান বিকাশের জন্য দেশের তৃণমূল পর্যন্ত বই পড়ার চর্চা করতে হবে। লাইব্রেরি করতে হবে। এজন্য সরকারিভাবে উপজেলা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে লাইব্রেরি ভবন নির্মাণ, বইসহ আসবাবপত্র সরবরাহ করে সরকারিভাবে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। এমনকি লাইব্রেরিমুখী করতে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহায়তার সুযোগ সৃষ্টি করলে বই পড়ার আগ্রহও সৃষ্টি হবে। তাহলে পাঠক বাড়বে। শিশু-কিশোররা বিপথগামী না হয়ে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করবে। স্মরণে রাখতে হবে, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি জাতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে না। এ জন্য জ্ঞানভা-ারকেও সমৃদ্ধ করতে হবে। কারণ জ্ঞান মানুষের চিন্তা, চেতনা, মননশীলতার বিকাশ ঘটায়। ফলে এ ধারাকে বিকশিত করে সকলের মধ্যে আগ্রহ ও আস্থার সৃষ্টি করতে হবে। যেন কিশোর তরুণ, যুবকরা বই পড়ায় আকৃষ্ট হয়। তাহলে খুন-খারাবিও কমে আসবে। কারণ সৃজনশীলতাই একটি জাতিকে সভ্য হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

আর বৈশ্বিক মহামারী করোনার ছোবলে গোটা দুনিয়া আজ স্তম্ভিত। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মহামারী যেন নতুনরূপে আবার বাংলাদেশেও আঘাত হেনেছে। এমনিতেই এবছর করোনার কারণে খুবই স্বল্প ও সীমিত পর্যায়ে বিলম্বে বইমেলা শুরু হয়েছে। এ বছর মেলা তেমন জমেনি। কারণ পাঠক, দর্শনার্থী না থাকলে মেলা জমবে কীভাবে? বিকেলে শুরু হয়ে সন্ধ্যার পরপরই মেলা বন্ধ হয়ে যায়। এখন তো লকডাউন শুরু। ইতোমধ্যেই মেলার কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের দুইদিন আগেই। বলতে গেলে বইমেলা এখন অনেকটাই জনশূন্য! তবে এ বছর অনেক প্রকাশকই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বই বিক্রি না হলে তো টাকা উসুল করা সম্ভব হবে না। তবে আমরা মনে করি, সরকার করোনার প্রভাব মোকাবিলায় যেমন শিল্প খাতে নানা সহায়তা দিচ্ছে। সেভাবে প্রকাশক শিল্পকেও সহায়তা দিয়ে টিকে রাখতে হবে। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, লেখার শক্তির নিয়ামক প্রকাশকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েই সমাজকে সমৃদ্ধ করতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই। কারণ শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার বাতিঘর লেখক, কবি, প্রকাশকরা আমাদের সমৃদ্ধির প্রতীক। এ বছরের বইমেলায়ও প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রচুর চাহিদা ছিল। সৃজনশীল ও পাঠকপ্রিয় লেখকের বইয়ের কদর এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আর ফুরিয়ে দেওয়াও যাবে না। এ জন্য বাংলা একাডেমির অবদান অনস্বীকার্য। লেখক, প্রকাশকদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তবে এ বছর তো বইমেলার দুর্দশার শেষ ছিল না। মূলত করোনার কারণে বইমেলায় যানবাহন সংকট, হেঁটে চলাফেরা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ফলে মানুষ কষ্ট করে আর মেলায় আসতে চান না। এর ওপর আবার গত ৪ এপ্রিল কালবৈশাখীর ঝড়ে ল-ভ- হয়েছে বইমেলা। ঝড়ের কবলে প্রচুর পরিমাণ বই ভিজে নষ্ট হয়েছে। ফলে অনেকেই আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মনে হয়, এ বছর বইমেলার দুর্দশার যেন শেষ নেই।

পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, বই হচ্ছে জ্ঞানের ভা-ার। আমরা জানি, যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। তাই বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এখনকার ছেলেমেয়েরা স্মার্টফোন, ফেসবুক, ইউটিউব ও মোবাইল ফোনের নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এদের বইমুখী করতে হবে। কারণ সৃজনশীল, চিন্তাশীল কিছু করতে হলে অবশ্যই জ্ঞান গবেষণা করতে হবে। এ জন্য নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করতে হবে। এ ব্যাপারে আগে পরিবারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুকিশোরদের বই কিনে দিতে হবে এবং বই পড়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ জোগাতে হবে। কারণ পরিবার, সমাজকে ঘিরেই রাষ্ট্র। শুরুটা যেহেতু পরিবারে, সেহেতু পরিবারকেই সচেতন হতে হবে। যে কারণে বাড়িতে লাইব্রেরি করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ লাইব্রেরি বাড়িতে থাকার অর্থই হলো জ্ঞানভা-ারে সমৃদ্ধ পরিবার। অর্থাৎ সভ্যতার প্রতীক যে বই, যা আমাদের দেশের মানুষের কাছেও স্বীকৃত ধারণা। সে ধারণা থেকেই বইকে ভালোবেসে আমাদের পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করতে হবে। কোনোভাবেই বই, জ্ঞানভা-ারের চর্চা ব্যতীত সভ্য জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারব না। এ জন্য বইমেলার গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী দিনে একই সঙ্গে একই সময়ে জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত বইমেলার প্রচলন চালু করতে হবে। কারণ বইয়ের শক্তি বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় থেকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে সাহায্য করবে।

আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা

 
Electronic Paper