ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বইমেলা : লেখক, পাঠক ও প্রকাশক

জোবায়ের মিলন
🕐 ৩:৪১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১১, ২০২১

বইমেলা : লেখক, পাঠক ও প্রকাশক

গত বছর যারা বইমেলায় এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসি আসি করে আসতে পারেনি, যারা না আসতে চেয়েও এসেছে বহুবার, যারা বহুবার আসতে চেয়েও আসতে পারেনি শেষপর্যন্ত তারা এবার এসেছে, আবার আসেনি, শেষ অব্ধি আসবে অথবা আসবে না নানাবিধ জটিলতার মধ্যে কিংবা মরণব্যাধির ভয়ে। কিন্তু বইমেলাকে আসতে হয়, বইমেলা এসেছে। মারীকাল, অতিমারীকাল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জাগতিক নানান ঝড় ঠেলে তাকে আসতে হয় তার পাঠকের টানে, আগ্রহে।

এবারও সেই প্রেমেই বইমেলার আগমন। অন্যবারের চেয়ে এবারের মেলার পার্থক্য অনেক। চার দেয়ালের বাঁধ থেকে বইমেলা কয়েক বছর আগে ডানা মেললেও এবার আরও বড় আকাশ, আরও উড়াল। পাখায় যোগ হয়েছে আরও একটু হাওয়া। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেকে প্রশস্ত করে উপস্থাপন। বেশ সুন্দর। বইমেলার ইতিহাস থেকে আজ পর্যন্ত বইমেলাকে ব্যর্থ হতে হয়নি কখনো। এ বছর মারীকালের ছোবল ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। হিসাবের খাতা কিছুটা এলোমেলো করছে। কিন্তু সেই কবে থেকে বলতে শুনছি- বইমেলা চলে না, বইমেলা ম্যাড়মেড়ে, বইমেলা ঠাসাঠাসি, বইমেলা অনুন্নত, বইমেলা গেল গেল! বইমেলা কি আসলে গিয়েছে? বইমেলা কি আসলে আছড়ে পড়েছে? বইমেলা কি আসলে তার স্বরূপ হারিয়েছে? বইমেলা কি বিনাশের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছে? কার কী মত, জানি না। স্বল্প বিচরণ, অভিজ্ঞতা, নিরীক্ষা ও অবলোকনে মনে হয়নি অমর একুশে গ্রন্থমেলা অর্থাৎ আমাদের বইমেলা নির্জীব হচ্ছে বছর বছর। বরং খোলা চোখে দেখলেও বোঝা যায়, বইমেলা সজীব হয়েছে একটু একটু করে। এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবু কথার অন্ত নেই তাদের, যাদের কথাটাই সর্বসম্বল।

সেদিন যখন চিত্তরঞ্জন সাহা খোলা মাঠে বই নিয়ে বসেছিলেন পাঠকের হাতে বই তুলে দিতে, বই তুলে দেওয়ার পথকে মসৃণ করতে; সেদিনও যেমন কথার কমতি হয়নি, নাড়িভূড়ি চটকিয়ে পটকা তোলা হয়েছিল! আজও এতটা বছর পর এসে কথার কমতি হচ্ছে না। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, কথা বলার একটা দল আছে। তারা কারণে কথা বলেন, অকারণে কথা বলেন, সময়ে কথা বলেন, অসময়ে কথা বলেন, যে কোনো কিছুতেই কথা বলেন। জীর্ণ মগজের এই কথা বলুয়াদের আবার ছুড়ে ফেলা দেওয়া যায় না। যাওয়া উচিত নয়। যে কারওরই মত থাকতে পারে, ভিন্নমত থাকতে পারে, দ্বিমতও থাকতে পারে। মতকে ছুড়ে ফেলাও অন্যায় বা অনুচিত। যারা স্বাভাবিকতা থেকে নিজেদেরকে বের করতে পারেন না, যারা বৃত্তের মধ্যে নিজেদের বেঁধে ফেলেন লাভে, লোভে, অজ্ঞতায়, মূর্খতায়, হিংসায় বিদ্বেষে ও অনগ্রসরতায় তারা অগ্রগতিকে চোখে দেখেন নেতিবাচক দৃষ্টিতে। এটি সব জায়গায়, সবসময়। তারা একটি প্রচলিত প্রক্রিয়াকে মনে করেন শ্রেষ্ঠ পথ। পথের পরেও যে পথ আছে, পথিক যে সে পথের চিরঅনুসন্ধানী তা তারা ধরতে ব্যর্থ হন। তারাও একপ্রকার বুদ্ধিজীবী বা বুদ্ধিবিক্রেতা বটে। তাতে কিছু যায় আসে না।
গতিময় পৃথিবীতে পৃথিবী চলছে তার আপন গতিতে। শোকে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় সময়ের আবেদনে চারপাশ পরিবর্তিত হবে, পরিবর্ধিত হবে, পরিমার্জিত হবে এটাই সত্য। আবার দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিকতা। কারও মতে, কথায়, আবেদনে, নিবেদনে, হুমকিতে, ধমকিতে এর পরিবর্তন হয়নি কোনোদিন, হবেও না। যারা ভাবেন আত্মকেন্দ্রিকতায়, তারা আমৃত্যু কোনায় বাস করে এককোণে পার করবেন জীবন। সব চলবে আর-সবের মতোই।

