করোনা মহামারী জীবনযাত্রার বাস্তবতা
ইমন ইসলাম ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ০৭, ২০২১

করোনাভাইরাস হলো বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। করোনা মহামারী সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনে এনে দিয়েছে স্থবিরতা। মানুষের জীবনে যে চঞ্চলতা, ক্ষিপ্রতা, উৎসাহ, আনন্দ ছিল তার গতি কমিয়ে দিয়েছে। মানুষে মানুষে যে সহানুভূতিশীল মনোভাব, যে আত্মার সম্পর্ক ছিল সেই সম্পর্কে তুলেছে দেয়াল। মানুষের জীবনে এনেছে বিশাল পরিবর্তন ও নেতিবাচকতা। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে মহামারী করোনাভাইরাস। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে মানুষকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। অথচ করোনা মহামারী মানুষে মানুষে ভেদাভেদের সৃষ্টি করেছে। এতে করে সাধারণ মানুষগুলোর জীবনে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যা সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ গঠনে কখনোই কাম্য নয়।
বিশ্ব আজ করোনা রোগে আক্রান্ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের স্বাভাবিক জীবনকে করেছে অস্থিতিশীল। মানুষে মানুষে ভেদাভেদের সৃষ্টি করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে তার প্রভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। নিম্ন আয়ের মানুষরা বিভিন্ন ছোট-খাটো কর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা যাওয়ায় অনেক সাধারণ কর্মজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে পথে বসতে বাধ্য হন। কাজ হারিয়ে অনেকে অনাহারে দিনাতিপাত করতে থাকেন।
কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন অনেকে। কাজ না পাওয়ায় অনেকের আয়, রুজি, রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কাজ না পাওয়ায় অনেক কর্মক্ষম ব্যক্তিরা পরিবারের ভরণপোষণ মেটাতে হিমশিম খেতে শুরু করেন। পরিবারে নেমে আসে ভয়াবহ স্থবিরতা। আর্থিক অনটনে দারিদ্র্যতা বাড়তে থাকে। দেশের ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় লকডাউন থাকায় যানবাহন বন্ধ ছিল। যার প্রতিশ্রুতিতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল দেশের বিভিন্ন শহরে রপ্তানি করতে পারে না। যার দরুন কৃষকরা বড় ধরনের লোকসানে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এদিকে করোনার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদের সৃষ্টি হয়। মানুষ আপনজনকে বিপদে রেখে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনা ঘটেছে যে, সন্তান তার করোনা আক্রান্ত বাবা-মাকে ফেলে জীবন বাঁচাতে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছে। আবার অনেক সমাজে করোনা আক্রান্ত অসহায় মানুষদের ঘরবন্দি করে রেখে দিয়েছে গ্রামবাসী।
করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে অশিক্ষা, অনৈতিক কর্মকা-সহ আরও অসামাজিক কার্যকলাপ। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় উচ্চ শিক্ষায় নেমে এসেছে স্থবিরতা। যার প্রভাবে দেশের উচ্চ শিক্ষায় নেমে এসেছে ধস। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা। এই শিক্ষার্থীরা কেউ টিউশনি করে কেউবা পার্টটাইম কাজ করে পড়াশোনার খরচ জোগাড় এবং অনেকে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে থাকায় শিক্ষার্থীরা যেমন আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন সেইসঙ্গে পড়াশোনায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকার শিক্ষার্থীদের অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিলেও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা ল্যাপটপ ও ব্যয়বহুল ইন্টারনেট সমস্যার কারণে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। আবার স্কুল-কলেজের শিশু শিক্ষার্থীরা অত্যাধিক অনলাইন ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে অনলাইন আসক্তির মারাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দীর্ঘসময় বাড়িতে অবস্থান করায় শিক্ষার্থীরা অবসর সময় কাটাতে অনলাইনকে ব্যবহার করছে। অত্যাধিক পরিমাণে অনলাইন ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ বিঘিœত হচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের মতো বড় ধরনের অপরাধে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। এতে করে সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমান করোনার এই যুগে আমাদের সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাত মেলানো, কোলাকুলি করা ইত্যাদি বাঙালি সংস্কৃতির বিদায়ীভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কোলাকুলি করা, হাত মেলানো থেকে বিরত থাকছেন। আবার মানুষ এখন নিয়মিত মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন। যা সভ্যতার বিবর্তনকেই ইঙ্গিত করছে। করোনা একদিকে যেমন মানুষের মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, সেইসঙ্গে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে আরও স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার, নিয়মিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার।
বর্তমান বিশ্ব আজ করোনা রোগে ভুগছে। এদিকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মানসিক রোগের পাশাপাশি হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি বেড়েছে। করোনার কারণে অনেকে চাকরি হারিয়ে, অনেকে গৃহবন্দি জীবনযাপনে অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। করোনা যুগে সবচেয়ে আলোচিত একটি ঘটনা হলো আত্মহত্যা। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সত্যি এক অদৃশ্য শক্তির কাছে হার মানতে বসেছে আমাদের সমাজ ও বাস্তবতা। সবকিছু মিলিয়ে মহামারী করোনা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথকে করেছে আরও জটিল আরও নিম্নমুখী। তবুও আমরা আশাবাদী করোনা যুদ্ধে আমরা জয় লাভ করব এবং ভাইরাসমুক্ত নতুন একটি সমাজ জীবন গঠন করব। করোনামুক্ত সমাজে আবার নতুন করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সূচনা হবে এটাই আমাদের সবার কামনা।
ইমন ইসলাম : শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়