কবিতা লেখার প্রান্তিক যোগ্যতা
দ্বীপ সরকার
🕐 ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ০২, ২০২১
কবিতার রাজাধিরাজ ও কবিদের কবি জীবনানন্দ দাশ যেভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’। মূলত এখান থেকেই আমার কথা শুরু। কবিতা লেখার ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়টা আমরা কেউ এড়াতে পারি না। প্রান্তিক শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সকলের জানা। যার অর্থ শেষ বা সীমা বা শেষ স্তর। কবিতা লেখার ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়বস্তু এখানে মূল উপজীব্য বিষয়। কবি অভিধা পেতে গেলে তারও প্রান্তিক যোগ্যতা থাকা দরকার।
কবিতা লেখার আবার যোগ্যতা লাগে নাকি? অথবা কবিতা লেখার অভিজ্ঞতা? এমন প্রশ্ন করলে শত শত কবি দা-কুড়াল নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন আমাকে ঘায়েল করতে। তবে একটা সৎ সাহস তো আছেই। আমার গুরুজি অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশ সকলকেই কবি বলে মানতে নারাজ। কেন নারাজ সেটা তো ধ্রুবতারার মতো স্পষ্ট। দুদিন কবিতা লিখে কবি বনে যাওয়া আমাদের দেশে অনাকাক্সিক্ষত বিষয় নয়। যেহেতু নাম ধরে বললে আমার ঝুঁকি আছে তো আপাতত ওটা থাকুক। অস্বীকার তো করতে পারি না। দুদিন শখের বসে লিখল। বেচারা চাকরি করেন উচ্চমার্গীয়। কবিতা যখন মেইল করেন তখন নিচে লেখা থাকে তার পদ-পদবি।
সঙ্গত কারণে বিভাগীয় সম্পাদকগণ নাজেহাল হয়ে পড়েন তার পদ-পদবি দেখে। ধুত্তরি, চলে যাক। এই ভেবে পত্রিকায় ছেপে দিলেন। পাঠকগণ পরের দিন সকালে ঠোঁটে চা তুলে রীতিমতো আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এটা কী হলো। এই লেখা পত্রিকায় আসে কীভাবে। কবিতার জাতকুলও গেল, পত্রিকারও গেল। কিন্তু উপায় নেই। বড় চাকরি, সরকারি কর্মকর্তা। অথবা বেসরকারি কোনো অফিসার। যাদের সঙ্গে সম্পাদক বা বিভাগীয় সম্পাদকদের স্বার্থও জড়িত থাকতে পারে। এছাড়া যে সব অল্প বয়সী আনকোরা সাহিত্য সম্পাদকগণ চাকরি করেন, তাদের চাকরি থাকে না কবিতা না ছাপলে। ফোনে ও-রকম দামি মানুষগুলো ঝাড়ি মারলে দশবার স্যার স্যার বলতে হয়। মুখে জল নিতে হয়। বুকটা ধুকপুক করে। তো কবিতা যা-ই হোক চলে যাক। পাঠকরা মলা মাছও চেনে না এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক নয়।
প্রান্তিক যোগ্যতার কথা বললে শেষমেষ আমাকেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। তো যাই হোক। কবিতা যদি কবিতা না হয়- টবিতা কিসিমের হয়ে থাকে সেটা নিয়ে পাঠক কথা বলবেই। পত্রিকা নিয়ে কথা বলবে। সম্পাদককে গালমন্দ করতেও ছাড়বে না। এটাই উচিত কথা। দেশে যেভাবে দুর্নীতি, ঘুষ বেড়ে গেছে তাতে সাহিত্যের গায়ে যে এর কু-টা পড়বে না, এমন নিশ্চিত কথা বলা মুশকিল। শিখে এসে কবি হওয়া সময়ের ব্যাপার। বড় চাকরি থেকেও যদি দশ বা বিশ বছর ধরে কলম টিপে কবিতা শিখতে হয় তো এমন অভিধা পেতে তো পঞ্চাশ বছর লেগে যাবে। এমন চিন্তা চেতনার লোক কবিতার ইজ্জত খাচ্ছে। এভাবে যেন সব ভুলের আর কু আস্তরণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কবিতা নামক খুব গুরত্বপূর্ণ একটা সাহিত্য।