বাংলা একাডেমির মাঠে প্রথম বইমেলার প্রথম দিনটি দেখিনি প্রাকৃতিক নিয়মের কারণে। বইমেলা যখন বাংলা একাডেমির চত্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেরিয়ে আসে ও তার কয়েক বছর আগ থেকে যখন কথা হচ্ছিল এই নিয়ে তখন তরুণ বয়সটি পার করছিলাম বলে দেখেছি, কী অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তি এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে। আশ্চর্য হওয়ার মতো শিশুতোষ মত এসে প্রকাশিত হয়েছিল উচ্চস্বরে। রব উঠেছিল, বইমেলা ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো। বিনাশের পেরেক ঠোকা হলো এর পায়ে। পাঠক, সত্যি করে বলেন তো, ভয় পেয়ে যাননি কি সেদিন? বোদ্ধা বোদ্ধা আলোচকদের আলোচনা আর বড় বড় কলামিস্টদের কলাম পড়ে কি হোঁচট খাননি মনে মনে? পক্ষে বিপক্ষের যুক্তিতে দ্বিধায় কি পড়ে যাননি আপনি? আপনিও কি ঠিক দাঁড়িয়ে যাননি, যে কী বলা উচিত, কী করা উচিত বা আসলে কী হবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এই বইমেলার? জানি, পাঠক মাত্রই সকলের মনে দ্বিধা জেগেছিল। আজকে যদি জানতে চাওয়া হয়Ñ বইমেলার পরিসর বর্ধনে লাভ হলো না ক্ষতি হলো? উত্তরটি পাঠকের কাছে। এবারও কথা হচ্ছে, নানান বিষয় নিয়ে। বিশেষ করে করোনাকালে কী দরকার ছিল মেলার, কী হবে মেলা করে, মেলায় কোনো লাভ হয় নাকি; লকডাউনে কেন বন্ধ হচ্ছে না মেলা? ইত্যাদি। আচ্ছা, বইমেলা যদি খোলা থাকে, বইমেলা যদি চলে তাতে আপনার কী? মেলা কর্তৃপক্ষ, আয়োজক আর প্রকাশকরা যদি মেলা চালিয়ে নেন তবে দোষ কোথায়! যাদের চিন্তা তাদেরই করতে দেওয়া সমীচীন নয় কি?

