ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বুকের খোঁড়লে গণ বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গ রাখাল
🕐 ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ০৫, ২০২১

বুকের খোঁড়লে গণ বিশ্ববিদ্যালয়

জীবনের অনেক সখ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিমছাম পরিবেশ। এসেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম চারদিকের পরিবেশ দেখে। বনবাদাড়ের মধ্যে সবুজ পরিবেশকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। আমি একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসেই প্রেমে পড়ে গেলাম। বাংলা কোনোদিন পড়ব না বলেও অবশেষে বাংলার কাছেই নতজানু হয়ে সঁপে দিলাম মন। সেসময় সমাজ-বিজ্ঞান অনুষদের ডিন মাহমুদ শাহ কোরেশী। আবেদা আফরোজা ম্যাম বিভাগীয় প্রধান। চারদিকে বসে আছে কৃষ্ণা ম্যাম, আয়েশা ম্যাম, আতিউন নাহার ম্যাম ও আবু রায়হান স্যার। ভাইভা হচ্ছে। মাহমুদ শাহ কোরেশী স্যার আমি কোথা থেকে এসেছি, বাংলায় কেন পড়তে চাই সব জানতে চাইলেন। এতক্ষণে সবাই জেনে গেছেন লেখালেখি করি, পত্রিকা করি। আমি লজ্জাও পেয়েছিলাম এত বড় লেখক এবং বড় বড় শিক্ষকরা আমাকে লেখক, কবি বলে সম্বোধন করছেন।

শুরু হলো আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। বন্ধুরাও ইতোমধ্যে জেনে গেছে এই বাংলা বিভাগে একজন লেখক ভর্তি হয়ে গেছে। আমার পরিচয় দেওয়ার আগেই দেখি আমার বন্ধুরাই আমাকে নিজেদের মধ্যে পরিচিত করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে কার না ভালো লাগে কিন্তু কেন যেন কীসের একটা শূন্যতা অনুভব করছি। কয়েকদিন পরেই যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছি। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা, নাট্যকলা বা চারুকলা বিভাগ। এসবই বিশ্ববিদ্যালয়কে জীবন্ত করে রাখে। মাতিয়ে রাখে রঙের নানা ঠাঁটে বা মোহনায়। বাংলা বিভাগে কোনো সাহিত্যের কাগজ নেই। শুনেছিলাম একটা দেয়াল পত্রিকা করেছিল তাও আবার বন্ধ হয়ে আছে। তখন আমি কিছু বন্ধু কিংবা বড়ভাইদের রাজি করিয়ে একটা পত্রিকা করতে চাইলাম। যে ভাবনা সেই কাজ। পত্রিকার নাম দিলাম ‘বঙ্গস্বর’। ‘বঙ্গস্বর’র জন্য লেখা জোগাড় এবং শেষমেষ প্রকাশিত হলো ছোটকাগজটি। গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর আগে কোনো পত্রিকা বের হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। পত্রিকার মোড়ক উন্মোচনের দিন সকল বিভাগের প্রধানদের এবং আমাদের পরিচিত শিক্ষকরা উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রাণভরে সবাই দোয়া করে আমার ঘাড় চাপড়ে বলেছিলেন- অনেক বড় হবে। সেই আশীর্বাদ আমার পথ চলার পাথেয় হয়ে আছে।

বাংলা বিভাগকে দেখতে চেয়েছি অনেক প্রাণবন্ত বিভাগ হিসেবে। কয়েক বছর আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ে ঘুড়ি উৎসব এবং ছবি প্রদর্শনীও হয়েছে। পরে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন এগুলো ক্যাম্পাসে হয় কিনা জানি না। অনেকদিন ক্যাম্পাসের মিষ্টি রোদ শরীরে মাখি না। হাঁটি না আমাদের পরিচিত পথ ধরে...। এই সবুজে ঘেরা গাছ-গাছালি বেষ্টিত সবুজাভ ক্যাম্পাস। বাংলা বিভাগের জানালায় দাঁড়িয়েই অবলোকন করতে পারি সুদূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাল গাছ। একবার বিশ^বিদ্যালয়ের সমস্ত বিভাগগুলোর অংশগ্রহণে শুরু হয়েছিল রচনা প্রতিযোগিতা আর এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম আমিও এবং সেইবার আমি সমস্ত বিভাগগুলোর মধ্যে প্রথম হয়ে আত্মহারা হয়েছিলাম। কারণ আমাদের বাংলা বিভাগ থেকে এর আগে আর কোনো ছাত্র বা ছাত্রী এই পুরস্কার পাইনি। এই বিভাগ নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকলেও আস্তে আস্তে আমার স্বপ্নের বিভাগের স্বপ্ন উবে যেতে থাকে- আমার বিভাগসহ ক্যাম্পাসে শান্তি পাই না। কোনো পত্রিকা করতে পারি না। বাংলাকে সম্মান দেখাতে পারি না। লাইব্রেরিতে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখি। ক্লাস না থাকলেও লাইব্রেরিতে এসে বই নিয়ে পড়ে থাকি। নিজেকে নিজের মধ্যে গোটাতে শুরু করি। তবুও শান্তি পাই নিজেকে নানা কাজে জড়িয়ে ফেলে। যোগাযোগটা শাহবাগকেন্দ্রিক করে তুলি।

নিজের প্রেমপিপাসা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে আর এই ক্যাম্পাসের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখতে পারছি না। তবুও একদিন অন্য বিভাগের স্যার মকদুম মাশরাফীকে সম্পাদক করে প্রকাশ করলাম ‘অন্যত্র’ নামে একটা ভাঁজপত্র। ছড়িয়ে দিলাম শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে। এটাও কম কী! আমি একমাত্র ছেলে বাংলা বিভাগ থেকে বের হয়েছিÑ যে গণ বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে আমার ছোটকাগজ প্রকাশের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। কেউ কোনোদিন এই পত্রিকার খোঁজ করতে এলে জানবেÑ এই বাংলা বিভাগের এক ছাত্র অনেক ভালোবাসা দিয়ে, হৃদয় উজাড় করে দুটো কাগজ প্রকাশ করেছিল। এখনো বাংলা বিভাগে গেলে হয়তো ‘বঙ্গস্বরে’র অস্তিত্ব কেউ কেউ দেখতে পাবেন কিংবা পাবেন না। হয়তবা কেউ রুমকে নোংরা করে রেখেছে বলে নিজের মাধুরী মিশিয়ে ‘বঙ্গস্বর’ নামের আমার বা আমাদের শেষচিহ্ন স্মকটিও হয়ত মুছে ফেলবে। মনের মধ্যে এখনো এক ক্ষয়িত যন্ত্রণা হয়। হৃদয়ে কম্পন বাসা বাঁধে- হয়ত কোনো একদিন এক তরুণ বাংলা বিভাগ থেকে বের হয়ে আসবে বাংলা সাহিত্যকে আলোড়িত করতে কিংবা বাংলা বিভাগে নিজের তারুণ্য দিয়ে দাপিয়ে ফিরবে ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত... মুগ্ধতার সাম্পানে ভর করে সাজিয়ে তুলবে বাংলা বিভাগকে। ছোটকাগজের ইতিহাসে লিখিত হবে অন্য পত্রিকার নাম। সেই দিনের প্রতীক্ষায়...।

বঙ্গ রাখাল : কবি ও ছোটকাগজকর্মী
[email protected]

 
Electronic Paper