করোনায় প্রযুক্তির ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অলোক আচার্য
🕐 ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ০৩, ২০২১
কোভিড-১৯ ভাইরাসের তা-বলীলার সঙ্গে যখন পৃথিবীর মানুষ গত বছর প্রথমবারের মতো পরিচিত হয় সেই তখন থেকেই এই ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছিল বিভিন্ন সংস্থা, দেশের কর্তৃপক্ষ। বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে জনগণকে অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত এবং শেষপর্যন্ত বাধ্য করার চেষ্টাও করা হয়েছে। এই মহামারীতে বিশে^র ২১৯ দেশ ও অঞ্চল আক্রান্ত হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষের প্রাণ নিয়েছে এই ভাইরাস। চলতি বছরে এসে আবারো সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের তা-ব শুরু হয়েছে।
প্রতিদিন এই সংখ্যার সঙ্গে নতুন সংখ্যা যোগ হচ্ছে। আমাদের দেশে এরই মধ্যে করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সেই স্বাস্থ্য সচেতনতা বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। যেখানে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে চলতে হবে। স্পর্শ করার আগে জীবাণুমুক্ত হতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা। করোনার নতুন নতুন ধরন চিন্তায় ফেলছে। বারবার ধরন বদলে দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে করোনাভাইরাস। গত বছর করোনা মহামারী শুরু হলে যখন লকডাউনের পথে হাঁটতে শুরু করে সব দেশ তখন প্রযুক্তির প্রয়োজনীতা এবং এর ব্যবহার মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। আমরাও প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি অনুভব করছি। এই শতাব্দীর মূল চালিকাশক্তি হলো প্রযুক্তি। ঘরে বসে সময় কাটাতে আমাদের কোনো সমস্যাই নেই। মোবাইল ফোন, ট্যাব বা কম্পিউটারে গেমস খেলেই দিব্বি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। মানুষকে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিতেও প্রযুক্তির বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণেই করোনায় থেমে থাকা বিশ্ব চলছে।
মানুষের কাজের গতি সচল রয়েছে। পৃথিবীতে গতানুগতিক পদ্ধতি পার করে বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা থেকে শুরু করে কেনাকাটা সবক্ষেত্রেই ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। ডিজিটালাইজেশনের জন্য একদিকে যেমন দ্রুততর হচ্ছে অন্যদিকে নতুন নতুন খাতে কর্মসংস্থান সম্ভব হচ্ছে। আমরা যখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে নিতে পারব না তা মহামারী হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক তখন ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। করোনা আমাদের শিখিয়ে গেছে প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে কীভাবে দেশ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি দিক হলো বর্তমানের বহু জনপ্রিয় ই-কমার্স। এই খাত ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই স্মার্ট ব্যবসায় শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা আসছেন প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে।
সাফল্য পেতে প্রয়োজন ধৈর্য এবং একাগ্রতা, পরিশ্রমী হওয়া।
ই-কমার্স বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে পণ্য কেনা-বেচা করা। কমার্স বা বাণিজ্য যা অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এটা আমাদের গতানুগতিক বাজার এবং ক্রয় বিক্রয়ের ধারণা থেকে ভিন্ন। কারণ এখানে ক্রেতাকে সরাসরি পণ্যটি কেনার জন্য আসতে হয় না। বাইরে বের না হয়ে ঘরে বসে পণ্য কেনার আনন্দই অন্যরকম। আমরা কতটা আধুনিক হচ্ছি তার প্রমাণও এই ই-কমার্স। শহর থেকে শুরু হয়ে এটা এখন গ্রামেও অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণী ই-কমার্সের মাধ্যমে নিজের অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করছে। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই নিজের ব্যবসা দাঁড় করাচ্ছে। এটা অনলাইনে পণ্য কেনা-বেচার একটি আধুনিক মাধ্যম যেখানে অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশের ই-কমার্স ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩০ গুণ। করোনা শুরুর পর বেড়েছে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা। অফিস থেকে শুরু করে পড়াশোনা চলছে অনলাইনে।
