ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কবিতা ও প্রেমপুঞ্জি

হাসনাত মোবারক
🕐 ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ০৫, ২০২১

কবিতা ও প্রেমপুঞ্জি

স্বাস্থ্যবতী রমণীর শরীর-সৌরভে মিশিয়েছি প্রেম। একবার নয় বহুবার ডুবে ডুবে ভুশ করে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছি। কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও তাই। আমার দম কম। তবে প্রেমের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রমণীর প্রেম আর কবিতার বিভ্রান্তির ঘোরে মধ্যাহ্নে এসে দাঁড়িয়েছি। জীবনে মাত্র কয়টা কবিতাই তো লিখেছি। এর চেয়ে বেশিবার প্রেমে পড়েছি। প্রেম আমার মুদ্রাগত দোষ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। মন্থনে যেমন ঘি ওঠে, তেমনি অধিক প্রেমে প্রেমে প্রেয়সীরা দূরে সরে গেছে।

তবুও কবিতা যাপনের মতোই রমণীর প্রেমকে যাপন করে যাচ্ছি। শাদাপাতের ধারাপাতে কালো কালিতে আক্ষেপটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। এজন্য কবি মহলে কবি হিসেবেও পরিচিত নই। আবার প্রেমিক হিসেবেও সফল নই। এর মানে এই নয়, আমি কবি ও প্রেমিক কোনোটাই নই। এই যেমন ধরুন, এই লেখাটি যখন লিখছি, বসেছি লিখতে। প্রথমে কাগজে-কলমে লিখি। লিখতে লিখতে কাটা-ছেঁড়া করতে করতে একটা সময় গিয়ে লেখাটি লেখা হয়ে উঠবে। তেমনি আমার প্রেমকাতরতার কথকতা কাটা-ছাঁটা শেষে জীবনে একটা কবিতা লিখে উঠতে পারব! তখন হয়ত বলা যাবে অধিক প্রেমের চেয়ে একটি খাঁটি কবিতাই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রেমকে কবিতার বিপণন সহায়ক মনে করি। প্রেমের ঘোরেই আমরা কবিতা লিখি। অন্যের কবিতা মুখে আওড়াই। প্রেম নিবেদনের সময় কবিতা মুখস্থ বলি। আবার গদ্যেকে স্মার্ট করতে বেশি বেশি কবিতা পড়ি। তাই কবিতা লেখার জন্য কবিতাকে আরাধ্য মনে করি। যেমন জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, কবিতা কী? কবিতা অনেক রকম! হ্যাঁ। এরচেয়ে বেশি রকম রমণীর মন। একেক পাত্রে একেক রূপ ধারণ করে। কবিতা যেমন পুরোপুরি আবিষ্কারের বিষয় নয়, সম্ভবও নয়। তেমনি নারীর মন তো আরও অধরা। নারীদের সম্পর্কে এমন করে লিখছি! না। সমস্ত নারীকে নিয়ে নয়। আমার শিল্পজীবনের উপজীব্য রমণীদেরই নিয়ে লিখছি। কেন লিখছি? আমার লেখাজোকা সেসব রমণীর পড়ার সম্ভবনা কম। আর দু’একজন সুন্দরীতমা আমার লেখাজোকা দেখবে। তখন তার বা তাদের পরিপাটি আঙুলের ফাঁক গলে আমার আধভাঙা অক্ষরগুলো উড়ে যাবে। গোলাপবাগানের প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াবে আমার লেখা। ভাবতেও ভালো লাগছে। পৃষ্ঠা ওল্টাতে-ওল্টাতে বলবে, ‘বেচারা!’ খানিকটা হাসবে। মনে মনে অনেক কিছুই ভাববে। কীভাবে কতগুলো সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছি আমি। কবিতা যাপনের জীবন বড় কষ্টের। পুরোই শিল্পজীবন মানেই কষ্টের। ফরাসি শিল্পী রেনোয়া যেমনটি বলেছিলেন, ‘সব যন্ত্রণা এক সময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শিল্প থাকে।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের জীবনে যেমন জুটেছিল শিল্পমানস ফরাসি প্রেমিকা মার্গারিট মাতিউ। এমনটা কয়জনের ভাগ্যেই জোটে।

তবে এটা সত্য বলে মানি। নারীর মোহনীয় রূপ শিল্পজীবনের প্রেরণা। এই প্রেরণার কামনায় বিভোর থেকেছি। তরী ভিড়িয়েছি রমণীর আঁচলের তলায়। শুধু কবিতার জন্য যে নারীর কামনা করি, তা কিন্তু নয়। এর চেয়ে বেশিটুকু হতেও তো পারে। হয়নি। সেই অর্থে বলা যায় আমার জীবন সঙ্গ-নিঃসঙ্গতার এক ককপিট। যে যেভাবে পেরেছে। ব্যবহার করে চলছে। আমিও উজাড় করে দিচ্ছি। নারীদের প্রতি উদারতার কথা প্রকাশ করায় ভবিষতে নারীসঙ্গ বঞ্চিত হব! তাই তো। হ্যাঁ এই কথাটুকু লিখতে আঙুল যে কাঁপছে।