এবার আসা যাক পাঠকের কথায়। বইমেলার পাঠক বাড়ছে না কমছে? এটা নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করার খুব প্রয়োজন আছে কিনা, জানি না। পাঠকের বৃদ্ধি ও হ্রাস নিয়েও প্রতিবছর শোক-তাপের অভাব হয় না। হায় হায় রবের কমতি হয় না। বিলাপের আওয়াজ পাওয়া যায় সদর রাস্তায়। শুধু বইমেলা চলা সময়ে নয়, সারা বছরই আলোচনাটি বইয়ের দোকানে, লেখক আড্ডায়, প্রকাশনের মেলায়, পাঠক আন্দোলনে গমগম করতে দেখা যায়। এ বছর তার জোর আরও বেশি। আসেন তবে বুকে হাত দিয়ে, দেখেন নিজের সৃষ্টিকর্মের দিকে, চোখ রাখেন যা আপনি রচনা করলেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণসহ নানা আঙ্গিকে; তা আসলে কতটুকু পাঠযোগ্য! আপনি আপনার সৃষ্টিটির দিকে কি একবার মন দিয়ে নয়ন বুলিয়েছেন? আপনি কি আপনার সৃষ্টির দিকে একবার মনোনিবেশ করেছেন? নিজের লেখাটির দিকে সন্তান স্নেহের মতো করে স্নেহ দিয়েছেন? খেয়াল করুন, নাকি আপনি যা সৃষ্টি করলেন তাকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মনে করে গোঁফে তাও দিয়ে লাফাতে লাফাতে পাড়ায় ঢোল বাজিয়ে, দৈনিকের দরজায়, সম্পাদকের সেলফোনে, প্রকাশকের কারখানায় ঢু দিতে দিতে পায়ের জুতো জোড়া ক্ষয় করেছেন অধিক? আপনি যখন যা-ইচ্ছা-তা তৈরি করে পাঠকের হাতে তুলে দিতে চাইছেন বা মোড়কের চাকচিক্যে একপ্রকার প্রতারণা করছেন তখন যখন পাঠক এক পাতা পড়ে যথাস্থানে রেখে অন্য বইয়ের মলাট উল্টাচ্ছে আর আপনি তার গা ঘেঁষে কনভিন্স করার চেষ্টারত তখন কোনো ভাবনা কি আপনার মনে এসেছে? বইমেলায় এমনও দৃশ্য দেখা যায়, একটি বই পাঠকের হাতে, পরিচিতজনের হাতে ধরিয়ে দিতে এক দুই তিন ঘণ্টা তার পিছু পিছু ছুটছেন লেখক! আরও হাজার হাজার উদাহরণ আছে। তবে কেন সন্দেহ প্রকাশ করছেন পাঠক বাড়ছে না কমছে? একজন যোগ্য লেখককে তো কখনো এমন সন্দেহ প্রকাশ করতে দেখা যায় না! একজন পরিশ্রমী পড়ুয়া লেখককে তো এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা করতে শোনা যায় না! যার লেখায় শান আছে, যার লেখায় চমক আছে, যার লেখায় নতুনত্ব আছে তাকে তো কারও পিছু পিছু সময় নষ্ট করতে হয় না! তবে আপনাকে কেন?

নিজের বই না চলা মানেই পাঠক কমছে এমন নয়। আবার নিজের বই চলা মানেও পাঠক বাড়ছে এটাও নয়। মাঠভরা মানুষ মানুষ মানেই বিক্রি ভালো, মাঠ খালি মানেই বিক্রি মন্দা এমনও নয়। বিগত কিছু বছরের সারাংশ একসঙ্গে করলে বিষয়টি নানান দিক থেকে হিসাব কষে সহজেই বলা যায়। এ নিয়ে আহত হওয়ার তেমন কিছু নেই। আনুপাতিক হারে কম বেশি হবে, প্রতিবছর একই রকম হবে না, একই রকম যাবে না- এই সত্যতা মানতেই হবে। পাঠক বাড়ছে না কমছে এই হিসাব সত্যিকার অর্থে মিলাতে হলে বিশদ গবেষণা প্রয়োজন নানান আঙ্গিক থেকে। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে পাঠকের সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর খুব বেশি দুরবস্থা সৃষ্টি হয়নি আমাদের বইমেলায়। বইয়ের পাঠক কখনোই বাণিজ্য মেলার পণ্যের ভোক্তার মতো ছিল না। কখানো হবেও না। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বই পড়তেন, পড়েন, পড়বেন। এই পাঠককে ঠেলেঠুলে সরানো যাবে না। আবার নতুন পাঠক টেনেটুনে আনাও যাবে না। সময়কে নির্ভর করে, পৃথিবীর চলমান গতির সঙ্গে গতি রেখে আপনাআপনি থেকেই বইয়ের পাঠক সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে যতদিন জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রয়োজন থাকবে ততদিন পাঠক থাকবে। ইতিবাচক দৃষ্টিতে এই পাঠক বাড়ানোর পদক্ষেপ রাষ্ট্রকে কৌশলে নিতে হবে, পাঠক কমার কারণগুলো নিয়ে মাঠে কাজ করে এর সমাধান বের করতে হবে। পাঠকের মনে ভয় ধরিয়ে যারা পাঠক নষ্ট করতে অতিউৎসাহী তাদের হিসাবটাও কড়ে গুনে রাখতে হবে, বিদ্বেষের আগুনে যারা ফুঁ দেন তাদের মুখ ভুলে গেলে ক্ষতি বইমেলারই।