আমরা জানি, কবিতা দিনে দিনে শেখা ও জানার বিষয়। এমন কি ঐশ্বরিক ইশারা যার ভিতর নেই সে কবিতা লিখতে পারে না। জোর করে কবি হওয়া যায় না। এদেশে চুরি করে কবি হওয়ার বদনামও আছে। তো এমনতর কবিগণ প্রান্তিক যোগ্যতার কথা শুনলে দশবার হেঁচকি খাবেন। গায়ে জ্বর অনুভব করবেন। শরীরটা অবশ অবশ লাগবে। অথচ দাবি করেন কবি। কবিসত্তার পিছনে কবিতা লেখার ন্যূনতম যোগ্যতা যদি না থাকে আর যদি সেটাকে গলাধঃকরণ করে নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে, ফোনে ঝাড়ি মেরে কবি হই, তবে এ জাতি বেশি দিন কবিতার স্বাদ আর পাবে না। ওই টবিতার স্বাদ নিয়ে, মুখরোচক ভেবে খেতে হবে।
প্রান্তিক যোগ্যতার কিছু শর্ত থাকা বাঞ্চনীয়। কবিতার আধুনিকীকরণ, আধুনিকতার মোড়কে আঁটসাঁট করে কবিতাকে বাঁধতে না পারলে এ সব যোগ্যতার বালাই থাকে না। কবিতা কী? কবিতা কেন লিখি? কবিতার শরীর বন্ধনীর কৌশল- মূলত প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনের জন্য এটুকু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা খুবই জরুরি।
দুই.
বর্তমান কবিদের কবিতায় বসন্তবন্দনা। বসন্তকে নিয়ে দু’কলম লেখেনি এমন কবি, লেখক নেই বললেই চলে। বিশেষ করে কবিতায় বহুভাবে এর প্রভাব বিরাজমান। কথা সেটা নয় বরং আমার এই আলোচনায় বর্তমান সময়ে যারা কবিতা নিয়ে কাজ করছেন বিশেষ করে তাদের নিয়ে কথা বলব। তারা বসন্তকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এই বসন্তঋতু কীভাবে আন্দোলিত করেছে। ইতোপূর্বে আমরা প্রবীণদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বসন্তের নানান রূপবৈচিত্র্যের বর্ণনা দেখেছি। এই মহাকালে বসন্তের গুণগান গাওয়া বহু প্রবীণের বসন্তবন্দনার গীত আমরা শুনেছি। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্য যুগ এবং রেনেসাঁর যুগসহ নানান দশক বিবেচনায় বহু পণ্ডিত, কবি, গবেষক বসন্তকে নিয়ে বহু গবেষণার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন- তা আমরা মরমে মরমে জ্ঞাত। কিন্ত আমার এহেন চেষ্টা এর বিপরীত। আমি চেয়েছি শূন্য দশকের এবং বর্তমান সময়ের নবীন কবিরা বসন্তকে কীভাবে দেখছে তা বুঝতে। তাদের জ্ঞানের পরিসীমা এবং এমন সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা কবিসত্তা দিয়ে কেমন করে এর রূপবৈচিত্র্যকে চিত্রায়িত করছেন। চেনাজানা এবং সমসাময়িক কয়েকজন কবির চিন্তার প্রকাশ কেমন তা এখানে ক্রমান্বয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করব। বসন্ত মূলত শীতের জরাগ্রস্ত, শীতের সীমাহীন কষ্ট, শারীরিকভাবে সংকোচন