এখন করোনার নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মধ্যে এই প্রযুক্তিই মানুষের অন্যতম ভরসা। যেখানে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই কাজকর্ম করা সম্ভব হচ্ছে। এই কাজকর্ম করার মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব ঘরে বসেই পালন করা সম্ভব হবে। সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে। ঘর থেকে বাইরে জরুরি কাজ বা অন্য কাজে আমাদের হাতে প্রায়ই সময় থাকে না। ফলে ঘরে বসেই আজ মানুষ কেনাকাটা করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। তা সে পোশাক-আশাক হোক আর তিনবেলা খাবারই হোক না কেন।
গত বছরের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রতিবেদন মতে, ২০২০ সালের আগস্ট মাসের শেষে দেশে ই-কমার্স বাণিজ্যের বাজার ১৬৬ দশমিক ১৬ বিলিয়ন টাকা। ২০১৬ থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে ই-কমার্স বাজারের আকার ছিল ৮৬ দশমিক ৩২ বিলিয়ন টাকা। ২০১৮ সালের শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ১০৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন টাকা, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষে গিয়ে ই-কমার্সের আকার ছিল ১৩১ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন টাকা। করোনাকালে ই-কমার্স ক্রেতা-বিক্রেতাদের নতুন যুগে পৌঁছে দিয়েছে। অফিস ঘরে বসেই চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। মিটিং হয়েছে। লেনদেন হয়েছে। এগুলো সব প্রযুক্তির অবদান। প্রযুক্তি সাফল্যের ফলেই আমরা আজ এই সুবিধা পাচ্ছি। বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানুষেরই কল্যাণে হয়। মানুষ যদি সেই কল্যাণ ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে শেখে তাহলে এই সভ্যতাকেই বদলে দেওয়া সম্ভব। থেকে যাওয়া জীবনে প্রযুক্তি যে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে করোনার সময়ে মানুষ তা সবচেয়ে বেশি উপলদ্ধি করতে পেরেছে।
বিজ্ঞাননির্ভর এই শতাব্দীর মূল ভিত হলো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে। করোনা মহামারীর কারণে যেখানে একে অপরের থেকে দূরত্বে থাকতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে, ঘর থেকে বের হওয়াই যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করছে সেখানে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার বিকল্প ছিল না। যা আমাদের আরও আগেই করা প্রয়োজন ছিল। আরও দ্রুত প্রযুক্তির সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে হবে। যারা এর ব্যবহার জানে না অথবা প্রযুক্তি বাইরে থাকে তাদের প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে প্রযুক্তিনির্ভর। তাই প্রযুক্তির নানা ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বলা হলেও তা নির্ভর করছে আমাদের ওপর।
করোনার মতো একটি মহামারীর সম্মুখীন না হলে হয়ত আমাদের এই অগ্রগতি এত দ্রুত হত না। কারণ প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। আর এখন অতি প্রয়োজনীয় হওয়ার কারণেই কিন্তু মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হচ্ছে। এটা আমাদের জন্যই ভালো হয়েছে। এখন আমরা আরও দ্রুত প্রযুক্তির সুফল সব স্থানে পৌঁছে দিতে পারব। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, অফিস সবকিছু চালিয়ে নিতে সক্ষম হব।
প্রযুক্তির ব্যবহারে যত বেশি মানুষকে দক্ষ করে তোলা সম্ভব হবে এবং প্রযুক্তি যত বেশি সংখ্যক ও দ্রুত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যাবে তত বেশি সাফল্য আসবে। করোনায় এখনো বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু লেখাপড়ার সুবিধা দেওয়ার জন্য অনলাইনে ক্লাস বা টিভি রেডিওতে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এটা হতে পারে একেবারেই প্রথমে এই কাজে সবার মনোযোগ আনা সম্ভব হয়নি বা নানা কারণে এখনো সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই যে প্রযুক্তি সুবিধা কাজে লাগিয়ে একটি কাজ শুরু করেছি ভবিষ্যতে যদি এরকম কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন এই প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে আরও দক্ষভাবে তা কাজে লাগানো সম্ভব হবে। করোনা মহামারী আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। আর সেই ভবিষ্যৎ হবে প্রযুক্তি নির্ভর ভবিষ্যত।
অলোক আচার্য : কলাম লেখক, পাবনা