ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সমাজ উন্নয়নে ড. হোসনে আরা

এম. জুবায়ের হোসেন
🕐 ১২:১৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৮, ২০২১

সমাজ উন্নয়নে ড. হোসনে আরা

সমাজে প্রতিটি মানুষের গল্প আলাদা। কারও সঙ্গে কারও গল্পের মিল নেই। তেমনি একজন ড. হোসনে আরা বেগম। তার জীবনের প্রতিটি ঘটনাই ব্যতিক্রম। সমাজকর্মী, অধ্যাপক, উন্নয়নকর্মী ও উদ্যোক্তা ইত্যাদি সৃজনশীল বিশেষণ তার নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থী হিসেবে খুবই মেধাবী। তিনি স্বপ্নবাজ ও সংগ্রামী নারী হিসেবে সুপরিচিত। স্বপ্ন দেখে ও দেখিয়ে নারী উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দেশে-বিদেশে। শুধু নারী উন্নয়ন আর দারিদ্র্য বিমোচনই নয়, তার বিরল অভিজ্ঞতা রয়েছে পুরুষ আর নারী উভয় জীবনেরই। 

জন্মেছিলেন পুরুষ হয়ে; বর্তমানে তিনি একজন সফল নারী এবং বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও ‘টিএমএসএস’-এর সফল নির্বাহী পরিচালক। বগুড়ায় ১৯৫৩ সালে বাবা সোলায়মান আলী ও মা জোবাইদা বেগমের ঘর আলোকিত করে দুনিয়ায় আসেন আব্দুস সামাদ। নিজ জেলা বগুড়া থেকেই তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়া শেষ করেন। তেইশ বছর বয়সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানি বিভাগে পড়ার সময় পেটে টিউমারের সূত্র ধরে ছেলে আবদুস সামাদ থেকে মেয়ে হোসনে আরা বেগম হওয়ার পরিবর্তন ঘটে। মেয়ে হওয়ার পরই তিনি বুঝতে পারেন নারী জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, নিরাপত্তাহীনতা ও অধিকারহীনতার কথা।

সেই সূত্রেই ১৯৮০ সালে তিনি বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে ৫০০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন ‘টিএমএসএস’ বা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ যা পূর্বে ‘টিএসএস’ নামে ছিল। এ সংঘের পক্ষ থেকে ‘পরিবারই হোক নারীর উন্নয়নের কেন্দ্রস্থল’ স্লোগানকে সামনে রেখে নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১২৬ জন ফকিরের ২০৬ মণ মুষ্টি চাল নিয়ে তিনি নারী উন্নয়নের স্বপ্ন ও সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। খিচুড়ি খাইয়ে তিনি ফকিরদের একসঙ্গে করে তাদের উন্নয়ন আর ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন মনে বুনে দিতেন। নিজের ও তার সদস্যদের স্বপ্ন, ইচ্ছা, উদ্যোগ ও সংগ্রাম সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এই ফকিরদের মুষ্টি চাল থেকে আজকের টিএমএসএস প্রায় ২৫,০০০ হাজার কোটি টাকার মালিক। জয় করেছে দরিদ্রতাকে। সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে হাজার-হাজার মানুষের জন্য কর্মসংস্থান। আত্মমর্যাদা নিয়ে সমাজে বাস করার মন্ত্র শেখানো হয়েছে নারীদের। বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় এর কার্যক্রম এবং ৮৮টি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে।

বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি কর্মরত আছে প্রায় ৩৫,০০০ নারী। সারা দেশে ছোট-বড় ১ লক্ষ ১২ হাজার সমিতি রয়েছে ‘টিএমএসএস’-এর আওতায়। তাছাড়াও নিজস্ব মালিকানায় রয়েছে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, ডিপ্লোমা মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিকেল ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম, গরিব রোগীদের জন্য রয়েছে চিকিৎসা সেবা হাসপাতাল, সিএনজি স্টেশন, বগুড়ায় পাঁচ তারকা হোটেল ও কক্সবাজারে রিসোর্টসহ নিজস্ব হেলিকপ্টারও রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬৪ জেলায় প্রায় ৫৩ লক্ষ পরিবারকে এ প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

ড. হোসনে আরা বেগমের ইচ্ছা আমৃত্যু দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উন্নয়ন, গরিব-দুঃখী ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাবেন। বন্যা, করোনাসহ সকল ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তিনি গরিব-দুঃখী ও মেহনতি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি মনে করেন, ‘দেশকে উন্নত করতে হলে নারী জাতিকে সমস্ত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। নারীর উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন অর্ধেক বাকি থেকে যাবে।’

হোসনে আরা বেগমের সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতা অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই ধরা পড়ে। ওই সময়ে তিনি বালক থাকা অবস্থায় কৃষি ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য গঠন করেন ‘বয়েজ ক্লাব’। ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে জমি চাষাবাদ করতেন। হালচাষ করার জন্য গরু না পাওয়া গেলে নিজেরাই নেমে পড়তেন কোদাল নিয়ে। ছোটকাল থেকেই সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে ‘টিএমএসএস’ গঠনের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া হাজার হাজার নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরি দিয়েছেন তিনি। উদ্যোক্তা হতে চাইলে তিনি ‘টিএমএসএস’ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পযর্ন্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করেন। স্বপ্ন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বগুড়াসহ সারা দেশে সুখী পরিবার গঠনের স্বপ্ন দেখছে ও কাজ করে যাচ্ছে তার সংগঠনের কর্মীরা। দারিদ্রতা, নারী উন্নয়ন, রোগ-ব্যাধিসচেতনতা, নিরক্ষরতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মূল সংগ্রাম। তিনি বিশেষ করে কাজ করে যাচ্ছেন নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য। দেশের উন্নয়নের জন্য তার একটি বিশেষ গুণÑ নিয়মিত ধার্যকৃত কর ও ভ্যাট প্রদান করেন সরকারকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ডিএফআইডি, নেদারল্যান্ড সরকার ও আমেরিকাসহ অনেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা তার ‘টিএমএসএস’কে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

তিনি মানুষকে অনেক ভালোবাসেন। দল-বল, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য তার এক অসীম হৃদয় রয়েছে। এ মহিয়সীর বিশেষ দুর্বলতার নাম নারী। কথিত আছে, কোনো নারীই তার কাছে চাকরি চেয়ে খালি হাতে ফেরত যাননি এবং একসময় যাদের কিছুই ছিল না, তারাও তার পথে হেঁটে এখন খেয়ে-পরে অনেক ভালো আছেন। তার স্বপ্ন আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নারীর অধিকার ও আত্মমর্যাদা নিশ্চিত করার। ইতোমধ্যেই তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান অশোকা ফেলোশিপ ও বেগম রোকেয়া পদকসহ দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। সরকার ও সুশীল সমাজের সহযোগিতা পেলে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেতে পারেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই সৃষ্টিশীল মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা।

এম. জুবায়ের হোসেন : শিক্ষক ও গবেষক, ঢাকা
[email protected]

 
Electronic Paper