কোনো এক রমণীর প্রতি আমার কমিটমেন্ট চলছিল। এমনটা আর কী। একটা সময় গিয়ে সে বলল, দেখো তাকে যা কিছু দিচ্ছি। এমনকি তাকে যে চুমুকুকু দেব সেটাও যেন ফেরত না চাই কখনো। আমার ওই প্রেমিকাবন্ধু যা বোঝাতে চেয়েছে, মানুষকে যা কিছু দেওয়া হোক, সেটা উজাড় করেই দেওয়া দরকার। পেছনে ফিরে এসে কষ্ট পাওয়া। স্মৃতি বড় দুঃসহ বেদনার খতিয়ান। ওট্্্্াই টুকে টুকেই তো লেখক সাহিত্যিকরা বেঁচে আছে। স্মৃতির কাছে আশ্রয় খুঁজতে হয়। গ্রামের জলকাদা মেখে মফস্বল শহরের কলেজে যেদিন প্রথম এসেছিলাম। সেই মাহমুদা আক্তার ইমু। যে কলেজের পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এত বড় পুকুর কখনই দেখেনি। ইমু বালিকা নয়, তরুণীই বটে। শরীরের স্বাস্থ্যে সে আমাদের চেয়ে বাড়ন্ত। বড় দেখাত। ঢাকা শহরে বড় হয়েছে। আমাদের ওই উপজেলার দারোগার ভাগনি সে। ওর সঙ্গে মিশতে ভয় পেত কলেজের অন্য ছেলেরা। মানে আমার চেয়ে বয়সে যারা একটু বড়।

তাদের তো উচিত ছিল, ওই সুন্দরীতমার টেক কেয়ার করা। তাদের মনে বুঝি ভয়ই ছিল। তাছাড়া টোলপড়া তরুণী ইমু আমার বন্ধু হয় কী করে। সে আমার কলেজের প্রথম বন্ধু। কলেজের রাস্তা ধরে যখন হাঁটতাম। কাজের ছেলেমেয়েরা আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। ওর এক্সপ্রেশন ভোলার নয়। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলত। আমি কিছুই বলতাম না। মানে বলতে পারতাম না। ও যে সুন্দরী, স্মার্ট! না। সে সব মনেই করতাম না। তখন চোখে-মুখে স্বপ্ন দেখার ব্যারাম ছিল। তাই খাতার ভেতর চ্যাপ্টা গোলাপ ফুঁ দিয়ে উড়ে দিতাম। কলেজের দু’বছরের সমাপ্তি টেনে আসার পরও ইমু কখনোসখনো মামার মুঠোফোনে কল দিয়ে কথা বলত। এই যে কত শত স্মৃতি। ওরা বালিকা থেকে হয়েছে তরুণী। এরপর রমণী। এরপর কেউ কেউ কয়েক বাচ্চার মা। ফাহমিদা বিনতে বাতেন ওরফে লিমার সঙ্গে পরিচয় হলো। ওই শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালীর মেয়ে। লিমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো। জানি না, কেন যেন সুন্দরী মেয়েগুলো দল বেঁেধ আমাকে ঘিরে থাকত। ছেলেবন্ধুরা হিংসায় পুড়ে যেত। এর পর অনেক অনেক বছর পর। শ্যামলীপাড়া স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। লিমার কেশকুন্তল ভেদ করে আছে ঝকঝকে কাচের চশমার সোনালি ডাট। বেশ পুরানো কায়দায়। ওকে চিনি। বাসস্ট্যান্ডের সমস্ত নাগরিককে অবাক করে দিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেবে। যা ভাবছিলাম তা হয়নি সেদিন। সে আমাকে চিনতে যায়নি। আমিও বেশিটুকু আশা করিনি।