আমাদের বইমেলায় বইয়ের মান কি আসলে খুশি করতে পারে পাঠককে? পারলে কতটুকু পারে? আদিকাল থেকে আজ অব্ধি যা শ্রেষ্ঠ, আজ অব্ধি যা ভালো তা আসলে কতটুকু ভালো? তা কি অনশ্বর? ভালোর কি সত্যি সত্যি কোনো অভেদ্য মাপকাঠি আছে? মেলা মানেই মিলনমেলা। মেলা মানেই কিছুটা ছাড়। মেলার নিয়ম যদি হয় স্কুল শিক্ষকের বেতের আগার মতো তা হলে সে মেলার আনন্দটা কোথায় থাকবে বা কোথায় দাঁড়াবে তা এই মুহূর্তে ঠিক চিহ্নিত করা কঠিন। মেলা যেহেতু উন্মুক্ত, মেলা যেহেতু খোলা আকাশের নিচে সেহেতু চেনা অচেনা হাত এসে এখানে করমর্দন করবে, তা আটকানো যে দুরূহ। যদি আটকানো হয় তবে মেলা রস হারাবে নিশ্চিত। এটাই মনে হয়। অন্যের অন্যকিছু মনে হতে পারে। ছোট বেলা থেকে গাঁয়ে গঞ্জে নানান মেলা দেখেছি। মেলায় পণ্য আসে। চারদিক থেকে হরেক প্রকার পসরা নিয়ে বিক্রেতা দু’চার-আনা লাভের আশায় বাঘের মাথায় ছাগলের চুল বসায়, গরুর মাথায় সিংহের কেশর লাগায়, টিনের ছোরায় স্পাশের রঙ মাখে তো প্লাস্টিকে লোহার বরণ! যেহেতু তারা লাভ করতে আসে সেহেতু তারা কৌশল করবেই। শত নিয়ম নীতি থাকলেও তারা তা চাইবে, আড়ালে গোপনে এমন ফন্দি করবে যেন কিছু কামাই আসে। বইমেলাকে এর থেকে তফাতের দেখি না। ওই যে বললাম, এটাই মনে হয়, অন্যের অন্যকিছু মনে হতে পারে। বইমেলায় ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, পচা-গলা, কাঁচা-পাকা, স্বাদু-সুস্বাদু, মান-অমানের সব কিছুই উজ্জ্বল রঙ নিয়ে হাজির হয় দাপটের সঙ্গে। প্রকাশকও জানেন তার দোকানে কোনটা কী। লেখক জানেন কোনটা কী। এক্ষেত্রে পাঠককে জানতে হবে কোনটা কী। নিয়মিত পাঠকরাও জানেন কোনটা কী। আবারও বলি, ওই যে বললাম, মেলায় ভালো-মন্দ, স্বাদু-সুস্বাদু, তেতো-কষ্টি সবই ওঠে; এমনিভাবে বইমেলায় নিয়মিত পাঠক, অনিয়মিত পাঠক, শখের পাঠক, লোকদেখানো পাঠক, অভিনেতা পাঠক, উৎসাহী পাঠক, অতিউৎসাহী পাঠকসহ হরেক রকম পাঠক ভিড় করে। এক্ষেত্রে পাঠককেই যাচাই-বাছাই করে সংগ্রহ করতে হবে কোনটা টিন কোনটা ইস্পাত। শখের পাঠক যদি রঙ দেখে আর ছবি দেখে আর মলাট দেখে আর বাহারি নাম দেখে বই সংগ্রহ করেন আর পাঠ করতে গিয়ে দাঁত ভাঙেন; শেষে অভিযোগ করেন তিনি ঠকেছেন, ইহা মানসম্পন্ন বই না আর সে দায় যদি এসে প্রকাশক বা বইমেলার উপর পড়ে সে দায় কে নেবে?

