বন্ধনে সাম্য মৈত্রী সৌহার্দ্য
কামরুজ্জামান তোতা
🕐 ১০:০৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২১
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতির কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলোÑ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আবহমানকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে বসবাস করে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। রক্তের বন্ধন না থাকলেও একে অন্যের আপদ-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর কৃষ্টি এখানকার মানুষের সহজাত। বিশ্বের অন্য কোথাও এমন সহমর্মিতা লক্ষ করা যায় না। এখানকার বাসিন্দারা নিজেরা সাধারণত প্রতিবেশীর জন্য বিপদ বা সমস্যার কারণ হয় না, বরং একটি পরিবারের মতোই অবস্থান করে ভিন্ন পরিবারের বাসিন্দা হয়েও। সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান এখানে সবসময় বিরাজমান। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে বসবাস করে, কিন্তু সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানের জন্য ধর্ম কখনোই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি।
আর সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে এই চার মূলনীতির কথা আলাদাভাবে রয়েছে। অষ্টম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় এই নীতিসমূহ অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।’
সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধেŸ উঠে নজরুল মানবতাকে স্থান দিয়েছেন সবার উপরে। আজও আমরা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবোধ বিদ্রোহী চেতনায় নিত্য আলোড়িত হই। সাম্য মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নজরুলকে অনুভব করি। জাতের নামে বজ্জাতির কথা নজরুলের মতো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আর কেউ বলতে পারেনি। হিন্দু আর মুসলিম ধর্মে ঐতিহ্যকে কাব্যে আর গানে নজরুল ধরেছেন স্পষ্টভাবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার দীপ্ত শিখায় গোটা বাঙালি জাতিকে জাগাতে চেয়েছিলেন নজরুল। গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান। যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান। তাই তো তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন সাম্যের।
‘বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবান কোন সে জাত
কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ।’
জীবন কখনো সম্পূর্ণভাবে অপরাধ ও অশান্তিমুক্ত হতে পারেনি। যারা পবিত্র ধর্মকে নোংরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায় তারা আর যাই হোক, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। রাজনীতি এক কথায় ক্ষমতার লড়াই তা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র সব অবস্থাতেই। রাজনীতিতে, ছল-চাতুরি, কূটকৌশল, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, অর্থবল, পেশীবল, ও ধর্মীয় বল এসব নানা পন্থা প্রয়োগ করা হয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। তাই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে, ধর্মকে কখনো রাজনীতির ডামাডোলে টেনে আনা উচিত নয়। পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, হিংসা, ছল-চাতুরি, লোভ-লালসা অহমিকা পরিহার করে স্বচ্ছ, সুন্দর, সহনশীল মানব সমাজ গড়ে তুলতে বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে এবং তা প্রতিফলিত হয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনধারায়। আমাদের মনে রাখা উচিত হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত পাওয়ার আগে একজন সৎ ও সুন্দর মানুষ হিসেবে সমাজে সুখ্যাতি অর্জন করেন। আমরা আগে ভালো মানুষ হই, তাহলেই সাচ্চা মুসলমান হতে পারব। আমাদের মনে রাখা উচিত, হজরত মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘ ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত সমাজে আদর্শিক ভালো মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই তাকে আল্লাহ নবুয়ত দান করেন। মুসলমান না হয়েও একজন ভালো মানুষ হতে পারে। আবার মুসলমান হয়েও একজন ভালো মানুষ নাও হতে পারে। তবে ভালো মুসলমান হতে হলে ভালো মানুষ হতেই হবে। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের চেয়ে ভালো মানুষ হওয়া অনেক কঠিন।
সংবিধানের প্রাধান্য এবং উল্লেখ্য- ১. প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। ২. জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।
জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণের ব্যাপারে বলা হয়েছেÑ আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে সংবিধানে। ১. আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে। ক. প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে। খ. প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।
২. কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাহাকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না। আর আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার প্রত্যয় থেকে আমরা কীভাবে সরে এলাম, নিজেদের মানুষ হিসেবে না ভেবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচিত করার প্রবণতা কীভাবে আমাদের পেয়ে বসল সে বিষয়গুলো গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে হবে। বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন তারা তখন এই কথাটা বেশি উচ্চারণ করেন। বাংলাদেশে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষ সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করে থাকে বলে যে দাবি করা হয় তা যথার্থ। এটা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তা দীর্ঘ দিন ধরেই হয়নি বা হয় না। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই। এক সময় হয়তো কিছুটা প্রচ্ছন্ন ছিল, এখন তা প্রকট এবং প্রকাশ্য হয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে তাকে তার ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে বিচার করার প্রবণতা এখন প্রবল। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাথুনি তৈরি করা দরকার ছিল তা পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে চেতনার, তার নাম মানবতা। আজকের পৃথিবীর অন্যতম বড় সমস্যা দেশে দেশে বিরাজমান ধর্মীয় সংকীর্ণতা, ধর্ম নিয়ে জঙ্গিপনা। নিজ নিজ ধর্ম রক্ষার দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মে অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি সমাজে। সব দেশেই এ কাজে বেশি ভূমিকা রাখতে দেখা যায় সমাজপতি বা ধর্মীয় মোড়লদের। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র চেতনার নাম অসাম্প্রদায়িকতা। আজ সমাজের মধ্যে আবার সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নানা ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। জাতির পিতার নেতৃত্বে একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
ড. তরুণ চক্রবর্তী মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ঈশ্বরকে সামনে রেখে মানুষকে পিছনে রাখে। সেটা মসজিদেই হোক আর মন্দিরেই হোক, ঘটনা একই। তিনি মনে করেন, যতদিন পর্যন্ত মানুষকে সামনে রাখা যাবে না, ততদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। ধর্ম-বর্ণের কুৎসিত রাজনীতির কবর রচনা করতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, হয়নি শুধু একটি লাল সবুজ পতাকা এবং একটি ভূখ-ের জন্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আজ ৫০ বছর পরে এই বাংলায় এটি খেয়াল রাখা উচিত যে এই বঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের যে কোনো ধরনের চেষ্টা সাধারণ মানুষরাই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে।
আশা করি, সরকার বর্তমান সহিংসতার চক্র ভেঙে শিগগিরই সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তবে টেকসইভাবে সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর উৎস ও কারণ সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে হবে। অন্যথায় রোগের পরিবর্তে রোগের উপসর্গের চিকিৎসা করা হবে।
সম্প্রীতিহীনতার ফলে সমাজে অস্থিরতা, অনৈক্য ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আর দ্বন্দ্ব থেকেই সূত্রপাত হয় সহিংসতার এবং অব্যাহত সহিংসতা জাতিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
কামরুজ্জামান তোতা : সাংবাদিক; কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