এরপর আসি অনার্স কলেজের নারী বন্ধুর তালিকায়। দলছুট হয়ে অনার্সে ভর্তি হই। কাকতালীয়ভাবে প্রথমদিনেই সেই সময়ের সবচেয়ে চটপটে স্মার্ট মেধাবী এক তরুণীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। এরপর আরও অনেক অনেক বছর কেটে যাচ্ছিল। কলেজের কোনো মেয়েদের সঙ্গে আমার তেমন ভাব বিনিময় হচ্ছিল না। কেন! সূত্র খুঁজতে গিয়ে দেখি ওই মেয়েগুলোর কেউ আদতে কোনোদিন স্বপ্ন দেখেনি। কেউই ওদেরকে ফরাসি চিত্রকলার গল্পও শোনায়নি। কী এক মুসিবতের সময়। ওই কলেজের বেশিরভাগ মেয়ে পড়তে আসত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়ে গ্রামে ফিরে যেতে। আমার তো ঘর নেই। ফিরে যাওয়ার তাড়াও নাই। এ শহর ছেড়ে রাজধানী পেরিয়ে মহাকাশের স্বপ্ন দেখতাম। এখনো দেখি। এরপর সময় চলে যায়। একটা বিক্ষিপ্ত সময় পেরিয়ে যায়। শুরু হলো অভিজাত এলাকায় আমার গতায়াত। শুচি আপা। সেও কলেজপড়–য়া। আমার জুনিয়র। ওর ভাইকে পড়াতে গিয়ে পরিচয়। সবার বড় শুচি আপা। আমিও শুচিকে, শুচি আপা ভাবতাম। দেখা হত। কথা বলতাম না। তবে কথা সেদিনই হয়েছিল। অনেকদিন পর...। কেমনে কেমনে যেন আমার সম্পর্কে শুচি আপা জেনে গেল। তত সময়ে ওর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দুজনের আলাপ হলো। অনেক কথা। দেখি ওর চোখে-মুখে আক্ষেপ ফুটে উঠছে ততসময়ে। আগে জানতাম, ছোট মায়ের প্রতি সে মহাবিরক্ত। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ওর সঙ্গে আগে কেন কথা হয়নি এটা মুখে না বললেও চোখ বুঝিয়ে দিচ্ছিল। কেন এত নীরব ছিলাম এতকাল। তাহলে হয়ত প্রেমটা হতে পারত!

বলতে কী! কবিতার বাজার মূল্য থাকলেও কবির মূল্য নেহাত কম। কবিতা লিখে না পাওয়া যায় পয়সা। অন্যসব জায়গায় ছিঁটেফোটা মিথ্যে বলে কেটে আসতে চাইলেও রমণীদের কাছে সর্বদা সত্য বলে আপন করে নিতে চাইতাম। না। এরাও একসময় বৈষয়িক হয়ে উঠেছে। মাটির গহনা থেকে স্বর্ণের অর্নামেন্টে রূপ নিয়েছে। সুনীল গাঙ্গুলী তার প্রেমিকা মার্গারিটকে খুশি করতে কবি পল এঙ্গেলকে চিঠি লিখতেন যা মিথ্যের ফুলঝুরি। সুনীলের ভাষ্যেÑ পলকে আমি জানাতাম, দেশে ফেরা মাত্র আমি দু’তিনটে কাগজ থেকে লেখার জন্য অনুরুদ্ধ হয়েছি। টাকা দিচ্ছে বেশ ভালো, আমাদের কবিতার কাগজ দারুণ চলছে, তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাচ্ছি, তারা ভালো ফি দেয়, ইত্যাদি। আদতে ব্যাপারটা হলো, কেউ পাত্তাই দেয়নি আমাকে।’

কিছু প্রেম প্রকাশ করা হয়নি। সেটা পরিণত বয়েসেও এসে। সবচেয়ে বেশি সময় যে রমণীর প্রেম ডুবে ডুবে জল খেয়েছি। সেও জানে। আমরা দুজনেই জল খাচ্ছি। এখনই চলছে হয়ত। আমাদের ভালোবাসাময় মুহূর্ত। কিন্তু আমরা যেন কেউ কেউ কাউকে অভিযোগ তুলতে না পারি ভবিষ্যতে। এমন ভাবনা থেকেই হয়ত বলা হয়নি এই প্রেমের ধারা বিবরণ। এজন্য প্রেমটা হয়ে ওঠেনি। তবে এটুকু স্বীকার করে বলতে হয়। আমি যখন অন্য কোনো রমণীর প্রেমে পড়ে উষ্টা খেয়েছি। সে এসে ভালোবাসা দিয়েছে। কষ্টের সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কষ্টে-কালো হৃদয়টা যখন পুড়ে যাচ্ছে। তখন সে এসে দেবদূতের মতো কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কখনই বলতে যাইনি আমাকে উদ্ধার করো। অর্থাৎ কোনো দাবিদাওয়াই তো ছিল না।

চৈত্রতপ্তদুপুরে পুকুরের জলের নিচে ডুবকি মেরে শ্বাস নেওয়ার মতো করে প্রশান্তি নিতে যে চাইতাম না। সে কথা স্বীকার না করলে শিল্পের কাছে মিথ্যে বলা হবে। মনে করি সত্য-সুন্দরের নাম শিল্প। আমিও তাকে ভালোবাসি। ডুবে মরতে চাই অলকানন্দার জলে। আবার ভেসেও তো উঠতে চাই অজানা পাহাড়ের শানুতলে। হ্যাঁ। শুধু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারতাম না, কী তোমারে চাহি বুঝাইতে?/ গভীর হৃদয় মাঝে/ নাহি জানি কী যে কাজে/ নিশিদিন নীরব সঙ্গীতে...। নীরব থেকে আরও বেশি গভীরতম দুঃখ এসে কষ্টবিভায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কবিতার কাছে। শিল্পের কাছে। সংসার পেতেছি এখন সৃষ্টিশীলতার ঘরে।

হাসনাত মোবারক : কবি ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

 
Electronic Paper