তবে এও অসত্য নয় যে প্রকাশকের কোনো দায় থাকে না। প্রকাশকেরও দায় থাকে। দায় থাকে লেখকেরও। বইমেলা বা বইয়ের ব্যবসা যেহেতু রুটি-বিস্কুটের ব্যবসা নয় সেহেতু প্রকাশকে নজরে রাখতে হবে তিনি কেমন বই প্রকাশ করছেন। আদতে সে বই পড়ে পাঠক পাঠক কিছু পাবেন কিনা। নাকি অকারণ খরচ বলে আক্ষেপ করবেন। যদি তা-ই হয় তবে প্রকাশককে মনে রাখতে হবে, পাঠককে ঠকানো মানে আগামী দিনে আপনি কয়েকজন ক্রেতা হারালেন। এবং আপনার মতো অন্য প্রকাশকরাও তা-ই হারাল। কেননা, যে শখের পাঠক না জেনে, না চিনে কেবল রঙ দেখে বই কিনে ঠকলেন সে পাঠক আসলে ওই শখের জায়গা থেকেও সরে গেলেন। প্রকাশকের উচিত অপাঠককেও পাঠের কাছে আনার পথ সুগম করা। পাঠকেরও উচিত জেনে-শুনে পাঠযোগ্য বই ক্রয় করা। লেখকেরও উচিত এমন কিছু লেখা যা মানুষ পাঠ করে কিছু-না-কিছু পায়। হোক সে আনন্দ, হোক সে নিখাঁদ জ্ঞান, হোক সে জানা-শোনার নতুন কিছু। আর যাই হোক, লেখক, প্রকাশক, বইমেলা মিলে পাঠকের মনে বিতৃষ্ণা যেন জাগিয়ে দেওয়া না হয়। এর ক্ষতি নির্দিষ্ট কোনো এক-পক্ষের না। এ ক্ষতি হবে সব পক্ষের।

কর্মের পিছনে অকর্মের ছায়া লেগে থাকে আঠার মতো। এই যদি না থাকত তাহলে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ ছবি কেমন হতো তা কল্পনা করা যায় না। তখন হয়তো অন্য কিছু বিষয় উপস্থিত থাকত যা এখন বলা মুশকিল। উপরোক্ত কথায় অনেক কথার ইতিবাচকতা স্পষ্ট। এত কথার, কারণের মধ্যে যে নেতিবাচকতা নেই তা সিনায় হাত রেখে বলা যাবে না। যেহেতু মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ এক নয় সেহেতু কোনো কিছুরই সব দিক ভালো নয়। বইমেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই শুভকর, সুন্দর, মসৃণ এমনটিও নয়। তারপরও এই বইমেলা আমাদের অন্তরের সঙ্গে গেঁথে যাওয়া একটা নাম, উপলক্ষ, উৎসব, আনন্দ, মিলনমেলা। এই বইমেলা মাত্র একটি সত্তা নয়, এটি একটি সামগ্রিক বন্ধন। এখানে এককে বাদ দিয়ে অন্যকে নিয়ে বা অন্যকে নিয়ে এককে বাদ দিয়ে পথ চলার অবকাশ নেই। একটি গোত্রকে যেমন একসঙ্গে চলতে হয়, না হলে ছন্দপতনের মাত্রা বেড়ে দলছুটের সংখ্যা বেড়ে যায় তেমনি বইমেলাকে তার অনুষঙ্গগুলোকে নিয়ে একরেখায় এগুতে হয়। কোনো একটি দিক মলিন হলে সে মলিনতা পুরো বইমেলার উপর এসে ছায়ার মতো পড়ে যা মেলাকেই মলিন করে তোলে। বইমেলার জন্য মাঠ, পরিসর, আকার, আকৃতি, রঙ, ঢঙ বড় কথা নয়, বইমেলার জন্য সবচেয়ে প্রথম ও প্রধান তার পাঠক। পাঠককে এড়িয়ে বইমেলার সার্থকতা শূন্যের ঘরে। আবার বইমেলাকে এড়িয়ে পাঠকের কথা ভাবাও অনেকটা ভিন্নমাত্রিক। কথা উঠতে পারে, যখন বইমেলা ছিল না তখন কি পাঠক ছিল না? তখন কি মানুষ বই পড়ত না? কখন কি প্রকাশনা হতো না? সবই হতো। আজকের মতো হতো না। তাই আজকের সময়ে পাঠকের জন্য বইমেলাও একটি বিরাট অংশ।