ও ক্লেদাক্ত থেকে বেরিয়ে এসে একটু একটু করে উষ্ণতা ছড়ানো একটা ঋতু। আমরা জানি, শীতের কতখানি জীবন বৈপরীত্ব যাতনা। সূর্য ওঠেনি কোনো কোনো দিন। কোঁকড়ানো শরীর নিয়ে শ্রমজীবী মানুষ চলেছে মাঠে। এর থেকে বেরিয়ে এসে শরীরে উষ্ণতার আমেজ ঘটানোর চিরাচরিত নিয়ম এবং এই লক্ষ্যে যে পরিবর্তন ঘটে সেটাই ফাগুন বা বসন্ত ঋতু। এ মাসের জন্য সারা প্রাণীজগৎ ও প্রকৃতি মুখিয়ে থাকে। কবি বলেছেন এভাবে-
কে আসে দুর্বহ যাপিত জীবন শেষে
নীলাভ স্বপ্ন ছিঁড়ে বসন্ত দিবসে
(ভুল পাখি বসন্ত দিবসে- রাহমান ওয়াহিদ)
বসন্ত এলে জীববৈচিত্র্যের কতভাবে পরিবর্তন যে আমরা দেখি তার ইয়ত্তা নেই। গাছপালা বৃক্ষলতার শাখে শাখে যখন নতুন পাতা গজায় এবং পুরাতন পাতাগুলো মর্মর গুঞ্জনে মুখরিত হয় সারা ফুলবাগান আর অরণ্যে, তখন কবিরা বুঝতে পারে প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে। খোঁপায় মালা গেঁথে যুবতীরা যখন দল বেঁধে ফাগুন হাওয়ায় ফুল কুড়োয় তখন সকলে বুঝতে পারি বসন্ত এসে গেছে। নারী সৌন্দর্যের সফল বৈচিত্র্য এনেছে কবি গাফফার মাহমুদ।
বসন্ত বাতাসে আঁচড়ে পড়ছে তোমার চুল
লিপ লাইনারে তোমাকে খুব লাগছে এ বেলা
(আলিঙ্গন- গাফফার মাহমুদ)
রওশন রুবী বসন্তকে টেনে এনেছেন তার মেধা মননের গভীর থেকে। তিনি বসন্তকে জীবনের কাছাকাছি থেকে উপভোগ করেছেন যা কবিতায় তুলে এনেছেন এভাবে-
ধুলো আর ঝরাপাতা, চাতকের পৌঢ় অপেক্ষা
পড়ে থাকা সাপ্তাহিক দিন
কুড়িয়ে এনে নিন্দুকের কড়াতে দেই শান
আহা! গুলশানে চলছে অবিচল কালের ট্রেন
এ সফর জানে মুগ্ধতা সবটুকু ঘোরের মায়া
তারপরও মুগ্ধ চোখে উৎসর্গ হোক বসন্তবিলাস।
(বসন্ত পারাপার- রওশন রুবী)
এই ধূসর বসন্ত স্মৃতিমুখর দিনগুলোকে জীবনের নিকটে টেনে আনতে পারে সহজে। প্রেম বিরহ যাতনাকে এক কঠিন সত্যে এবং ভুলে যাওয়াকে কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করেছেন রিপন আহসান ঋতু। তিনিও বেশ জোরেশোরে বলেছেন-
বসন্ত এসে গেলে স্মৃতির হারিয়ে যাওয়া
মুখগুলো সত্য হয়ে ওঠে, বাকি সব মিথ্যা হয়ে যায়।
(বসন্ত বিলাপ- রিপন আহসান ঋতু)
প্রকৃতিতে ষড়ঋতু যায় আসে। মানুষ তার থেকে বসন্তকে যেভাবে গ্রহণ করতে শেখে বাকিগুলো সে রকম হয়ে ওঠে না। এভাবে ঋতুর পরিবর্তন ঘটে। এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন কবি হাসান ওয়াহিদ। তিনি বলেছেন-
তথাপি পথ ধরে বসন্ত ছোটে উন্মাদের মতো
গ্রীষ্মের দিকে
(বসন্ত- হাসান ওয়াহিদ)
এখানে বসন্তের পর গ্রীষ্মেও যে উন্মাদ আগমন সেই সুর বেজে উঠেছে। ঋতুর চিরাচরিত পরিবর্তন এভাবেই ঘটে।
আমার আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য নবীন কবিদের ধ্যানধারণায় বসন্তবন্দনার ইঙ্গিত তুলে ধরা। আমরা নবীন। নতুন বলেই এতটা পরিসীমিত অভিজ্ঞতার কতটুকু প্রয়োগ হয়েছে আমাদের লেখায় তা পাঠককুল অবশ্যই বিবেচনা করবেন।
দ্বীপ সরকার : কবি ও প্রাবন্ধিক, বগুড়া