প্রকাশককেও এখানে ফেলে দেওয়া সুযোগ নেই। পাঠক আছে, বইমেলা আছে, প্রকাশক যদি না থাকে তবে কী দাঁড়াবে! সবই হয়ত প্রস্তুত, লেখক নেই। তবে কি আর সবের আয়োজন প্রয়োজন আছে? বইমেলা একটি উপলক্ষ মাত্র। বইমেলাকে কেন্দ্র করে এখানে অনেক কিছু ঘটে। বইমেলায় যে লেখক পাঠক প্রকাশকের মেলা এ কথাটিও সত্য নয়। এখানে হাজার হাজার দর্শনার্থীও আসেন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষও ভিড় করেন। কারণে অকারণে তারা মেলায় চষে বেড়ান। আনন্দ ফুর্তি করেন। নিজে যেমন আনন্দ পান তেমনি অন্যকেও সঙ্গতার মাধ্যমে আনন্দ দেন। এই সাধারণ মানুষগুলো যারা পড়ে না, বই কেনে না, বই বিক্রি করে না তাদের কি আপনি ফেলে দিতে পারবেন? এড়িয়ে যেতে পারবেন? তাড়িয়ে দিতে পারবেন? তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবেন? পারবেন না। তাদের অনুপস্থিতিই বলে দেবে আপনি কী ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। তার আগে না বুঝলে, না বুঝতেই পারেন। কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা যায়, বইমেলায় এদেরও প্রয়োজন আছে বিস্তর।
ঝড়-ঝাপ্টা আসবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে প্রাকৃতিক নিয়মে। কাল আকাল তছনছ করে করে দেবে অনেক কিছু; যা আমরা ভাবিনি, ভাবতে পারিনি, কল্পনাও করিনি।

বৈরিতা বদলে দিবে স্বাভাবিকতা, অস্বাভাবিকতা আঁকড়ে ধরবে, তারপরও নানান দিক থেকে নানান স্বার্থের কারণেই প্রাণের এই মেলাকে আগলে রাখতে হবে সন্তানের মতো। অবহেলায়, ছয়-নয় খেলায়, সিদ্ধান্তহীনতায়, অপরিপক্ব বিবেচনায় এর রঙ মøান হলে সে ঋণ হবে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের। বইমেলা যেন শুধু মেলার আবেশেই বন্দি না থাকে সেদিকটি গোচরে রাখতে হবে। যেহেতু এর সঙ্গে আজ ও আগামী প্রজন্মের একটি যোগসূত্র রয়েছে ওতপ্রোতভাবে সেহেতু এর গুণগত মানের সঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত বজায় রাখার দায়িত্বটাও কর্তৃপক্ষের। যারা মেলা দেখভাল করছেন, দেখছেন তাদের দৃষ্টি থেকে যেন মেলার এসব প্রশ্ন হারিয়ে বা এড়িয়ে বা হেলায় পড়ে না যায়।

এই বইমেলা যেন একটি শিক্ষণীয় হয়, এই বছরটিও যেন হয় আয়োজকদের শিক্ষাগ্রহণের। আয়োজকদের খেয়াল রাখতে হবে, এত বড় আয়োজন পাঠকের কথা ভেবে, অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে, প্রকাশকের টিকে থাকার জন্য, ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে লালনের জন্য নাকি এই বইমেলা থেকে কোনো মেসেজ ছুড়ে দেওয়ার জন্য? আয়োজন যা-ই হোক একটি মেসেজ যেন থাকে, মানুষ যেন একটি বার্তা নিয়ে যেতে পারে যা তাদের মন ও মননকে শাণিত করার সক্ষমতা রাখবে। আর তা-ই যদি না হয় প্রজন্মের হাতে কী তুলে দেওয়া হচ্ছে তা বড় প্রশ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াবে। তখন অনুশোচনার ভার বহন করতে না পারলে তার জন্য কেউ দুঃখ প্রকাশ করবে না। মারীকালে বহু মত-দ্বিমতের মধ্য দিয়ে আয়োজিত এই বইমেলা-২১ লাভ হলো, না ক্ষতি হলো? এই জিজ্ঞাসা আসতেই পারে, পারলেও পরের বছরের সুস্থকাল প্রার্থনা করছি। প্রত্যাশা করছি, এ বছরের হতাশাকে কাটিয়ে পরের বছর গুণগত নান্দনিকতায় এ বছরের সমস্ত ত্রুটি আর বিচ্যুতিকে পরিহার করে আয়োজিত হবে বইমেলা। আমাদের কাক্সিক্ষত বইমেলা।

জোবায়ের মিলন : সংবাদকর্মী, কবি ও প্রাবন্ধিক

 
Electronic Paper